ক্যামেরাই যখন কাস্তে..

নন্নামালা বনাঞ্চলের একদম কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত চেঞ্চু উপজাতির ছোট একটি গ্রাম, 'আপ্পাপুর পেন্টা'। যেখানে দলিত শ্রেণী, শ্রমিক, দিন-মজুরদের বসবাস। আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী সেই গ্রামেরই কয়েকজন মহিলা সেখানে সর্বক্ষণ ব্যস্ত একটি ক্যামেরা নিয়ে। না। সেলফি বা অন্য কোনো অজুহাতে নয়।

একটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে তাঁরা তাঁদের সহকর্মীদের ক্রমাগত ‘শ্যুট’ করছেন, যাঁরা কৃষকদের এবং কৃষিকাজ সম্পর্কে অনবরত ব্যাখা দিচ্ছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার একটা নতুন দিক আর পাঁচজন কৃষকের ভাবনার আওতায় নিয়ে আসাই যাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। সেখানকার গ্রাম্য জীবন জীবিকার অধিকাংশই মূলত কৃষি নির্ভর। জাতিগত ভিত্তিতে তাঁদের মধ্যে অনেকেই দলিত শ্রেনীর প্রতিনিধি হলেও, এখন হাজার হাজার মহিলাদের অনুপ্রেরণা হয়ে ভালো কাজ করবার ইন্ধন জোগাচ্ছেন এই গ্রামেরই কয়েকজন মহিলা কৃষক। যা দেখে রীতিমতো হতবাক গ্রামের বাসিন্দারাই। তাঁরা বলছেন, এই ঘটনা এখানে প্রথমবার। এই ঘটনায় তাঁরা প্রত্যেকেই যেমন বিস্মিত এবং একইসঙ্গে অনুপ্রাণিত।

হুম্নাপুরের লক্সমাম্মা বি, ইপাল্লাপল্লীর মোল্লামা এবং সাঙ্গারেড্ডির ঝরাসংগামের চন্দ্রাম্মা মনিগরিতিনজনই দলিত মহিলা কৃষক। দলিত সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ জন মহিলা এখানে কমিউনিটি মিডিয়া স্টেশনের অংশ। যাঁদের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেক অংশ সক্রিয়ভাবে জমিতে কি ঘটছে তা নথিবদ্ধ করার কাজ করছেন এবং বাকিরা সক্রিয়তার সঙ্গে আবাদাধীন ফসলের বিষয়ে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন।

বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা সত্বেও এই তিনজন মহিলা এখানে তাঁদের কাজে সবসময় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য হাতে প্রথমে কাস্তে তুলে নিলেও সময়ের হাত ধরে তাঁদেরই হাতে এখন উঠে এসেছে ভিডিও ক্যামেরা। টেকনোলজির সম্প্রসারণ প্রভাব ফেলেছে তাঁদের উপরেও। তাই ভয় কাটিয়ে তাঁরা স্বীকার করে নিচ্ছেন প্রযুক্তির এই আবিস্কারকে।

কিভাবে এটাকে সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করার পরই এসেছে এমন সাফল্য। এলাকার যাবতীয় কৃষিকাজের তথ্যসূত্রে লিপিবদ্ধ সেই ভিডিও দেখে উপকৃত হচ্ছেন একাধিক কৃষক। যাঁরা কৃষিকাজ সম্পর্কে নিজেদের দিশা হারিয়েছিলেন, এখন পথ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। এই মহিলারা বর্তমানে সাঙ্গারেড্ডির পাস্তাপুরের কমিউনিটি মিডিয়া ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত যা মূলত ডেকান ডেভলপমেন্ট সোসাইটি(ডিডিএস) ভিত্তিক। উল্লেখ্য, এই ডিডিএস বিগত ৩০ বছর ধরে দলিত ও অন্যান্য প্রান্তিক শ্রেণীর মহিলা কৃষকদের স্বয়ংশাসিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রমাগত কাজ করে চলেছেন।

মহিলারা একে অপরের সমস্যা বুঝতে ও সমাধানের লক্ষ্যে কাজের সহায়তা করবার জন্য প্রথম ‘সনগাম’ (কালেক্টিভস) গঠন করেন। এনজিও'টি এই মুহূর্তে ৭৫টির'ও অধিক গ্রামীণ মহিলা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছে।

লক্সমাম্মা, যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর ক্যামেরাটি পরিচালনা করছেন, বলছেন..

