ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, "আমি জীবনে চার জন মানুষ দেখেছি তার মধ্যে একজন ছিলেন, প্যারীচরণ বাবু।"; সেই প্যারীচরণ সরকার ছিলেন ডেভিড হেয়ার সাহেবের প্রিয় ছাত্র। হেয়ার স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি যখন হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেন, ভালো ছাত্র হিসেবে অল্পদিনে সেখানকার ক্লাসেও দারুণ নাম করলেন। যদিও ক্লাস তিনি অধিকাংশ সময় ঢুলে ঢুলেই কাবার করতেন।
আসলে, এটা ছিল তাঁর একটা শারীরিক সমস্যা। খানিক টানা বসে থাকলেই তাঁর ঘুম পেত। সে-ঘুম এমন ঘুম যে, কিছুতেই দু'চোখের পাতা খুলে রাখতে পারতেন না। তবুও অবাক কথা যে, তাঁর 'ভালো ছাত্র'র সুনামে এরপরেও কিছুতে কালিমা জোটেনি! সে-নিয়ে অভাবনীয় বেশ কয়েকটি ঘটনাও আছে। তার মধ্য থেকেই একটি বলছি:
যে-সময়ের কথা বলছি, সে-সময় বড়লাটের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে। সেকালে এই শ্রেণির রাজপ্রতিনিধিরাই স্কুল-কলেজ পরিদর্শনে আসতেন।
সুতরাং, মেকলে একদিন হিন্দু কলেজ পরিদর্শনে এলেন। আর-সব ক্লাস পরিদর্শন সেরে প্যারীচরণ যে-ক্লাসে পড়েন, সেই ক্লাসে ঢুকলেন। সঙ্গে রইলেন পরিদর্শন-সহায়ক কলেজেরই এক শিক্ষিক।
ক্লাসে ঢুকে মেকলে শিক্ষা বিষয়ে ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিলেন। এবং, বক্তৃতা দিতে দিতেই হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল প্যারীচরণের ওপর। প্যারীচরণ তখন কষে ঢুলতে শুরু করেছেন। তাই দেখে মেকলে বেজায় বিরক্ত হলেন, কিন্তু হম্বিতম্বি করে সহসা সেটা প্রকাশ করলেন না। সেটা প্রকাশের জন্য আর-একটু সবুর করলেন। এবং, ছেলেদের প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।
তিনি এমন একখানা শক্ত প্রশ্ন করলেন যে, কেউই তার উত্তর দিতে পারল না। তিনি 'নেক্সট, নেক্সট!' বলে চললেন, আর প্রথম বেঞ্চ থেকে শুরু করে একে একে সকল ছেলেরা মাথা নীচু করে নিশ্চুপ উঠে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিতে লাগল যে, উত্তর জানা নেই। প্যারীচরণের পালা আসতেই মেকলে জলদ-গম্ভীর স্বরে হাঁক পাড়লেন, 'নেক্সট!' এবং আপন রাগ-বিরক্তি উজাড় করতে প্রস্তুত হলেন।
কিন্তু, প্যারীচরণ সেই অবসর মোটেই দিলেন না। তাঁকে অবাক করে ওই ঢুলু ঢুলু চোখেই উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রশ্নটির খুব সুন্দর করে গুছিয়ে উত্তর দিয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা দেখে মেকলে একইসঙ্গে খুশি ও অবাক হয়ে ভাবলেন যে, প্যারীচরণ ঢুলতে ঢুলতে প্রশ্নটি শুনলেন কখন! তারপর ব্যাপারটা অনুধাবন করে সঙ্গী শিক্ষককে বললেন, 'I see, this boy is like our Manchester weaver.' ('এই ছেলেটি দেখছি একেবারেই আমাদের ম্যানচেস্টারের তাঁতিদের মতন!') অর্থাৎ, ম্যানচেস্টারের তাঁতিরা ঘুমোতে ঘুমোতেও যেমন তাঁতে হাত চালিয়ে কাপড় বুনে যায়, এই ছেলেটিরও তেমনি দেখছি চোখে ঘুম থাকলেও মাথা প্রবলভাবে সজাগ রয়েছে!
