ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে স্থলপদ্ম গাছে সারাবছর প্রচুর ফুল ফোটানোর উপায়

স্থলপদ্ম অতীব জনপ্রিয় একটি ফুল। দিনে তিন থেকে চারবার এই ফুল রঙ পরিবর্তন করে। সকালে সাদা, দুপুরে সাদা-গোলাপি ছোপ ছোপ, বিকেলে হালকা গোলাপি, সন্ধ্যের আগে গাঢ় গোলাপি। রঙ পরিবর্তনের এই আশ্চর্য খেলার জন্যই এই ফুল সকলের এত প্রিয়। পাপড়ির দিক থেকে স্থলপদ্ম দু’রকমের হয়ে থাকে। সিঙ্গল পেটাল এবং ডাবল পেটাল বা থোকা। তবে এই দুই প্রজাতির মধ্যে বিশেষ সৌন্দর্যের জন্য থোকা স্থলপদ্মই সকল শখের বাগানি বেশি পছন্দ করেন। অনেকে আবার ভালোবেসে ‘বিশেষ সংগ্রহ’ হিসেবে দুটো জাতই তাঁদের বাগানে সযত্নে স্থান দেন। তবে দুই জাতের ফুলের গাছ কিন্তু দেখতে একই রকম, তাদের পরিচর্যাও এক এবং সবচেয়ে বড় কথা দুটো জাতই সারা বছর ফুল দেয়। আর এই দুটো জাতই ছাদ বা ব্যালকনিবাগানের টবে খুব সুন্দরভাবে চাষ করা যায়।

মাটিতে স্থলপদ্ম গাছ করলে এমনিতেই প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। কিন্তু টবে এই গাছ করলে কিছু সহজ অথচ ‘বিশেষ’ পরিচর্যা চালিয়ে গেলে তবেই একটি গাছ থেকে সারা বছর ধরে প্রচুর ফুল আদায় করে নেওয়া সম্ভব হয়। এবার সেই ‘বিশেষ পরিচর্যা’গুলো কী এবং সেগুলো কীভাবেই বা করতে হয়—সেগুলোই পয়েন্ট ধরে ধরে আলোচনা করছিঃ

প্রথমবার গাছ বসানোর জন্য কেমন চারা আনবেন?

নার্সারি বা পাড়ার গাছওয়ালার কাছ থেকে যখন চারা নেবেন, তখন কয়েকটা ব্যাপার অবশ্যই খেয়াল রাখবেনঃ

গাছটি যেন বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও সতেজ হয়। সেটি যেন এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতার গাছ হয়। গাছে যেন কমপক্ষে তিন বা চারটি ডাল থাকে। ডালগুলোর প্রত্যেকটির মাথায় যেন সবুজ আভা ও কচি পাতা থাকে। ডালছাড়া একাই তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে, চেষ্টা করবেন তেমন গাছ না-নিতে। কারণ, ঐ গাছ টবে প্রতিস্থাপনের পর কাটাই-ছাঁটাই করে সঠিক শেপ দিয়ে ঝাঁকড়া করে ফুল পেতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। যাই হোক, গাছ এনে তাকে আগে বাড়ির আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে দিন-সাতেক সময় দেবেন, তারপর টবে প্রতিস্থাপন করবেন। 

উপযুক্ত মাটি কীভাবে তৈরি করবেন?

স্থলপদ্ম হালকা মাটি পছন্দ করে। শেকড়ের কাছাকাছি মাটির হালকা ভেজা ভেজা ভাবও তার খুব পছন্দের। কিন্তু গোড়ায় জল জমা সে একদম পছন্দ করে না। কোকোপিটযুক্ত জৈবসারসমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি তাই তার জন্য একেবারে আদর্শ। এই ধরণের মাটি তৈরি করতে দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, এক ভাগ সাদা মিহি বালি, এক ভাগ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং বাকি আধ-ভাগ কোকোপিট একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নেবেন (বাড়িতে পুরনো দোআঁশ মাটি থাকলে তার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বালি এবং আগের বলা পরিমাণে কোকোপিট ও জৈবসার মিশিয়ে নিলেই হবে)। তারপর এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে দেড় চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড, এক চামচ নিমখোল, এক চামচ হাড়গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নিলেই স্থলপদ্মের জন্য এক্কেবারে আদর্শ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রিপটিং-এর জন্য ব্যবহার করবেন।

কেমন টবে, কীভাবে চারা বসাবেন?

স্থলপদ্মের চারা বছরের যে-কোন সময়ই বসানো যায়। এই গাছ শেকড় ছড়ায় খুব দ্রুত এবং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী গাছ; তাই খুব ছোট টবে একে বসালে অল্পদিনেই শেকড় মাটির ওপরে উঠে এসে রিপটিং-এর বার্তা দেবে এবং বাড়-বৃদ্ধিও সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে দেবে। এই জন্য প্রথমেই একে দশ ইঞ্চি টবে বসানো ভালো। ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবের আশিভাগ আদর্শ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তাতে হাফ চামচ এপসম সল্ট সম্ভব হলে ছড়িয়ে দেবেন (সম্ভব না-হলে দরকার নেই), তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দেবেন।

কেমন রোদে রাখবেন? জল ও অন্যান্য খাবার কী পরিমাণ দেবেন?

