“ সুখের শিশির কাল সুখে পূর্ণ ধরা/ এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গ ভরা।/ ধনুর তনুর শেষ মকরের যোগ।/ সন্ধিক্ষণে তিনদিন মহা সুখভোগ।। /ঘোর জাঁক বাজে শাঁক যত সব রামা/ কুটিছে তন্ডুল সুখে করি ধামা ধামা।“-
কবি ঈশ্বর গুপ্তের এই ছত্র কটির মধ্যে পৌষ সংক্রান্তির আনন্দময় দিকটির ছবি ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “প্রতিদিন আমরা যে অন্নগ্রহণ করিতেছি তাহার পশ্চাতে মানুষের বুদ্ধি মানুষের উদ্যম মানুষের উদযোগ রহিয়াছে- আমাদের অন্নমুষ্টি আমাদের গৌরব”। সেই গৌরবকেই উজ্জ্বলতর করে তোলে পৌষ সংক্রান্তির আনন্দ উৎসব।
বাংলা পঞ্জিকা মতে প্রতিটি মাসের শেষ দিনটিকে সংক্রান্তি বলা হয়। হিন্দু শাস্ত্রাদিতে প্রতিটি সংক্রান্তির পৃথক গুরুত্ব আছে। পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে বলে মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি। দক্ষিণায়ন শেষ করে এইদিন সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়। মকর সংক্রান্তির উৎসবে শামিল হয় সারা ভারত।সূর্য এই দিনে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনটি ১৪ জানুয়ারিতে পড়লেও হাজার বছর আগে মকর সংক্রান্তি পড়ত ৩১ ডিসেম্বরের কাছাকাছি। হাজার বছর পরে, যদি এই পৃথিবী, এই ভারতের অস্তিত্ব থাকে তখন পৌষ সংক্রান্তি পড়বে ফেব্রুয়ারি মাসে। অঘ্রাণ মাসে কৃষকের গোলায় ওঠে নতুন ধান।“অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা/ অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা”। গোলাভরা ধানের স্বপ্নে বিভোর কৃষকের ঘরে আসে নতুন ধান। স্বপ্ন সার্থক হবার মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে তোলার জন্য পালন করা হয় নানান আচার। যার অন্যতম “আউনি বাউনি”। নতুন ধানের পাকা শিষ, খড়, মুলোর ফুল, আমপাতা ইত্যাদি জড়িয়ে তৈরী করা হয় “আউনি বাউনি”- রাখা হয় ধানের গোলায়,বাক্সপ্যাঁটরায়,ঢেঁকি, ঘরের কড়া, আংটা ইত্যাদিতে। লোককথায় বলে, “আউনি বাউনি চাউনি/ তিনদিন কোথা যাওনি”।
আউনি হল লক্ষ্মীদেবীর আগমন, বাউনি হল লক্ষ্মীদেবীর বন্ধন আর চাউনি অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবীর কাছে পরিবারের সমৃদ্ধি কামনা। পৌষলক্ষ্মীর ছোঁয়ায় বৎসর কাল সমৃদ্ধির আশা থাকে এই আচরণে। “মাঠ আমাদের মিতা/ ওরে,আজ তারি সওগাতে/মোদের ঘরের আঙন সারা বছর ভরবে দিনে রাতে”।
পৌষ মাস কৃষকের বড় আনন্দের মাস। কৃষকবধূ তাই বলে “এসো পৌষ যেয়ো না/ জন্ম জন্ম ছেড়ো না/ আঁদারে পাঁদারে পৌষ/ বড়ো ঘরের কোণে বোস/ পৌষ এল গুড়ি গুড়ি / পৌষের মাথায় সোনার ঝুড়ি”। পৌষ উৎসবের মাস। ডালা ভরা পাকা ফসলের সুবাসে পৌষ যেমন মাঠ মাতায়, মাতিয়ে তোলে জনজীবনও। বাংলার নানা প্রান্তে নানান ব্রত পালনের মাধ্যমে পৌষের জয়গান ধ্বনিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশার কিছু অঞ্চল জুড়ে পালিত হয় টুসু উৎসব। অঘ্রাণ মাসের শেষ দিনে শুরু হয় লৌকিক দেবী টুসু বা তুষুর আরাধনা। শেষ হয় পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে এক মাস ধরে টুসুকে ঘিরে চলে টুসু গান। টুসুর কোনো মূর্তি হয় না। মাটির সরায় পিটুলি দিয়ে এঁকে, হলুদের টিপ দিয়ে তাতে নতুন ধান,গোবর আর তুষ মেশানো মন্ড, ফুল, ফুলের মালা,কড়ি ইত্যাদি দিয়ে টুসু সাজানো হয়। ঘরের এক কোণে পিঁড়িতে বা কুলুঙ্গিতে রাখা হয় টুসুকে। প্রতিদিন গৃহদেবতার মতোই টুসুর পুজো হয়। দেওয়া হয় আলপনা, জ্বালানো হয় প্রদীপ। আর হয় গান।