বাঙালি ভোজন রসিক তা কারোর অজানা নয় - আর এই ঐতিহ্য বহুদিন আগে থেকেই সে বয়ে চলেছে| সেই রসনার সম্পূর্ণতা ঘটে শেষ পাতে মিষ্টি দিয়ে। স্বাস্থ্য সচেনতা, ডায়েট এসব আনুষাঙ্গিক বিষয় থাকলেও আজও কিন্তু সেই ধারা অব্যাহত - না হলে রেস্টুরেন্ট এবং মিষ্টির দোকানগুলো ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেত না। যাই হোক আজ গল্প হবে এক বিশেষ ধরণের মিষ্টির জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে, যার জনপ্রিয়তা কিন্তু আজও সমান ভাবে বিদ্যমান। এমনকি সৃষ্টিকর্তার নব প্রজন্ম স্বমহিমায় সেই রাজ্যপাট সামলাচ্ছে।
এমন অনেক খাবার আছে যার সাথে পরিচয় ঘটে জিভ দিয়ে। ঠিক তেমন হলো আজকের আলোচ্য মিষ্টি কড়াপাকের জলভরা তালশাঁস। এর এক ভারী সুন্দর ছদ্ম নাম আছে যা হয়তো অনেকের অজানা, তা হলো ‘জামাই ঠকানো মিষ্টি’। আর সত্যি বলতে সেই উদ্দেশ্যেই কিন্তু এর জন্ম মানে জামাই ষষ্ঠীতে জামাই ঠকানোর জন্য। অবাক লাগলেও বিষয়টা কিন্তু তেমন। এবার আসি সেই জন্ম বৃত্তান্তে। হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরের তেলেনীপাড়ায় ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমিদার বাড়ি। সালটা ১৮১৮ । প্রথম জামাই আসবে জমিদার শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে। জমিদার বাড়ির অন্দরমহল থেকে দাবি উঠলো জামাইষষ্ঠীতে তৈরী করতে হবে এমন মিষ্টি যা হবে অভিনব এবং জামাই ঠকানো। এককথায় এমন এক মিষ্টি বানাতে হবে , যা খেতে গিয়ে জামাই যেন এক্কেবারে বেকুব বনে যায়। আর নিখুঁতভাবে সেই দায়িত্ত্ব পালনে ডাক পড়লো ময়রা সূর্যকুমার মোদকের।
অবশ্য জমিদার গিন্নি নিজেই কিছুটা বুদ্ধি দিলেন ময়রাকে।কিন্তু ওই সন্দেশ বানানো খুব সহজ নয়।সারা রাত ভেবে মোদক মশাই ছুতোরকে দিয়ে বানালেন ছাঁচ। শুরু হলো প্রয়াস। মূল উপাদান ছিল ছানা ও নলেন গুড় (এখন অবশ্য চিনি দিয়েও বানানো হয়) আর গোলাপজল। শোনা যায় সেই গোলাপজল নাকি কনৌজ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। ছাঁচের তৈরী ওই কড়াপাকের সন্দেশ তৈরির পদ্ধতিটি ছিল দেখবার মতো। প্রথমে ছাঁচের মধ্যে কিছুটা সন্দেশ দেওয়া হলো তারপর আঙুলের চাপে গর্ত করে নিয়ে সেই গর্তে চামচে করে দেওয়া হলো গোলাপজল। এর পর আবার সন্দেশ দিয়ে বাকিটা সিল করে ছাঁচের মুখ বন্ধ করে দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল জলভরা তালশাঁস সন্দেশ।
তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ - জামাইষষ্ঠীর দিন জমিদার জামাইয়ের পাত আলো করে এলো প্রকান্ড এক কড়াপাকের তালশাঁস সন্দেশ। আর জামাই সেই সন্দেশে কামড় বসাতেই ঘটলো সেই কাঙ্খিত ঘটনা। সন্দেশের ভিতর থেকে গোলাপজল আর নলেন গুড় ছিটকে পড়ল জামাইয়ের নতুন গরদের পাঞ্জাবীতে। এক্কেবারে মাখামাখি কান্ড। তা দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি -ঠকল জামাই আর জন্ম হলো বিখ্যাত জলভরা সন্দেশের ।
আজ ভদ্রেশ্বরে এর স্রষ্টার দোকানটি বহাল তবিয়তে বিদ্যমান, শুধু তাই নয় সবচেয়ে ব্যস্ততম দোকান এবং সূর্যকুমার মোদকের পঞ্চম প্রজন্ম সেই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে। যদিও এর অনবদ্য স্বাদ ও চাহিদা কিন্তু কলকাতার মিষ্টিপ্রেমীদের পিছনে ফেলতে পারবে না। শীতকালে চিনি বা গোলাপজল নয় নলেন গুড় দিয়ে তৈরী সেই জলভরা স্বাদ যেন অমৃতের মত। সে যতই ডায়েট করুন আর স্বাস্থ্য সচেতন হন না কেন এই জলভরা না খেলে কলকাতার ভোজনরসিককুল আপনাকে ব্রাত্য করে দিতেই পারে। তাই শীত আসছে না খেলে অবশ্যই খাবেন- ঠকবেন না , আর যারা খান তারা অপেক্ষা করুন, নলেন গুড়ের স্বাদে সে ধরা দিলো বলে!