এমন গল্প প্যারীচরণের জীবনে অনেক আছে। এমন বিরল মেধাবী প্যারীচরণ কালক্রমে শুধু যে জ্ঞানরাজ্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, এমন নয়। অপরে যাতে পণ্ডিত হয়ে উঠে প্রকৃত মানুষ হতে পারেন, সে-জন্য বিদ্যাসাগরের মতোই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
বারাসাতে শিক্ষকতা করতে গিয়ে প্রথমে 'বারাসাত স্কুল'-এর পরিকাঠামো তৈরি করেন। তারপর এই স্কুলেই কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য একটি শ্রেণি তৈরি করেন। ফলে তাঁরই প্রচেষ্টায় এই প্রথম বাংলা তথা দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষি বিষয় হিসেবে পরিগণিত হল এবং গুরুত্ব পেল।
এছাড়াও বয়স্ক ও বালিকাদের শিক্ষার উপযোগিতা উপলব্ধি করে শ্রমজীবীদের জন্য একখানা বিদ্যালয় এবং বালিকাদের জন্যও একখানা বিদ্যালয় তিনি স্থাপন করেন। তার জন্য বিদ্যাসাগরের মতোই তাঁকে কত যে সামাজিক বিরোধ, প্রতিরোধ, অন্ধবিশ্বাসের আগল ঠেলতে হয়েছে, ভাঙতে হয়েছে, উপেক্ষা করতে হয়েছে, সইতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তারই মাঝে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি যখন সার্থক হয়ে উঠল, তখন তা দেখে বেথুন সাহেব অনুপ্রাণিত হলেন এবং কলকাতায় 'বেথুন স্কুল' স্থাপন করলেন।
উনিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে 'স্কুল বুক সোসাইটি' প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী অর্থাৎ সহজ ভাষায় সুন্দর করে বর্ণ চেনানোর বই বাংলায় লিখতে অনুরোধ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে এবং ইংরেজিতে প্যারীচরণকে। তারই ফলস্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্র রচনা করলেন 'বর্ণ পরিচয়' এবং প্যারীচরণ রচনা করলেন 'ফার্স্ট বুক অব রিডিং'।
প্যারীচরণের বইটি 'ফার্স্ট বুক' নামে সাধারণের কাছে খ্যাতি পেয়ে পরবর্তী একশ বছর ধরে হয়ে রইল বাংলার শিশুদের ইংরেজি শিক্ষার প্রথম সোপান। বইটি প্রকাশের বিশ বছর পর 'স্কুল বুক রিভিজন কমিটি' বইটি সম্পর্কে লিখেছিল যে, "On the whole the best we have seen for the lower classes." সেই ইংরেজ অধ্যুষিত দেশে, ইংরেজ চালিত কমিটির এই উক্তি যে কতটা গৌরবের, সেটা উপলব্ধির বিষয়।
প্যারীচরণরা আধো আলো অনেক অন্ধকারের যুগে কীর্ণ স্বার্থের অনেক ঊর্ধে উঠে নিজের শ্রম ও সাধনা সমস্তই অত্যন্ত আন্তরিকভাবে নিয়োগ করেছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে, শিক্ষাকে তাঁদের কাছে পৌঁছে দিতে। তাঁরা মনীষী, তাঁরা জাগরণের প্রতিনিধি, জ্ঞানচর্চার প্রদীপ, এগিয়ে চলার মশাল; তাঁরা ছিলেন, তাই আমরা আছি। তাঁরা থাকলে, আমরাও থাকব। কেননা, তাঁদের তৈরি পথ আজও দেখায় উত্তরণের আলো...