লাইফ ডিভাইন; সত্যিই ঋষি অরবিন্দের জীবন যেন এক মহাজীবন। সাহেব সাজা বাঙালি থেকে স্বদেশী, তারপর ঋষি! এক সাধকের জীবন। থিয়েটার রোডের মামার বাড়ি, আজ যা অরবিন্দ ভবন নামে পরিচিত সেখানেই অরবিন্দর জন্ম ১৮৭২ সালের ১৫ই আগস্ট।
কিন্তু জেলের অ্যাডমিশন রেজিস্টারে শ্রীঅরবিন্দর ঠিকানা ঘোষপাড়া, কোন্নগর, হুগলি। উচ্চতা ৫ ফুট ৬.২ ইঞ্চি। বয়স ৩৭, চিবুকে ছুঁচলো দাড়ি, পিঠে তিনটি তিল ইত্যাদি।
কোন্নগরের বিখ্যাত বনেদি ঘোষবাড়ির ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ, তিনিই ঋষির পিতৃদেব। পেশায় একজন চিকিৎসক, যে সে চিকিৎসক নয়, সাহেব সাজতে ভালবাসা বিলেত ফেরত চিকিৎসক। পড়তে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। বিলেতে পরিবেশ, আদবকায়দা দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তখন থেকেই মনে প্রাণে হাবে-ভাবে কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ হয়েছিলেন ইউরোপীয়। তাঁর ইচ্ছে, ছেলেরাও যেন এমন শিক্ষা পায়। দুই ছেলে মনমোহন ও বিনয়ভূষণকে পাঠিয়ে দিলেন দার্জিলিংয়ের কনভেন্ট স্কুলে। ছোটছেলে অরবিন্দরও জন্য তাইই ভাবলেন!
মাতামহ ব্রাহ্মসমাজের কেউকেটা রাজনারায়ণ বসুর বাড়িতেই ছোট্ট অরবিন্দ বেড়ে উঠছিলেন। সেখানেই সাহিত্যের চর্চার হাতে খড়ি। কিন্তু তা আর হল না, বাবার ইচ্ছা ছেলেকে সাহেব বানাবেন। ছোট্ট অরবিন্দ বাংলা জানলেন না! ইংরেজি আর হিন্দিতেই সব চলত। সাহেব হতে হবে যে!
দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্ট স্কুলেই শুরু হল অরবিন্দের শিক্ষাজীবন। কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্ন ছেলে তাঁর মতো ডাক্তার হবে; এবং পরবর্তীতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে কাজ করবে। সেই খাতেই বইতে লাগল ঋষির প্রথম জীবন।
এবার বিলেতযাত্রার পালা! পাহাড় থেকে সমুদ্র পাড় করে, সিভিল সার্ভিসের জন্য তাঁর গন্তব্য হল ইংল্যান্ড। ছোট থেকেই বিলেতে পড়াশোনা করলে, মানিয়ে নিতে আর অসুবিধা থাকবে না। অতএব, জাহাজে উঠলেন বছর সাতেকের অরবিন্দ 'অ্যাক্রয়েড' ঘোষ। বাবা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথমে ছেলের এই নাম রেখেছিলেন।
অসম্ভব মেধাবী ছিলেন ঘোষবাড়ির ছোটছেলে। ইংরেজি, গ্রিক, ফরাসি, ল্যাটিন, জার্মান—একের পর এক ভাষা শিখতে শুরু করলেন অরবিন্দ। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সবকিছুই জানলেন কেবল ব্রাত্য থাকল স্বদেশ! বাংলা, ভারত নৈব নৈব চ।
সেন্ট পলস স্কুল, কেমব্রিজের কিংস কলেজ, ডিঙিয়ে অরবিন্দ আইসিএসের প্রস্তুতি চলছে। ওদিকে একটু একটু করে অরবিন্দের হৃদয়ে স্বদেশপ্রেমের উদয় হচ্ছিল। বিদেশের জীবন ততই অসহ্য লাগতে শুরু করল। বিলেতে থাকাকালীন সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতের মাটিতে ব্রিটিশদের অত্যাচার-অপশাসনের কথা জানতে পারেন তিনি৷ ফরাসী বিপ্লব ও আইরিশদের মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে 'লোটাস অ্যান্ড ড্যাগার' নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। তখনও অ্যাক্রয়েড মিডিল নেম ব্যবহার করছেন, বিদেশি কায়দায় নিজের নাম লিখছেন 'Aaravind Ghose' !
সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসলেন অরবিন্দ, ২৫০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১-তম স্থান অর্জন করলেন তিনি। এরপরের ধাপ ছিল ঘোড়ায় চড়া। চাকরি নয় দেশে ফিরতে চান মনে মনে, এটাই সুযোগ! ইচ্ছে করে ফেল করলেন, ঘোড়ায় চড়াতে অকৃতকার্য হলেন অরবিন্দ ঘোষ! বাদ পড়লেন। কেমব্রিজে পড়াকালীন বেশ কিছু বক্তৃতা দিয়েছিলেন অরবিন্দ, তাঁর বক্তব্যের ছিল বিপ্লব ও স্বাধীনতার চিন্তা। বাদ পড়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। এরপরই ভারতে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন অরবিন্দ ঘোষ। দুই দাদা পুরোদস্তুর সাহেব, মনমোহন ও বিনয়ভূষণ তখনও বিলেতে। জাহাজে উঠলেন, সেই সময় তাঁর মধ্যনাম 'অ্যাক্রয়েড' চিরজীবনের মতো ত্যাগ করলেন। প্রত্যাবর্তনের যাত্রা থেকে তাঁর পরিচয় হল অরবিন্দ ঘোষ, কেবল অরবিন্দ ঘোষ।
ফেরার সময়ই ঘটল দুর্ঘটনা। জাহাজ থেকে মুম্বাইতে নামবেন ছেলে। বাবা কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ ছেলেকে রিসিভ করতে উপস্থিত। হঠাৎ খবর এল, অরবিন্দ ঘোষের জাহাজটি পর্তুগালে ডুবে গিয়েছে। সেযুগেও ফেক নিউজ ছিল! আসলে মহাভারত থেকেই ছিল, অশ্বত্থমা হত ইতি গজ মনে নেই... আর আজ তো ফেক নিউজই ভারত চালাচ্ছে।
কিন্তু সে যাত্রায় জাহাজডুবির ভুয়ো খবরের ফল হল মারাত্মক। অসুস্থ হলেন কৃষ্ণচন্দ্র। মুম্বইতে নেমে অরবিন্দ শুনলেন, বাবা আর নেই। এরপর বরোদায় কর্মজীবন শুরু করলেন। ছোট ভাই বারীন্দ্রকে পেলেন। স্বদেশ চিনতে শুরু করলেন, বাংলা ভাষা শেখাও শুরু হল তাঁর। মারাঠি গুজরাটিও শিখে ফেললেন!
লন্ডনে থাকাকালীন বরোদার মহারাজ তৃতীয় সায়াজিরাও গায়কোয়াড়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। সেই সুবাদেই বরোদার স্টেট সার্ভিসে ২০০ টাকা বেতনের চাকরি। দেশে ফিরে ঐ বরোদায় সার্ভিস অ্যান্ড সেটলমেন্ট বিভাগে কাজ শুরু করেন। পরে কোষাগারেও কাজ করেছেন। ১৯০০ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদা কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হন৷ ১৯০৪ সালে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বরোদায় কাজ করেন। ১৯০১ সালে বরোদায় থাকাকালীন তাঁর বিয়ে হয় ভূপালচন্দ্র বসুর কন্যা মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল দেশ। বরোদা ছেড়ে বাংলায় চলে এলেন আরবিন্দ। জাতীয় কংগ্রেসের নানান কর্মসূচিতে যোগ দিতে লাগলেন। কংগ্রেসের নরমপন্থীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। আসলে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে ঝুকছিলেন অরবিন্দ। কলকাতার জাতীয় কলেজ অর্থাৎ আধুনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হলেন। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে ব্রিটিশ বিরোধী সংবাদপত্রে লেখালিখি, সম্পাদনা। বিপিনচন্দ্র পালের 'বন্দেমাতরম' ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হন তিনি। প্রকাশিত নিবন্ধের জন্য বিপিনচন্দ্র পাল এবং তিনি ব্রিটিশে নজরে চলে আসেন, রজদ্রোহে অভিযুক্ত হন৷ সাজায় বিপিনচন্দ্রের ছয় মাস কারাবাস হয়৷ প্রমাণের ভাবে অরবিন্দ মুক্তি পান৷
অন্যদিকে ভাই বারীন ঘোষ তখন মানিকতলায় তরুণ স্বদেশীদের বোমা তৈরী করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ১৯০৮ সালের ৩০ই এপ্রিল ৷ অত্যাচারী ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার দায়িত্ব পেয়েছেন ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকি৷ বোমার আঘাতে কিংসফোর্ডের বদলে দুজন ইংরেজ মহিলা মারা যান, ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন ৷ প্রফুল্ল চাকী ধরা না দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন । ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় ৷
এই মামলায় ১৯০৮ সালে ধরা পড়েন বারীন ঘোষ৷ ঐ বছরই ৫ই মে ধরা পড়েন অরবিন্দ ঘোষ। ষড়যন্ত্রের দায়ে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়। ধরা পড়েন উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, এই মামলায় এঁদের হয়ে আইনি লড়াই লড়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ৷ এই মামলা চলাকালীন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন। সেই মামলায় অরবিন্দ ঘোষ বেকসুর খালাস পান। মামলা চলাকালীন কিছুদিন অরবিন্দকে আলিপুর জেলে থাকতে হয় ৷
জেলে থাকা কালীন তাঁর জীবনে পরিবর্তন শুরু হয়। আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি৷ অরবিন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, "জেলে থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। যখন আমি এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম একা একটি কুঠুরিতে, বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন।"
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অরবিন্দ আধ্যাত্মিকতায় আত্মনিয়োগ করলেন। তখন আর রাজনীতিতে মন নেই৷ আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে মন ঢলে গিয়েছে৷ ১৯১০ সালে রাজনীতি ত্যাগ করে পন্ডিচেরী গমন করেন৷ ধর্ম প্রচার ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে বিপ্লবী অরবিন্দ 'ঋষি অরবিন্দে' পরিণত হন।