নদীর নামে নাম, কাবেরী। সে শুধু মিলনের অনুরোধে। কারণ, তাঁর আগের বোনেদের-যমুনা, জাহ্নবী, সরস্বতী--সবারই ছিল নদীর নামে নাম। তবে, আগের বোনেদের মতো তাঁর গায়ের রঙ একেবারেই ফর্সা ছিল না। জন্মের পরই শ্যামাঙ্গী মেয়েকে দেখে বাবা আঁতকে উঠেছিলেন। সময়ের প্রবণতায় তিনি শুধু মেয়ের গায়ের রঙই দেখেছিলেন, নাম রেখেছিলেন, ভুতু। সে-হয়েছিল কাবেরীর ডাকনাম।
কালো মেয়ে কৃষ্ণকলি। নাচতে ভালোবাসেন।রবীন্দ্রনাথ তাই কাবেরীর আপন হয়েছিলেন নাচের মধ্য দিয়ে। সেই নাচের সূত্রেই তাঁর সুযোগ ঘটে সিনেমায় আসার।
তখন কাবেরীর বয়স সবে পনের। মঞ্চে 'শ্যামা' নৃত্যনাট্যে তাঁর অনবদ্য নাচ দেখলেন চিত্রপরিচালক সুবোধ মিত্র। মুগ্ধ হলেন।
সুবোধ তখন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'রাইকমল' গল্প নিয়ে ছবি করার তোড়জোড় করছিলেন। নায়িকা চরিত্রের জন্য খুঁজছিলেন কমবয়সী, ব্যক্তিত্বময়ী, নাচতে জানা একটি নতুন মেয়ে। কাবেরীর মধ্যে তাকে খুঁজে পেলেন। বাবা কেবল মেয়ের গায়ের রঙ দেখেছিলেন, সুবোধ দেখলেন তাঁর চোখ। দেখলেন ডাগর চোখের দুর্বার টান, পড়লেন ব্যক্তিত্বের আখর।
সুবোধ মিত্র আর দেরি করলেন না। হানা দিলেন কাবেরীদের বাড়িতে। কাবেরীর দাদা গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু প্রযোজনাসূত্রে সিনেমা-জগতের সঙ্গে জড়িত এবং সাহিত্যসূত্রে সাহিত্য-জগতের সঙ্গে জড়িত। তাঁর লেখা অনেকগুলো গল্পের বই-ই ইতিমধ্যে প্রকাশিত।
যাই হোক, গৌরাঙ্গপ্রাসাদের কাছে হত্যে দিলেও সুবোধ মিত্রের প্রস্তাবে বাবা বেঁকে বসলেন। তিনি রক্ষণশীল মানুষ।
সিনেমা তখনও সাবেক মানুষের কাছে বায়োস্কোপ।ছেলে বায়োস্কোপের সঙ্গে জড়িত বটে, বাড়িতে হামেশাই বায়োস্কোপের লোকজন আসেন বটে, কিন্তু বায়োস্কোপের জগৎটা সম্পর্কে তাঁর ধারণা মোটেই উঁচু নয়। তাই মেয়ে বায়োস্কোপে নামবে, এ তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারবেন না! বাড়ির মেয়েদের এতদিন 'হল'-এ গিয়ে বায়োস্কোপ দেখতেই দেননি, তায় আবার অভিনয়! অসম্ভব!
ওদিকে সুবোধও নাছোড়বান্দা। কাবেরীর মধ্যে তিনি যে তাঁর কল্পনার নায়িকাকে দেখে ফেলেছেন। কাবেরীকে তাঁর চাই-ই-চাই। নইলে, ছবিই হবে না! শেষমেশ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাবাকে নিমরাজি করাতে পারলেন গৌরাঙ্গ।
এবার কাবেরী। তিনি স্বভাব সপ্রতিভ। এক পায়ে রাজি। অভিনয় আর এমন কী, নাচে কি অভিনয় করতে হয় না?
সেকালের সফল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মঞ্চের প্রেক্ষাপট থাকত। কাবেরীর ছিল না। মঞ্চ-নাটকে অভিনয় কোনকালেই করেননি। সিনেমাও সেভাবে দেখেননি। কিন্তু, উত্তম কুমারের বিপরীতে প্রথম ছবিতেই তিনি যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ও দাপটের সঙ্গে স্বাভাবিক অভিনয় করলেন, তাতে অবাক এবং মুগ্ধ হয়ে গেলেন সকলেই। বুঝলেন, এ-মেয়ের সহজাত প্রতিভা আছে, জয় করে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা আছে।
১৯৫৫ সালের ৮ মার্চ মুক্তি পেল, 'রাইকমল'। 'পূর্ণ' ও 'দর্পনা' প্রেক্ষাগৃহে। যেমন ভাবা গিয়েছিল, তাই হল। উত্তম কুমারের পাশাপাশি তাঁর অসামান্য অভিনয় দেখে চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। শুরু হল নায়িকা কাবেরীর জয়যাত্রা।
সেই জয়যাত্রার মাঝে সংসার, দুর্ঘটনা, দীর্ঘ অসুস্থতা প্রভৃতির কারণে অভিনয় জীবনে পড়ল দীর্ঘ দীর্ঘ ছেদ। তারই মধ্যে একে একে অভিনয় করলেন, 'দৃষ্টি', 'অসমাপ্ত', পরাধীন', 'শ্যামলী', 'শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক', 'মধুমালতী', 'আমি সে ও সখা', 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ও 'নগর দর্পণে'।
অসাধারণ সুন্দরী, অসম্ভব ফর্সা না-হয়েও শুধুমাত্র অভিনয় প্রতিভার জোরে নায়িকা হওয়া যায়, স্মরণীয় হওয়া যায় এবং সামান্য কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেও নিজের একটি জায়গা করে নেওয়া যায়--এটা কাবেরী বসু প্রমাণ করে গেছেন।