এবার আবার আমার নিজের শহরে মানে কলকাতায়। কলকাতা হলো মেলার শহর। সারাবছরই কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো উপলক্ষ্যে মেলা বসে যাচ্ছে। সে জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতো থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস, বই... সবকিছুর মেলাই হচ্ছে। সেই মেলাগুলো যে সবকটাই বহুদিনের পুরনো তা নয়। আবার কয়েকটি মেলার বয়স নেহাত কম নয়।
আজ তেমনই একটি মেলায় বেড়াতে যাই চলুন। তবে এই মেলায় যেতে হলে আমাদের টাইম মেশিনে চড়ে কয়েকমাস এগিয়ে যেতে হবে। অসুবিধা নেই.... মন-রূপ টাইম মেশিন তো আমাদের আছেই। তাহলে আর দেরি কেন? চলুন পাঠক, আজ আমরা যাই দক্ষিণ কলকাতার বেহালা বরিষার ২২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী "চণ্ডী মেলায়"...
প্রথমেই জেনে নিই এই মেলার ইতিহাস। এই ক'দিন ই বা আগের! ধরুন দুশো বছরের কিছু বেশি সময়... সেই দিনের কলকাতা কিন্তু আজকের সারা দেশের চারটি শ্রেষ্ঠ শহরের অন্যতম এই মেট্রোপলিটন সিটি কলকাতা নয়। তখন কলকাতায় জঙ্গল আর বাঁশবাগান ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না।
সেই সময় আজকের বরিশাও কলকাতার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের বংশধর মহেন্দ্র রায়চৌধুরী বরিশায় চণ্ডীপূজার প্রবর্তন করেন। এবং এই পুজো উপলক্ষেই এখানে মেলা শুরু হয়েছিল। শারদীয়া দুর্গোৎসবের দু মাস পরে শুক্ল পক্ষের অষ্টমী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত তিন দিন চলে এই চণ্ডী পূজা।
এবং এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে ১০ দিনের মেলা। আগে এই চণ্ডী মায়ের পুজো পারিবারিক থাকলেও এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পারিবারিক পুজোর এতো বিশালত্ব বা সমারোহ ছিল না। সেই পুজো তিনদিনের হতো এবং দেবী মায়ের কাছে পাঠা বলি ও মোষ বলিরও প্রথা চালু ছিল।
এই মেলা বা দেবী চণ্ডীর পুজোর পিছনে আরেকটি কাহিনী রয়েছে। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ির লাগোয়া একটি পুকুর রয়েছে। নাম চণ্ডীপুকুর। কথিত আছে যে স্বপ্নাদেশে এই পুকুর থেকে পাওয়া যায় একটি ঘড়া। সেই ঘড়াকেই বেনারসী শাড়ি এবং নানারকম অলঙ্কারে সাজিয়ে দেবী রূপে পুজো করা হতো। কিন্তু এখন দেবী মায়ের মূর্তি তৈরি করেই তাঁর আরাধনা করা হয়। সেই ঘড়া আজও সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়িতে রয়েছে।
দেবী চণ্ডীর পুজো নিয়ে এই বরিশা অঞ্চলের মানুষের উৎসাহ এবং উন্মাদনা চোখে পড়ার মতো। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন পুজো দিতে এবং মেলায় বেড়াতে। প্রতি বছর মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এবং মেলা কমিটি একাধিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নারী দিবস, প্রতিবন্ধী দিবস, শিশু দিবস এবং যুব দিবস পালন করা হয়।
মেলায় চলে নানান জিনিসের বিকিকিনি। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল থেকে হাল আমলের ব্যাটারি চালিত খেলনা, ঘরকন্নার সমস্ত জিনিস, সাজগোজের জিনিস, গৃহসজ্জার সামগ্ৰী.... পাওয়া যাবে সমস্ত কিছুই। আর খাওয়া দাওয়া তো আছেই।
(এই ব্যাপারে এই নিবন্ধ লিখিয়ের উৎসাহটা সবথেকে বেশি কিনা!) ঘুঘনি, আলুর দম থেকে ফিশ ফ্রাই, বিরিয়ানি, মোমো, জিলিপি, তক্তি, বিভিন্ন মিঠাই, কোল্ড ড্রিঙ্কস, আইসক্রিম, নানারকমের টক ঝাল মিষ্টি আচার এমন কি মিষ্টি পান পর্যন্ত.... খাদ্যরসিকদের স্বর্গভূমি একেবারে।
আছে পুতুলনাচ, সার্কাস, মজাদার ভেন্ট্রিলোকুইজম, নাগরদোলা, চড়কি... শিশুদের পাশাপাশি বড়দেরও মজা খুশির বহু উপকরণ। দশদিন পর ভাঙে এই চণ্ডী মেলা। অপেক্ষা শুরু হয় পরের বছরের।
আজ এই পর্যন্তই থাক। পরের সপ্তাহে আবার নতুন মেলায়... "হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোথা....."