"আমরা এখানে আখরোট, লাল ছোলা ও শিম চাষ করবার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। আর আমাদের সহকর্মীদের কৃষিকাজের স্বাস্থ্যকর ও স্বনির্ভর পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।"

ডিডিএসের সাথে যুক্ত হওয়ার আগে লক্সমাম্মা এলাকার অধিকাংশ মহিলাদের মতোই দিন মজুর ছিলেন। সম্প্রতি একটি প্রকল্পের জন্য মালদ্বীপেও ভ্রমণ করেছেন তিনি। ডিডিএসের তথ্য অনুসারে কর্মসূত্রে তিনি ১৫টিরও বেশি দেশে ভ্রমণ করেছেন।

এইধরনের ভিডিও বানাবার পিছনে ঠিক কি উদ্দেশ্য রয়েছে তা জানতে চাওয়া হলে তিনি যোগ করেন,

"কৃষকেরা, যাঁরা কম বেশি অনেকেই প্রশিক্ষণহীন বা শিক্ষার বাইরে ছিল, তাঁরা খুব সহজেই এখন এই ভিডিওগুলো দেখে কৃষিকাজ শিখে নিতে পারছে। তো, আমাদের মনে হয়েছিল বীজ বপন থেকে ফলন সংগ্রহ পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি রেকর্ড করা গেলে সেটা একটা কৃষিবিষয়ক দুর্দান্ত রিসোর্স অথবা তথ্যচিত্র হতে পারে।"

চন্দ্রাম্মা, একজন উৎসাহী চলচ্চিত্র নির্মাতা-প্রতিবেদক, যিনি শ্যুটের ক্ষেত্রে কখনো একটা সুযোগও নষ্ট হতে দেন না। যা কিছু তাঁদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই শ্যুট করেন। তিনি বলছেন,

"আমরা বিভিন্ন জায়গায় যাই তার কারণ আমরা এই দক্ষতা অর্জন করেছি। নইলে আমাদের পরিস্থিতি ঠিক ৩০ বছর আগের মতোই হতো। সম্প্রতি আমরা একটা ‘ভিডিও ডায়েরি’ শুরু করেছি। এবং ইউটিউবে সেই সমস্ত ভিডিও আপলোড হচ্ছে।"

শুধু তাই নয়। কমিউনিটি মিডিয়া ট্রাস্টের এই মহিলা সাংবাদিকেরা কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানেও শ্যুট করে থাকেন। ‘পথ পান্তলা যাত্রা’ ( পুরোনো ফসলের উৎসব ) এবং ‘ইরুভাকা পান্ডুগা’ ( বর্ষার শুরু ) হলো উৎসবের মরসুম যখন লক্সমাম্মা ও তার সহকর্মীরা শ্যুটিংয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকেন।

অন্য আরো একজন কৃষক-চলচ্চিত্র নির্মাতা মোল্লামার কথায়, "সিনেমাটোগ্রাফির কৌশলগুলো রপ্ত করার পর মানুষের কাছ থেকে আমরা অনেক শ্রদ্ধা অর্জন করেছি। আগে আমরাও অন্যান্য কৃষক বা মজুরদের মতো দৈনিক শ্রমিক ছিলাম। তবে এখন আমরা সময়ের সাথে সাথে পেশাদার সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। যখন আমরা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াই, লোকজন অবাক হয়ে আমাদের দিকে দেখে।"

ক্যামেরাটিকে অন্য একটি কোণে ঘুরিয়ে নিয়ে মোল্লামা যোগ করেন, "খুব সহজে হয়নি। এটার জন্য বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছিল আমাদের। আর এখন আমরা ধীরে ধীরে এটাকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে পেরেছি।"

২০০১ সালে সাংগমের মহিলারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁদের নিজেদের মিডিয়া সেন্টার চালানোর জন্য একটা ভাবনা নিয়ে ডিডিএসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই থেকে তাঁদের এই দীর্ঘ যাত্রা এখনও পর্যন্ত অসংখ্য মহিলাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। নতুন ভাবে ভাবাচ্ছে। শিক্ষিত করে তুলছে শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের। গ্রামের মানুষদের কাছে তাঁদের দৃঢ় অঙ্গীকার, এই কাজ তারা থামাতে চান না কখনও। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...