রোদঃ স্থলপদ্ম রোদ ভালোবাসে। ডিরেক্ট সানলাইট চার-পাঁচ ঘন্টা পেলেই এই গাছ আনন্দের সঙ্গে ফুল দিয়ে থাকে। এর চেয়ে কম ডিরেক্ট সানলাইট হলে ভালো ফুল হয় না, এর চেয়ে বেশি তার প্রয়োজন হয় না। তবে অতিরিক্ত রোদেও এর ফুল দিতে কোন অসুবিধে হয় না। কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মে ডিরেক্টের পরিবর্তে এই গাছ যদি আলোছায়ামাখা ছ’-সাত ঘন্টা রোদ পায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ফুল দেয়।  

জলঃ টবের ওপরের মাটি প্রায় শুকিয়ে এসেছে—এমন অবস্থা দেখলেই গাছে জল দেবেন, নতুবা নয়। প্রখর গ্রীষ্মে সকালে জল দিলে যদি দেখেন বিকেলে শুকিয়ে যাচ্ছে, তাহলে এই অবস্থায় বিকেলেও জল দেবেন। ছাদবাগানের গাছ যদি ওই গরমে দিনের পুরো রোদটা সরাসরি গায়ে পায়, তাহলে বিকেলে একবার স্নান করিয়ে দেবেন। এই গাছ কষ্টসহিষ্ণু, অতিরিক্ত রোদ সে সহ্য করতে পারে, তবুও স্নান করিয়ে দিলে সইয়ে নেবার কষ্টটুকু গায়ে লেগে থাকে না। এতে গাছের স্বাস্থ্য বজায় রেখে ফুল পেতে আখেরে লাভই হয়।

অন্যান্য খাবারঃ স্থলপদ্ম গাছ খেতে খুব ভালোবাসে। যেমন খায়, তেমনি তার বাড় হয়, বাহার হয়। খায় বলে গাদা গাদা খাবার একেবারে দিয়ে দিলে কিন্তু হবে না, নিয়ম করে নির্দিষ্ট পরিমাণেই দিতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক দু’রকম খাবারই তাকে দিয়ে যাবেন। সাতদিন পর পর সরষের খোল কমপক্ষে তিনদিন অথবা বাদাম খোল একদিন পচিয়ে দেবেন। কীভাবে দেবেন? হাফ লিটার জলে এক মুঠো খোল দিয়ে পচাবেন। তারপর সেই পচানো খোলজলের সঙ্গে আরও তিন লিটার জল মিশিয়ে সেই জল যতটা প্রয়োজন গাছের টবে দেবেন। পনেরো দিন অন্তর যত ইঞ্চি টব ততগুলো দানা ডিএপি এবং এক চা-চামচ লাল পটাশ একসঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দিয়ে টবের মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। এর পরিবর্তে টব প্রতি দেড় চা-চামচ উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি এনপিকে সার একইভাবে পনেরো দিন অন্তর দিয়ে যাবেন। অথবা ডিএপি এবং এনপিকে অলটার করেও দিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া মাসে একবার টবের মাটিতে এক মুঠো ভার্মি কম্পোস্ট, এক চা-চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দেবেন। এতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। বলা বাহুল্য, স্বাস্থ্য ভালো থাকলে গাছ ফুলও দেবে বেশি। 

প্রচুর ফুল পেতে অত্যন্ত আবশ্যিক পরিচর্যা কোনটি?

পর্যাপ্ত খাবার দেবার পাশাপাশি সারাবছর প্রচুর ফুল পেতে আপনাকে নিয়ম করে একটি কাজ করতে হবেই, সেটা হল, একটি ডগার সমস্ত কুঁড়ি ফুটে যাওয়ার পর পরই ঐ ডগাটি কেটে ফেলতে হবে। এই গাছের ডালের মাথাতেই চারপাশ জুড়ে কলি আসে এবং কলি ফুল হয়ে ফোটার সময় থেকেই ঐ ডালের বৃদ্ধি থমকে যায়; অনেক সময় দীর্ঘদিন বৃদ্ধিই হয় না; কখনো কখনো আবার ডালটি মারাও যায়। এ-কারণেই ফুল ফোটার পরই সেই ডালের মাথা কেটে ফেলতে হয়। আপনিও কাটবেন। কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। অল্পদিনেই দেখবেন, ডগা-ছাঁটাই করা ডালের ইতিউতি প্রচুর নতুন শাখা বেরিয়ে আসছে। স্থলপদ্মের ক্ষেত্রে যত নতুন ডাল তৈরি করা যায়, ততই ডালের মাথায় একের পর এক কুঁড়ি দেখা যায়, আর ততই বেশি ফুল হয়।

