সতীপীঠঃ মহীশূরের জাগ্রত প্রাচীন তীর্থে রয়েছেন কৃপাময়ী বিঘ্ননাশিনী ‘মা চামুণ্ডেশ্বরী’

কর্ণাটকের মহীশূর। শহর থেকে তেরো কিলোমিটার দূরে চামুণ্ডী পাহাড়। সেই পাহাড়ের চূড়াতেই রয়েছে দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর মন্দির। এই মন্দির শুধু সারা দক্ষিণ ভারতের নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের নয়, সারা পৃথিবীর শক্তিসাধক ভক্তজনের কাছে এক সুখ্যাত পবিত্রতীর্থ। কেননা, এই পীঠ একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠ। ভক্তজনের বিশ্বাস, পৌরাণিককালে এই পীঠস্থানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর কেশরাশি পতিত হয় এবং দেবীর কেশ এখানে মাটিতে পড়ার পরই তা শিলায় পরিণত হয়।

আদিতে এই সতীপীঠ গাছের নীচের ছোট্ট একটি থানমাত্র ছিল। থানটি লোকগোচরে এসেছে আজ থেকে প্রায় ন’শো বা হাজার বছর আগে। দেবীর নামে নামাঙ্কিত পাহাড়টি তখন ভগবান শিবের নামে নামাঙ্কিত ছিল। এই পাহাড়কে তখন ‘মহাবলদ্রী’ নামে অভিহিত করা হত। ভক্তসাধারণের বিশ্বাস ছিল যে, এই পাহাড়ে স্বয়ং মহাদেব সর্বদা অবস্থান করেন। দক্ষিণ ভারতের হাজার বছরেরও প্রাচীন বিখ্যাত গঙ্গা-রাজাদের আমলে তাই এখানে নির্মিত হয়েছিল ‘মহাবলেশ্বর’ মহাদেবের সুরম্য ও শিল্পসুষমামণ্ডিত অসম্ভব সুন্দর মন্দির। এই পাহাড়ের ওপর এটিই সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে মহীশূরের হয়শালা রাজবংশ যখন আপন শক্তিতে প্রতিষ্ঠা পেল, তখন পাহাড়ের দৈবী-আবহাওয়ার কিছুটা পটপরিবর্তন হল। এঁরা আগের রাজবংশের মতো নিতান্ত শৈব ছিলেন না, দেবী শক্তির প্রতি এঁদের নিষ্ঠা ছিল বেশি। কাজেই এঁদের রাজত্বেই পাহাড়ের থানবাসিনী দেবীর মাহাত্ম্য দিকে দিকে প্রচারিত হল। তাঁদের হাত বেয়েই দেবীর প্রাচীন থানের ওপর এই সময় সুরম্য মন্দির নির্মাণের সূচনা হল। দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল। পরিবর্তিত হল পাহাড়ের পূর্বতন নামও। দেবীর নামে ‘মহাবলদ্রী’ পাহাড়ের নাম রাখা হল, ‘চামুণ্ডী পাহাড়’। শুধু তাই নয়, এই রাজবংশের সময়ই দেবী ধীরে ধীরে মহীশূরের রাজপরিবারের একান্ত কুলদেবী হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন সমগ্র রাজ্যের আরাধ্যা দেবী। তবে সর্বজনের মধ্যে দেবীর এই প্রতিষ্ঠাপর্বে এবং পাহাড়ে দেবীতীর্থ সেজে ওঠার ক্ষেত্রে শুধু হয়শালা নয়, ইতিহাসের ধারা বেয়ে অনেক রাজা ও রাজবংশেরই অবদান রয়েছে। 

দেবীর নাম থেকেই বোঝা যায়, এই দেবী আসলে সাক্ষাৎ দুর্গা। সাধারণ মানুষ স্থানীয় ভাষায় তাঁকে ‘নাডা দেবী’ বলে সম্বোধন করলেও মহীশূরের রাজারা কিন্তু ‘মা চামুণ্ডী’ বলেই সম্বোধন করতেন। কখনো কখনো অবশ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী'’ বলেও সম্বোধন করতেন। কেননা, এই দেবী চণ্ড, মুণ্ড, মহিষাসুরের মতো অত্যন্ত অত্যাচারী দেব-মানব বিদ্বেষী দৈত্যদের বধ করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আপন সন্তানদের দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। পীঠস্থানের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রচলিত কিংবদন্তিও দেবীর এই স্বরূপের কথা স্মরণ করায়। সেই কিংবদন্তি অনুসারে, পৌরাণিককালে এই পাহাড়েই নাকি দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। দেবীর মন্দিরের নিকটেই মহিষাসুরের একটি বেশ বড় মূর্তি নির্মাণ করে সেই বধের স্মৃতিকে পরবর্তীকালে মূর্তরূপ দেওয়া হয়েছে। মূর্তির মহিষাসুরের মুখে তেমন বীভৎসতা নেই, দেবীর কৃপায় তার নয়, তার দৈত্য-সত্তার মৃত্যু হয়েছে যেন। তাই এখানে এক হাতে সাপ, অন্য হাতে তরোয়াল নিয়ে দেবীর রক্ষকের ভূমিকায় প্রস্তুত হয়ে সে যেন দেবীর ভক্তজনকে স্বাগত জানানোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে।      

