“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়”.... বর্তমানে দেশ তথা বিশ্বের কাছে এই কথাগুলির গুরুত্ব অপরিসীম| সবাই স্বাধীনতা পেতে চায়| আসলে, সদ্য গতকাল আমরা পালন করলাম আমাদের দেশের ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস| যারপরনাই মহা সমারহে উদযাপিত হয়েছে এই বিশেষ দিনটি| অফিস ছুটি ছিল, তাই বাড়িতে কিছু ভাবনা-চিন্তা মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল| আসলে স্বাধীনতার মানে ঠিক কী?
একটু ভাবি নিজের মত করে যে স্বাধীনতা বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি? নিজের মত করে চলা-তাই তো? সে দেশ হোক বা রাষ্ট্র হোক, রাজ্য হোক, কোনো প্রতিষ্ঠান হোক, সমাজ হোক বা সম্পূর্ণ নিজেরা অর্থাৎ আমি-আপনি, আমরা সবাই| সবকিছুর মধ্যে স্বাধীন মানসিকতা থাকবে| তো এই দেশ, রাষ্ট্র, রাজ্য, সমাজ, প্রতিষ্ঠান তো নিশ্চয়ই নিজে নিজে গড়ে ওঠেনা, এগুলি আমরা অর্থাৎ মানুষেরাই গঠন করি| কোনো স্থলভূমি বা জলভূমি বা মরু অঞ্চল বা পাহাড়ি অঞ্চল এগুলি প্রকৃতির দান, কিন্তু যখনই তা সামাজিক গঠন পাচ্ছে, তখনই তা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হচ্ছে, বলা ভালো আবিস্কৃত বলেই তার একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব তৈরী হচ্ছে| পাশাপাশি মানুষ উপরিউক্ত জায়গা গুলিতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সুগঠিত ভাবে চলার জন্য বিভিন্ন সামাজিক বিভাগ সৃষ্টি করেছে|
এইভাবেই আস্তে আস্তে তৈরী হয়েছে, একে অপরের প্রতি আধিপত্য তৈরির চেষ্টা| প্রথমে গঠিত হয়েছে দল, তারপর তারা নিজেদের সুবিধার্থে গঠন করেছে বিভিন্ন নিয়মাবলী| একটি দল কিছু ছন্নছাড়া মানুষকে নিয়ে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করেছে| এবারে ধীরে ধীরে দল বেড়েছে| একেবারে শুরুতে যারা ছিল, তারা নতুন আসা মানুষজনের ওপর তাদের অধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করেছে| কিছুদিন হয়ত সব নিয়ম মেনেই চলছিল, কিন্তু দেখা গেছে দিন যেতে যেতে সেই দলের মধ্যে থেকেই কেউ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে| সে আবার নিজের দল ভারী করেছে, কিছু লোকজন জোগাড় করেছে দল ভারী করার জন্য| বেরিয়ে এসেছে মূল দল থেকে| এখানেই আসল প্রশ্ন| এই যে পরবর্তী দলটি বেরিয়ে এলো, তারা তো নিজেদের সংঘবদ্ধ করার জন্য সেই আগের দলের কিছু নিয়ম কানুন রাখবেই| এটা হতে বাধ্য| এমনটা কখনও কোথাও দেখা যায়নি, সম্পূর্ণ নতুন কোনো পদ্ধতিতে কেউ নিজেদের গড়ে তুলেছে| তাহলে সেই নতুন দলটি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন কী হল? এই সিস্টেম কিন্তু চলে আছে সেই আদিম যুগ থেকে| গোটা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশ| প্রথম দিকে অর্থাৎ প্রাচীনকালে আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল অধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এবং নতুন দেশ আবিস্কারের নেশা| ছিল ক্রীতদাস প্রথা| এই যে ক্রীতদাস একটা শ্রেণী তৈরী হল, তারাও কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল| আমাদের ‘দাস বংশ’ বা ‘দাস সাম্রাজ্য’ তার মস্ত বড় উদাহরণ| কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয়, তারাও কিন্তু তাদের প্রভুদের সৃষ্টি করা নিয়ম-কানুন সম্পূর্ণ রূপে বর্জন করেনি| কুতুব-উদ-দিন আইবক যেভাবে সাম্রাজ্য চালিয়েছিলেন, ইলতুতমিস সেই ধারা বজায় রেখেই নিজ বুদ্ধিবলে নতুন শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন| এটা শুধুমাত্র উদাহরণ| আমার এই উদাহরণ উল্লেখ করার উদ্যেশ্যই হল, কিছু পূর্বের ব্যবস্থা নিয়েই আমরা তার সঙ্গে নিজেদের ভাবনা চিন্তা মিশিয়ে নিজেদের পথ চলার কৌশল তৈরী করি|
তাহলে ভাবনার স্বাধীনতা সম্পুর্ন থাকল কী? আমি বলব থাকল| কারন পূর্বসূরীর ঠিক কী কী আমি গ্রহণ করব, আর কী কী আমি গ্রহণ করব না, তা স্থির করছি আমিই| এখানেও কথা আছে| নতুন ভাবনা যখন গঠনমূলক হচ্ছে, তখন সেটা আমরা বলব স্বাধীনতা| কিন্তু ভাবনা যখন ধ্বংসাত্মক হচ্ছে, তখন কিন্তু আমরা বলব সেটা হয়ে যাচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতা| স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার এই সুক্ষ্ম প্রভেদ বোঝাটাই হল সঠিক শিক্ষার বিষয়| এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে মোঘল যুগের ঔরঙ্গজেব কে| উনি আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতিকে আপন করে নিয়েছিলেন কিন্তু হিন্দুদের গুরুত্ব দেওয়াকে বর্জন করেছিলেন| ফলে ধর্মপ্রাণ সম্রাট তাঁর ধর্মীয় নীতির জন্যই হিন্দুদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন এবং বিশাল সাম্রাজ্য সামলাতে পারেননি| মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে তাঁর ধর্মীয় নীতিকে অনেকখানি দায়ী করা হয়| এইবারে আমরা যদি সমকালীন পরিস্থিতির কথা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব, মুসলিম সাম্রাজ্যের, বলা ভাল মোঘল সাম্রাজ্যের শেষের দিকেই ব্রিটিশরা এসেছিল বাণিজ্য করতে| খুব ভাল করে আমরা দেখব, ব্রিটিশরা কিন্তু শুরুতে আমাদের আক্রমণ করেনি| এখানে এসে বাণিজ্য করতে গিয়ে তারা দেখল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কোনো একতা নেই| তারা সেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায়নি| আমরা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব, সে দিল্লির শাসকই বলুন বা দক্ষিনের শাসক বা উত্তর অথবা আমাদের পূর্ব ভারত- কোথাও সেই সময় ঐক্যবদ্ধ শাসনব্যবস্থা ছিলনা| প্রাদেশিক রাজারা প্রায় সকলেই ছিলেন সুযোগ সন্ধানী| ইংরেজদের তোষামোদ করে দিন কাটিয়ে দেওয়াকেই তারা লক্ষ্য করে নিয়েছিলেন| স্বার্থান্বেষী মনোভাব তাদের মধ্যে বেশি কাজ করেছিল| সেখান থেকেই জন্ম নিল ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের পথ| ভারতের তত্কালীন শাসকদের তুলনায় ব্রিটিশরা ছিল যথেষ্ট উন্নত প্রযুক্তি এবং উন্নত শাসনব্যবস্থার অধিকারী| বিচ্ছিন্ন শাসন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা ভারতে আধিপত্য বিস্তার করল|
পরবর্তিতে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের দেশের স্বাধীন শাসকরাও কিন্তু ব্রিটিশদের তৈরী করে যাওয়া শাসনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই ভারতের শাসনতন্ত্র গঠন করলেন| এইবারে বলার বিষয় হল, ভারতের সংবিধান প্রণেতারা গঠনমূলক পরিবর্তন করেছিলেন| ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীনতা এবং করণীয় কর্তব্য পরিস্কার করে লেখা আছে| বুকে হাত রেখে আমরা কী বলতে পারব, আমরা আমাদের কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে যেভাবে দেখি, সেভাবে কী করণীয় কর্তব্যকে আদৌ দেখি? রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্য পালনে যদি খামতি থাকে, তাহলে স্বাধীনতার পূর্ণ ব্যবহারের কী আমরা আদৌ যোগ্য? প্রশ্নগুলো কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ| কারণ আজকের এই সমাজের অবক্ষয়ের পেছনে এটাই মূল কারণ| এই স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি যে কর্তব্য পালন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তা আমরা ৯৯% মানুষই খতিয়ে দেখিনা| ফলস্বরূপ আমরা সমানে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছি| বাক স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা সব আমরা আজকাল ব্যবহার করছি নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গিতে| তার ফলে সমাজে আজ চূড়ান্ত অরাজকতা| আমরা এটাকেই স্বাধীনতার ব্যবহারিক দিক হিসেবে দেখছি| নিজেদের কাজে কর্মে, কথা বার্তায়, চাল চলনে রাশ টানতে ভুলে যাচ্ছি| রাশ টানা মানে ঘরের কোনায় বসে থাকা বা প্রতিটা ব্যাপারে চুপ করে থাকা মোটেও নয়| রাশ টানার অর্থ হল, পরিস্থিতি বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা| উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যে কথা আমি বন্ধুদের সঙ্গে খুব সহজেই বলতে পারব, সে কথা আমি গুরুজনদের আমনে বলতে গেলে একটু পরিমার্জিত করে বলা উচিত| সেটা এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা মানছেনা| পাশাপাশি সমাজের যারা অভিজ্ঞ, তারা নিজেদের মধ্যে যে কথা বলতে পারে, সেই কথা তুলনায় কমবয়সীদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় সুক্ষ্ম বিচারবোধ করছেনা| তাই পুরো সিস্টেমটাই তালগোল পাকিয়ে গেছে স্বাধীনতার চক্করে পড়ে|
এই স্বাধীনতার আসল সংজ্ঞা নিরূপন করার আজ বড্ড প্রয়োজন| সকলে মিলে শুরু না করলে তা কিন্তু সঠিক রূপ পাবেনা| আর অবশ্যই প্রয়োজন নিজেদের কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সচেতন থেকে সেগুলো যথাযথভাবে পালন করা| তবেই স্বাধীনতার আসল আস্বাদ গ্রহণ করতে পারব আমরা|