মনে রাখবেন, গাছের সব নতুন শাখাতেও কিন্তু ফুল আসে না। যে শাখাগুলো অপুষ্ট, যথেষ্ট লম্বায় বেড়েছে, ডালের বয়স মাস দুই পেরিয়েছে, তবু কুঁড়ির দেখা নেই—এমন ডাল কেটে ফেলবেন।

স্থলপদ্ম গাছ লম্বায় একটু বাড়তে চায়। অন্য গাছ যেমন ফুট দুয়েকের মধ্যেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ থাকে, স্থলপদ্ম কিন্তু টবেই সাড়ে তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার হতে চায়। লম্বায় তাকে এটুকু ছাড় দিয়ে হালকা ছাঁটাইয়ের মধ্য দিয়ে শুধু তার পুষ্ট ডালের সংখ্যা বাড়িয়ে যাবেন, দেখবেন ফুলের অভাব হবে না।

পর্যাপ্ত খাবার দেওয়ার পাশাপাশি মাসে একবার মিরাকুলান স্প্রে করবেন। খাবার দেওয়ার তিনদিন পর এক লিটার জলে পঁচিশ ফোঁটা মিরাকুলান মিশিয়ে ভালো করে গাছে স্প্রে করে দেবেন। এতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, গাছ সতেজ-সবুজ থাকবে, কুঁড়ির সংখ্যাও বাড়বে। 

গাছকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর উপায় কী?

স্থলপদ্মের রোগ তেমন নেই। তবে দুটো পোকা তাকে খুব জ্বালায়। একটি হল, মিলিবাগ, অন্যটি, কালো জাব। এই দুটো পোকার আক্রমণ বেশি হলে প্রতিকার না-করলে গাছ মারা যায়। এক্ষেত্রে এক লিটার জলে তিন এমএল শ্যাম্পু অথবা আধ চা-চামচ যে-কোন কোম্পানির গুঁড়ো সাবান অথবা ইমিডাক্লোরোপিড-জাতীয় কীটনাশক তিন গ্রাম ভালো করে মিশিয়ে পর পর দু’দিন মেঘমুক্তদিনের সকালবেলা স্প্রে করে দিন, সব পোকা এক্কেবারে মরে যাবে। 

কাটাই-ছাঁটাই ও রি-পটিং কোন সময় করবেন?

হালকা ছাঁটাইয়ের কথা আগেই বলেছি। এবার বলি হার্ড প্রুনিং-এর কথা। গাছ খুব বেশি বেঢপ হয়ে গেলে বছরের যে-কোন সময়ই হার্ড প্রুনিং করা যায়। এই গাছ সারা বছরই ফুল দিলেও মাঝে মাঝে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কারণেই অল্পদিন ফুল দেওয়া বন্ধ রেখে বিশ্রাম নেয়। সেক্ষেত্রে এই বিশ্রামের সময়টুকু বেছে নিয়ে সেই সময় হার্ড প্রুনিং করবেন। প্রয়োজনে এই সময় রি-পটিং-ও করতে পারেন। এই গাছ বেশ কষ্টসহিষ্ণু গাছ, হার্ডপ্রুনিং এবং রি-পটিং দুটো একসঙ্গে করলেও এর কোন অসুবিধে হয় না।  

প্রশ্ন হচ্ছে রিপটিং করবেন কখন? রুট বাউন্ড হয়ে গেলে, শেকড় টবের মাটির ওপর উঠে এসেছে দেখলে তবেই রিপটিং করবেন। এক্ষেত্রে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর শতাংশ শেকড় ছেঁটে এক সাইজ বড় টবে রি-পটিং করবেন। আদর্শ মাটি তৈরি করে, টবের ড্রেনেজ ঠিক রেখে সেই মাটি কিছুটা দিয়ে তার ওপর এক চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর ছাঁটাই করা গাছটা বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর টবে কানাভর্তি জল দিয়ে এবং তিন-চারদিন ছায়ায় রেখে তবে টবশুদ্ধ গাছ রোদে রাখবেন।

নতুন চারা তৈরি করবেন কীভাবে?

বছরের যে-কোন সময় রুট-হরমোন ছাড়াই স্থলপদ্ম গাছের ডাল থেকে সহজে চারা তৈরি করে নেওয়া যায়। কাটা ডাল দোআঁশ বা বেলে মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাটি সবসময় হালকা ভেজা ভেজা রাখবেন। অথবা, কোন পাত্রে জল নিয়ে কাটা ডালের অর্ধেকটা ডুবিয়ে রাখবেন। প্রতিদিন অথবা একদিন অন্তর সেই পাত্রের পুরনো জল ফেলে দিয়ে নতুন জল দেবেন। ব্যস,  এই দুই পদ্ধতির যে-কোন একটি অনুসরণ করলেই কুড়ি থেকে পঁচিশ দিনের মধ্যে আপনি স্থলপদ্মের নতুন চারা পেয়ে যাবেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...