গুপ্তচরব্যবস্থা বা গুপ্তচরবিদ্যা আসলে বহুমাত্রিক একটি বিশেষ বিদ্যা বলেই গণ্য করা হতো অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী। তাই গুপ্তচর নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজারা নানান সুবিধাজনক পদ্ধতির অবলম্বন করতেন। এই বিষয় ভাবনা থেকে গুপ্তচর বা গূঢ়পুরুষদের নানা ভাগে ভাগ করা হত। তবে এই সকল অংশের গুপ্তচরদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা থাকত।
কৌটিল্য বা চাণক্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী রাজকর্ম চালানোর ক্ষেত্রে যে কোন বাস্তব পরিস্থিতি অগ্রাধিকার পাবে। তাই এই সকল ক্ষেত্রে তিনি বাস্তব পরিস্থিতির পক্ষে উপযুক্ত নীতি গ্রহণকেই বেশি গুরুত্ব দান করেছেন। চাণক্যের মতে একটি রাষ্ট্রনৈতিক শক্তি কখনোই চিরকাল বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে সেই রাষ্ট্রের বা রাজ্যের মিত্র প্রকৃতি এবং শত্রু প্রকৃতি গড়ে ওঠে। মিত্র প্রকৃতির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং শত্রু প্রকৃতির সঙ্গে সঠিক পন্থায় লড়াই করা এক রাজার কর্তব্য বলেই বলা রয়েছে অর্থশাস্ত্রে।
মিত্র পক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য রাজাকে নিজেকেই সময় ব্যয় করতে হয়। রাজার মন্ত্রী এবং আমাত্যরা সে কাজে সাহায্য করতে পারে, তবে মূল নিয়ন্ত্রণ সর্বদা রাজার কাছেই থাকা উচিত এমনটাই মনে করতেন চাণক্য।
ঠিক এভাবেই শত্রুপক্ষের সঙ্গে লড়াই করার বেশ কিছু পন্থার কথা বর্ণনা করা আছে অর্থশাস্ত্রে। তার মধ্যে একটি পন্থা হলো গুপ্তচর নিয়োগ। গুপ্তচর নিয়োগের ক্ষেত্রে কৌটিল্য সর্বদা বৈদেশিক নীতি গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রত্যেকটি রাজ্যকে তার আভ্যন্তরীণ শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৌটিল্য। সেই আভ্যন্তরীণ শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার অন্যতম উপায় হল গুপ্তচর নিয়োগ এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ।
রাজা এবং মন্ত্রী মিলে গুপ্তচর নিয়োগ করলেও এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা প্রয়োজন। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য গুপ্তচরদের শ্রেণীবিভাগ করার কথা ভাবা হয়েছিল। এই শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী মোট পাঁচ প্রকার গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচর নিয়োগ করা হত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই গুপ্তচরদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সাধারণত রাজার নির্দিষ্ট প্রয়োজনের কারণে, গুপ্তচরদের মূল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কোন একজনের হাতে থাকত না। রাজার মন্ত্রী এবং আমাত্যরা একসঙ্গে মিলে গুপ্তচরদের নিয়ন্ত্রণ করত। এই নিয়ন্ত্রণকারী রাজার মন্ত্রীদের একত্রে ‘সংস্থা’ বলা হত।
এই সংস্থায় কোন একজন মন্ত্রী থাকত না। গুপ্তচরদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্দেশে তাঁদের নিয়োগ করা হতো। সেই অনুযায়ী তাঁদের বেতন ও নানা ভাগে ভাগ করা থাকতো। স্বাভাবিকভাবেই কোন রাজার পক্ষে এই সবটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। তাই রাজা নিজের বিশ্বস্ত মন্ত্রী এবং আমাত্যদের এই দায়িত্ব ভাগ করে দিতেন। তাঁরাই এই সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত থাকতো।
তবে এই সংস্থাটির মূল নিয়ন্ত্রণ থাকত রাজার হাতে। গুপ্তচরদের অনুগত হওয়া ছিল বাঞ্ছনীয়। এই আনুগত্যের বিষয়টা রাজা সরাসরি দেখতেন। তবে যে সকল মন্ত্রী এবং আমাত্যরা এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকতো তাঁদের বেতন এবং কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজা।
গুপ্তচরদের এই বিশেষ ভাগ রাজ্য চালানোর ক্ষেত্রে নানাভাবে রাজাকে সাহায্য করেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ইতিহাসে। এখানে গুপ্তচরদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির প্রতি রাজা সর্বদা সহানুভূতিশীল থাকতেন। এর বদলে রাজা পেতেন আনুগত্য, অর্থাৎ ইতিহাসেও সঙ্ঘবদ্ধ থেকে সুশাসনের প্রমাণ বারবার পাওয়া গেছে।