প্রেম থেকে বিরহ, রাগ থেকে অনুরাগ- তাঁর কবিতা বাঙালিকে ছুঁয়েছে প্রতিটা আবেগে , কীভাবে শুরু হয়েছিল কবিতাপথের সফর, ‘টলিকথা’য় আজ সেই কাহিনি শোনালেন বিশিষ্ট কবি সুবোধ সরকার।
প্রঃ আপনার কবিতা বাঙালিকে বরাবর ছুঁয়েছে, কী বলবেন দর্শকদের?
সুবোধ সরকারঃ আবেগ জিনিসটা বড় সুন্দর এবং বিপজ্জনক। এর দুটো দিকঈ সমানভাবে আমার কছে উঠে আএ। একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়া কম বয়সী ছেলে যখন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বারোতলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার মধ্যে যেমন বাঙালির আবেগের সেই বিপজ্জনক দিকটা আছে তেমন আবেগের ভাল দিকটাও আছে। আবেগ না থাকলে কবতা হয় না, কবিতার মধ্যে আবেগ, ভালবাসা, আগুন থাকবে না তাহলে কীসের মধ্যে থাকবে? কবিতা তো সেইজন্যই। লিখি যাতে আগুনকে স্পর্শ করতে পারি। বাঙালি পাঠক চিরকাল আবেগ ভালবাসে, আগুন ভালবাসে। মেধা-মননও আছে। তাদের সংখ্যা কম হলেও গুরুত্ব অনেক বেশি।
প্রঃ কবিতা প্রেম নিয়ে যখন কথা হল তখন বই আসবেই। এখন কি নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসটা দিন দিন কমে যাচ্ছে?
সুবোধ সরকারঃ এই কথাটা অনেকেই বলছে যে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। বাঙালির বই পড়ার যে অভ্যাস ছিল সেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কারণ এখন অনেক উপকরণ জুটে গিয়েছে। সারাক্ষণ হাতে মুঠোফোন বা মোবাইল। সুতরাং ছেলে মেয়েরা বইয়ের দিকে আসছে না। কিন্তু একটা উদাহরণ এই মুহুর্তে আমার মনে পড়ছে। সাম্প্রতিক কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার ঘটনা। ১০-১২ দিনে বইমেলাতে ২৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এটা নট অ্যা ম্যাটার অফ জোক! এটা খুব ভাল খবর কিন্তু যে তুলনায় মানুষ আসে সেই তুলনায় হয়ত বই বিক্রি খুব বেশি নয়, কিন্তু এটাও সত্যি যে কমবয়সীরা নাকি বই থেকে দূরে থাকেন কিন্তু আমি তো বইমেলাতে কমবয়সীদের ভিড়ই বেশি দেখেছি। অনেকে বলেন হুজুগ, অনেকে বলেন খেতে যাওয়া, মেলা দেখতে যাওয়া এই কারণে ভিড়-কিন্তু এগুলো তো থাকবেই। সবই করতে হবে, সবকিছু নিয়ে মেলা। কিন্তু বই বিক্রি তো হয়েছে। সেদিক থেকে বলব এই উদাহরণটা যদি আমাদের সামনে আসে তাহলে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। আর একটা উদাহরণ সারাবছরের উদাহরণ। আপনি চলে যান কলেজস্ট্রিট, ঘুরে দেখুন একি জায়গায় পঞ্চাশটা দোকান। একটা কাউন্টারও ফাঁকা পাবেন না। ছোট প্রকাশকের ঘর ও ছবিটা এক। সুতরাং বি বিক্রি হচ্ছে না, মাছি তাড়াচ্ছে এটা একদিন দু’দিন হতে পারে, কোভিদে বইয়ের সর্বনাশ হয়েছে বলে হা-হুতাশ- আমার তো কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে, বইমেলায় গিয়ে তা একেবারেই মনে হয় না।
প্রঃ সত্তরের দশকে যখন প্রথম কবিতা জগতে আপনার সূত্রপাত, এখন পিছন ফিরে তাকিয়ে কী বলবেন?
সুবোধ সরকারঃ পিছনে তাকালে আমি দেখতে পাই আমি যে ছোট্ট জেলা শহরে জন্মেছিলাম, বড় হয়েছি, জীবনের প্রথম ২৫ বছর কাটিয়েছি, তারপর কলকাতায় এসেছি। এই ২৫ বছর, তার সবটা এখনও আমার পিঠে আছে। এখনও পিঠে একটা শহর নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। এটা যখন আমি আমেরিকা যায়, গ্রিস বা জার্মানি- যেখানেই যাই বুঝতে পারি। পিঠটা টনটন করে আমার। আমি ঠিক আছে- আস্তে…আস্তে…কৃষ্ণ নগর আস্তে…তুমি আমার পিঠে আছো। কখনও কখনও নামেতে ইচ্ছে করে। যেমনভাবে ঝুড়ি নামিয়ে রাখে মানুষ, আবার ইচ্ছে করে না। মনে হয় থাকুক পিঠে। ভেবে দেখেছি, এটা শুধু আমার অনুভূতি নয়। প্রত্যেক মানুষের একটা পিছন ফিরে তাকানো আছে। সেই ফিরে তাকানোর অনুভূতিটা কখনও খনী খুব শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রে যেমনভাবে কৃষ্ণনগর। এই কৃষ্ণনগর ছেড়ে আমি কোনওদিন চলে আসিনি। আমি যেখানেই যাই না কৃষ্ণনগর আমার সঙ্গে থাকে।
প্রঃ আপনার সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে দেখলাম কিছুদিন আগে কবিতার গাড়ি উদ্বোধনে আপনি ছিলেন, কবিতার গাড়ি কী?
