সত্যজিতের মহানগর। চারুলতা। কাপুরুষ।
ঋত্বিকের সুবর্ণরেখা।
মৃণাল সেনের বাইশে শ্রাবণ।
পূর্ণেন্দুর স্ত্রীর পত্র। মালঞ্চ। স্বপ্ন নিয়ে।
তরুণ মজুমদারের গণদেবতা।
বাংলা চলচ্চিত্রে এমন কোনও নাম নেই যাঁর ছবিতে তাঁকে দেখা যায়নি। প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি সফল। মাধবী মুখোপাধ্যায়। বানিজ্যিক এবং অন্য ধারার ছবি, দুই ক্ষেত্রেই তিনি অত্যন্ত সফল।
গ্ল্যামারাস চরিত্র থেকে সাদা-সিধে আটপৌরে সব ধরনের চরিত্রে তিনি মিশে যেতে পারতেন। পরিচালকদের পছন্দের সেরায় তাই মাধবী বিকল্পহীন।
প্রায় সব পরিচালকই এক বাক্যে বলেছেন, ‘ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে যেন এক অন্য মাধবী বেরিয়ে আসেখোলস ভেঙে।’
এ মাধবী অচেনা। একেবারে চিত্রনাট্যের লাইন থেকে উঠে আসা মানুষ। প্রস্তুতির সময়েই অভিনীত চরিত্রটিকে নিজের ভিতর একেবারে শুষে নিতেন মাধবী। নিজের অভিব্যক্তিকে সেভাবেই বদলে নিতে পারতেন।।
মাধবী মুখোপাধ্যায় সব সময়ই ‘ডিরেক্টরস অ্যাকট্রেস’।
মোহময়ী গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী বলতে যা বোঝায় তা তিনি নন। কিন্তু মাধবীর সৌন্দর্যে কাছে বহু মোহময়ী ঝাপসা হয়ে যান। তার জন্য বিশেষ কসরত করতে হয়নি তাঁকে। ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’ মানুষদের কাছে তিনি অনন্যা।
জীবন কখনও খুব সহজ হয়ে ধরা দেয়নি তাঁর কাছে। চড়াই-উৎরাই আর ক্ষতের দাগে ভরা তাঁর চলন পথ।
মাধবীর জন্ম কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। তখন অবশ্য তিনি মাধুরী।
ছোটবেলার স্মৃতি বললেই তাঁর মনে পড়ে যায় দেশভাগের কথা। একদিন দাঙ্গা মাথায় নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসতে হয় বাড়ি থেকে।
মাথার ওপর ছাদ আর পায়ের তলার মাটি দুই সরে যায় একসঙ্গে। রাতারাতি।
এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নিজের শহরেই ঘরছাড়া হয়ে থাকার যন্ত্রণা কম নয়। চেনা মানুষগুলোর চেনা মুখ যেন বদলে যায় আচমকাই। অপমান নিত্যসঙ্গী।
দমবন্ধ কোনঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চলত প্রতিদিন। পরিবার বলতে দিদি, মা লীলাদেবী আর মাধুরী।
আগুনে সময়ে খড়কুটো খুঁজতে খুঁজতেই তাঁর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল শ্রীরঙ্গমের সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের।
সালটা ১৯৪৭। দিনটা ১৫ আগস্ট।
মায়ের হাত ধরে সন্ধ্যেবেলা শ্রীরঙ্গম-এ গেলেন মাধুরী আর তাঁর দিদি। অল্প অল্প গান গাইতে জানতেন।
স্বাধীনতার দিন সন্ধেবেলা স্টেজে উঠে গাইলেন ‘বন্দে মাতরম’।
সেই প্রথম মঞ্চ প্রবেশ। সেদিনই স্থির হয়ে গিয়েছিল সেই দুধের শিশুর নিয়তি। বয়স সবে পাঁচ।
বাবা-মা’র বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল খুব ছোটবেলায় তখনও তাঁর জ্ঞান হয়নি। পাঁচ সন্তানের ভরা সংসার। নিম্নবিত্ত পরিবার। মা গান গেয়ে সংসার চালাতেন।
সুরাহার জন্যই অভিনয় জীবনে প্রবেশ। প্রথম নাটক ‘দুই পুরুষ’। তবে তারও আগে তেরো বছর বয়স পর্যন্ত অভিনয় করেছেন ছেলেদের ভূমিকায়। মানে কিশোর চরিত্রে।
১৯৫৩ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে তিনি অভিনয় করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘দুই বিয়ে’ ছবিতে। তখন অবশ্য তিনি মাধুরী।
১৯৬০ সালে মুক্তি পায় মৃণাল সেনের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’। এই ছবি থেকেই পাল্টে যায় তাঁর নাম । বিজয় চট্টোপাধ্যায় নতুন নাম দেন, ‘মাধবী’।
সহজাত অভিনয় প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। অধ্যাবসায় দিয়ে তিলেতিলে নিজেকে গড়েছিলেন মনের মতো করে। প্রতি ছবিতেই তিনি নতুন। প্রতি ছবিতেই আরও পরিনত। হয়ে উঠেছিলেন আন্তর্জাতিক মানের।
মাধবী ক্যামেরায় এক জীবন্ত কবিতা। ক্লোজআপ শটে তাঁর চোখের গভীরতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কখনও ফিকে হয় না দৃশ্য।
বহুবার খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে তাঁর অভিনেত্রী জীবন। কিন্তু ছোটবেলা থেকে ঝড়-জল-আগুনে পুড়ে যাঁর বড় হয়ে ওঠা তাঁকে দমানো সহজ নয়। আজও তাই নব বসন্তের আনন্দে উজ্জ্বল মাধবী কানন। সেই ভাবেই তাঁর পথ চলা...