‘স্কন্দ পুরাণ’-এ ‘ত্রিমূতক্ষেত্র’ নামে এক পবিত্র তীর্থের উল্লেখ আছে; যে তীর্থ আটটি পাহাড়ে বেষ্টিত। পুরাণকথিত সেই পবিত্রস্থানই হল দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর এই আবাসস্থল। এখানে আটটি পাহাড়ের অন্যতম একটি পাহাড়ই হল আমাদের আলোচ্য, ‘চামুণ্ডা পাহাড়’। প্রাচীনকাল থেকেই এই পাহাড়ের প্রাকৃতিক শোভা অত্যন্ত মনোরম। দেবীর মন্দির এখনও অরণ্যবেষ্টিত। সেই অরণ্যে রয়েছে অসংখ্য সুন্দর সব প্রাচীন গাছ। সেখানে বাস করে হাজার রকমের নাম-না-জানা কাকলিমুখর পাখি। বাস করে কতশত অহিংস্র বন্যজন্তু। পাহাড়ের ঢালের অপরূপ রূপ তো আছেই, পাহাড়ের ঢাল থেকে নীচের দিকে তাকালেও অপূর্ব দৃশ্যাবলীর সাক্ষী হওয়া যায়। এখান থেকে দেখলে পাহাড়ের নীচে সমস্ত মহীশূর শহরকে যেন ইজেলে বসানো সুন্দর একটি ছবির মতো মনে হয়।

দেবীর মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার চারশো ঊন-আশি ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। মহীশূর শহর থেকে মন্দিরের পথে আসার সময় অনেক দূর থেকে তাই দেবীর মন্দিরটি দেখা যায়। আগে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে হাজারের বেশি সিঁড়ি অতিক্রম করে দেবীর মন্দিরে পৌঁছতে হত, এখন অবশ্য পাকা সড়ক মন্দির অব্দি পৌঁছে গেছে। পাহাড় বেয়ে ওঠার সময় মাঝপথে দেখা মেলে বিশাল পাথর কেটে নির্মিত এক নন্দীমূর্তির। সারা দেশের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় ও উঁচু নন্দীমূর্তি। মূর্তিটি পনেরো-ষোল ফুট উঁচু, পঁচিশ ফুট চওড়া। গলায়-পিঠে কণ্ঠিমালা-ঘণ্টার অপূর্ব কারুকাজ। সমগ্র মূর্তিটির নির্মাণে সেই সময়ের দ্রাবিড় ভাস্করের অসাধারণ শৈল্পিকনিপুণতা দু’চোখ ভরে দেখার মতো। মূর্তিটি সাদা পাথরে নির্মিত। কিন্তু ভক্তজন বছরের পর বছর ধরে প্রচলিত প্রথা অনুসারে নিয়মিত নন্দীর গায়ে তেল নিবেদন করেন, সেই দীর্ঘদিনের নিবেদিত তেলের প্রভাবে মূর্তিটিকে কালচে মনে হয়। নন্দীর নিকটে ছোট্ট একটি শিবের মন্দিরও রয়েছে।

আগেই বলেছি, দেবীর মন্দির তৈরির সুচনা হয় দ্বাদশ শতকে হয়শালা রাজবংশের আমলে। মন্দির নির্মাণ আরও কিছুটা অগ্রসর হয় বিজয়নগরের রাজাদের আমলে সতেরো শতকে। নির্মিত হয় মন্দিরে যাওয়ার হাজার সিঁড়ি। তারপর ছ’শো বছরের ইতিহাস পেরিয়ে কালের প্রহারে জীর্ণ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করান মহীশূরের অদেয়ার রাজবংশের রাজা তৃতীয় কৃষ্ণরাজা অদেয়ার। তিনিই ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে সাততলাবিশিষ্ট মন্দিরের সর্ববৃহৎ ‘গোপুরম’ অর্থাৎ প্রবেশ-তোরণটি নির্মাণ করান। তিনি দেবীর জন্য সিংহ-আকারের একটি রথ নির্মাণ করান। এখনও দেবীর বিশেষ উৎসব ও শোভাযাত্রায় সেই রথটিতে দেবী সওয়ার করেন।