সুবোধ সরকারঃ আসলে আমাদের ‘ভাষানগর’ নামে একটা পত্রিকা আছে। এটা লিটল ম্যাগাজিন। ৩৫ বছর আগে আমরা শুরু করেছিলাম। লিটল ম্যাগাজিনঅনেকবার মৃত্যুবরণ করে, আবার অনেকবার জন্মায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিটল ম্যাগাজিনকে স্ফিংসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সুতরাং সেদিক থেকে আমি বলব যে লিটল ম্যাগাজিনের গাড়ি মানে কবিতার গাড়ি। লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে আমাদের ছোট্ট ঠেলাগাড়ির ওপর একটা বাড়ি বানানো হয়, বাড়ির মধ্যে কবিতার বই। সেখান থেকে মানুষ বই কেনে- এটাই কনসেপ্ট।
প্রঃ শুধু বাংলা বা দেশে নয়, বিদেশেও আপনার বই ছড়িয়ে আছে- এমন কোনও বিশেষ শহরের অভিজ্ঞতা যদি বলেন
সুবোধ সরকারঃ শহর বলতে আমার কাছে তিন্টি শহর। একটা ছোটবেলার শহর, যেখানে আমি জন্মেছি সেই কৃষ্ণনগর। আর এক্টা বড় শহর যেখানে এই মুহূর্তে আমি বসবাস করি, যে শহরের কাছে আমি ঋণী কলকাতা। আর একটা শহর যার কাছে আমি ঋণী নই, কিন্তু সেই শহরটা খুব ভাল লাগে-নিউইয়র্ক। বিশেষ করে ম্যানহাটন। সেখানে বইয়ের খুব কদর। আমাদের একটা খুব ভুল ধারণা আছে যে আমেরিকা তো ইউরোপ নয়, এবং সেই অর্থে খুব শিক্ষিত নয়। তাদের মধ্যে সেইঅর্থে ট্র্যাডিশন নেই। মাত্র ৫০০ বছরের একটা আধুনিক্তা, সেই আধুনিকতা এখনও পর্যন্ত সেরকম ঐতিহ্যে পরিণত হয়নি, যে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করা হবে। কিন্তু এই নিউইয়র্কই একজমাত্র শহর ্যেখানে কবিতা একাদেমি আছে। কলকাতাতেও আছে। পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কবিতাকে নির্ভর করে একটা একাদেমি হতে পারে এটা খুব বিস্ময়কর! কিন্তু আমার কাছে নিউইয়র্ক এমন একটা শহর যার এক কোণে বসে কেউ যদি সারা পৃথিবীকে জানতে চায়, নিজের চোখে দেখতে চায়, শহরের মানুষ দেখতে তাহলে নিউইয়র্কের মতো দ্বিতীয় আর কোনও শহর কল্পনাও করা যায় না।
প্রঃ আপনার নতুন কবিতার বই নিয়ে পাঠকপাঠিকাদের কিছু বলুন
সুবোধ সরকারঃ এ বছর বিমেলায় আমার দুটো বই বেরিয়েছে। একটা মহাকাব্যিক রচনা। যেটিকা ছাপা হয়েছে উপন্যাস বলে। কবিতায় লেখা কাব্য উপন্যাস ‘উদ্যাম রজনীর কাব্য’। বইটি পুজোর সময় ‘দেশ’ পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টি কবিতার বই ‘একটি চুম্বন, একটি ডিনামাইট’। এই বইটিতে আমার সাম্প্রতিক কালের সমস্ত কবিতা রয়েছে। বিশেষ করে গত ১ বছরের লেখা কবিতা থেকে বাছাই করে বেরিয়েছে। তৃতীয় বইটি খুব ছোট একটা দু’ফর্মার বই। এই বছর বইমেলায় থিম কান্ট্রি স্পেন ছিল চোদ্দটি বাংলা ও স্প্যানিশ কবিতা পাশাপাশি নিয়ে একটা বই বইমেলাতে বেরিয়েছিল, পরেও হয়ত পাওয়া যাবে। সেই অর্থে আমার এবার তিনটি বই বেরিয়েছে।