মন্দিরক্ষেত্রটি চতুর্ভুজাকার। দুর্গের মতো সুউচ্চ প্রাকার দিয়ে ঘেরা। সমস্তই তৈরি হয়েছে দ্রাবিড়-স্থাপত্য রীতি মেনে। মন্দিরের গোপুরম পেরোলে নবরঙ্গগৃহ, অন্তরাল মণ্ডপে পৌঁছানো যায়। মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথ গোপুরম। সেটি অসাধারণ ভাস্কর্যমণ্ডিত। তাতে ঝাড়জাতীয় অলঙ্করণ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে পৌরাণিক কাহিনির নানান অনুষঙ্গও। সাততলার প্রতিটি তলার চারিদিকে দেবীর এক এক রূপের একাধিক মূর্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গোপুরমের মাথায় রয়েছে সাতটি স্বর্ণকলস। এখানকার দরজার ঠিক মাথায় গণপতির ছোট্ট মূর্তি আছে। সমস্ত বিপদ ও বিঘ্ননাশক হিসেবে ভক্তজনকে কৃপা করার জন্যই তিনি মন্দিরের এই প্রবেশপথে যেন রয়েছেন। দরজা-মোড়া রুপোর পাতে দেবীর নানান রূপের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অন্যান্য প্রবেশপথের দরজায় আঁকা রয়েছে দ্বাররক্ষকদের চিত্র। প্রধানপ্রবেশ পথ পেরিয়ে কিছুটা এগোলে পতাকাস্তম্ভের কাছেই দেবীর পদচিহ্ন রয়েছে, রয়েছে নন্দীর ছোট্ট এক মূর্তি। নন্দী মুখ ফিরিয়ে আছেন দেবীর গর্ভগৃহের দিকে।

গর্ভগৃহের মাথায় সুদৃশ্য চূড়া। গর্ভগৃহে অপূর্ব-সুন্দর রত্নময় সিংহাসন। সিংহাসনটি অসাধারণ-সুন্দর অলঙ্করণ দিয়ে সাজানো। এই আসনেই দেবী সমাসীন হয়ে রয়েছেন। দেবীর শিরে স্বর্ণময় মুকুট। দেবীমূর্তিও সমুজ্জ্বল ধাতু নির্মিত। মুখমণ্ডল ডিম্বাকার নয়, সামান্য চওড়া, কৌণিক আকৃতির। দুই চক্ষু বিস্ফারিত। দৃষ্টি সম্মুখে। তাতে ক্রোধ। দুই ভ্রু ধনুকের মতো বাঁকা। দেবীর নাক সামান্য চ্যাপ্টা। দুই ঠোঁট পুরু। তাঁর চোখে ক্রোধ বিচ্ছুরিত হলেও মুখে স্মিত প্রশান্তিও রয়েছে। সেই প্রশান্তি ভক্তজনের মনকে স্পর্শ করে, হৃদয়ে শান্তি দেয়। দেবীর দশ হাতে সর্প, আয়ুধ ও বরাভয়। অঙ্গে দুই রঙা সিল্কের বস্ত্র। কণ্ঠে নানান রকমের রত্নময় মালা। দেবীর আসন ও অঙ্গ নানান ফুলে এবং ফুলের মালায় সুসজ্জিত।

দেবী অসুরনাসিনী হয়ে সন্তানদের মঙ্গলসাধন করেছিলেন পৌরাণিককালে। দিয়েছিলেন শান্তির আশ্রয়। দেবীর মাহাত্ম্য মাথায় রেখে সেই আশ্রয়ের সন্ধানেই অসংখ্য ভক্তজনের নিত্য আগমন হয় এই মন্দিরে। তাঁদের বিশ্বাস, দেবী একদিন ঠিক সমস্ত ইচ্ছে, সমস্ত কামনা পূর্ণ করবেন। নিত্য পুজো, বিশেষ পুজোর পাশাপাশি এই মন্দিরে সারা বছরব্যাপী অনেকগুলো উৎসব হয়ে থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাঁক হয় তিনটি উৎসবে—‘নবরাত্রি’, ‘দশেরা’ এবং আষাঢ় মাসের ‘চামুণ্ডী জয়ন্তী’-তে। এই সময়গুলোতে নানান রঙের আলোয়-মালায় সেজে ওঠে সমস্ত মন্দির, মন্দির প্রাঙ্গণ, সমগ্র চামুণ্ডা পাহাড়। তখন সারা ভারতের লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগমে গম গম করতে থাকে এই বিখ্যাত শক্তিপীঠ তথা সতীপীঠ। চামুণ্ডী জয়ন্তী উৎসব মহীশূরের রাজপরিবার প্রাচীনকালে মন্দিরে নিজেরা উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করতেন, এখনও তাঁদের বংশধরেরা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। এই উৎসবে দেবী সুসজ্জিতা হয়ে সোনার পালকিতে চড়ে মন্দির প্রাঙ্গণ পরিক্রমা করেন, সকলকে দর্শন দেন অপরূপ এক লীলাময়ী রূপে, বর্ষণ করেন অফুরান সর্বব্যাপী কৃপা।... 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...