টুসুকে নিয়ে বাঁধা লোকগান। মাসশেষে আসে জাগরণের রাত। পৌষ মাসের শেষ চারদিনকে বলে চাউরি, বাউরি, মকর এবং আখান। টুসু উৎসবের সমাপ্তি হয় এই চারদিনে নানান প্রথা পালনের মধ্যে দিয়ে। চাউরিতে বাড়ির মাটির উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকোনো হয়। চাল কুটে তৈরী করা হয় চালের গুঁড়ো। বাউরিতে অর্ধচন্দ্রাকার, তিনকোনা আর চারকোনা পিঠে গড়া হয়। পিঠের ভেতরে দেওয়া হয় তিল আর নারকেলের পুর। একে বলে গড়গড়্যা পিঠে বা পুর পিঠে।বাউরির রাতে টুসুর জাগরণের পালা। মেয়েরা ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা দিয়ে ঘর সাজায়। টুসু মূলত কুমারী মেয়েদের দেবী হলেও জাগরণে সব বয়সের মেয়েরাই অংশ নিয়ে থাকে। গোবর দিয়ে পৌষ বুড়ি গড়া হয়। সারা রাত কেটে যায় গানে-
“আমার বড়ো মনের বাসনা/ টুসুধনকে জলে দিব না”। টুসুর জন্য বাঁধা গানে ধরা পড়ে ঘরের মেয়ের স্নেহ কোমল ভালোবাসা-“ উপরে পাটা, নীচে পাটা/ তার ভিতরে দারোগা।/ ও দারোগা পথ ছাড়ে দাও/ টুসু যাবেন কলকেতা/ টুসু যাবেন কলকেতা/ খিদে পেলে খাবেন কি?/ আনগো টুসুর নতুন গামছা/ জিলিপি ছাঁদা বাঁধে দি”।
টুসুর গানে জড়িয়ে যায় নারী জীবনের দুঃখ বেদনার কথাও। মূলত কুরমি সম্প্রদায়ের নিজস্ব এই টুসু কাহিনি এখন সকলের। জাগরণের রাত শেষে আসে মকর। মকর সংক্রান্তি- টুসুর বিসর্জন। এই দিন চতুর্দোলা বা চৌডল তৈরি করা হয় বাখারি, গাছের ডাল আর রং বেরঙের কাগজ দিয়ে। চৌডল সাজিয়ে গানের সুরে টুসুর ভাসান হয় জলে। চৌডল নিয়ে শোভাযাত্রা তেও টুসু বিচ্ছেদের সুর ফুটে ওঠে-
“জলে কেন যাবে টুসু জলে তোমার কে আছে?/ মনেতে ভাবিয়া দেখো জলে শ্বশুর ঘর আছে”। ভাসানের সময় এক বাড়ির টুসুকে নিয়ে অন্য বাড়ির লড়াইও মন্দ হয় না। এ লড়াই গানের লড়াই- “তুদের টুসু মুড়ি ভাজে/ খোলা খটখট করে/ আর আমার টুসু মুড়ি ভাজে/ বলি, চুড়ি ঝলমল করে গো”।
ভাসানের সময় নদীর ঘাটে চলে মন দেওয়া নেওয়ার পালাও। টুসুকে নিয়ে এক কাহিনি শোনা যায় মানভূম অঞ্চলে। কথিত আছে, এক মাহাতো পরিবারের রূপসী কন্যা টুসুকে দেখে পাগল হয় এক অ-কুরমি জমিদারের ছেলে। জোর করে তাকে বিয়ে করতে চাইলে টুসু সুবর্ণরেখা নদীতে আত্মবিসর্জন করে। এর সত্যতা জানা যায় না। টুসুর ভাসান শেষে মেয়েরা নদী বা জলাশয়ে স্নান করে নতুন কাপড় পরে। এ পুজোয় কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত, কোনো মন্ত্রতন্ত্র লাগে না। ভাসানের পর চলে পিঠে খাওয়া। নানা রকমের পিঠে তৈরী করে, সবাই মিলে খাওয়া। কোথাও কোথাও মাস পিঠে- মাংসের পিঠেও খাওয়া হয়।
মকর সংক্রান্তির এই তিথিটি অত্যন্ত পবিত্র। মহাভারতে আছে, এই দিনে ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। দক্ষিণায়নের সময় দেবলোকে হয় রাত্রি। দেবতাদের রাত শেষ হয় পৌষ সংক্রান্তির পুণ্য প্রভাতে। তাই এই দিন পুণ্য স্নানের, দেবতাদের উদ্দেশে পিঠে পুলি, মিষ্টান্নের ভোগ নিবেদনের।দেশের নানা প্রান্তে নানা ভাবে মকর সংক্রান্তি পালন করা হয়। নেপাল, থাইল্যান্ড,কাম্বোডিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশেও এই দিনটি পালন করা হয়।
কথিত আছে এই তিথিতেই যমুনা নদীতে স্নান করে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার সঙ্গে ‘মকর’ পাতিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ মা যশোদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ব্রহ্মমুহূর্তে যমুনায় স্নান করলে কি হবে? উত্তরে যশোদা বলেছিলেন,
“রাণী বলে কল্য বাপু দিন শুভক্ষণ।/ধনু ত্যজি মকরেতে আসিবে তপন।।/ বলিয়া মকর যাত্রা তার নাম কয়।/ মকরে করিলে স্নান আয়ুবৃদ্ধি হয়”। এই শুভ দিনে শুভ লগ্নে স্নান শেষে “মকর পাতানো” হবে। “মকরে তন্ডুলে সবে পাতাবে মকর।/ এত শুনি হৃষ্ট হন দেব দামোদর।।/ শ্রীমতী চাহিয়া তবে কহিলা ইঙ্গিতে।/ মকর করিব কল্য তোমার সহিতে”।
“মকর পাতানো” আসলে সখা-সখীর মধ্যে প্রাণের বন্ধন গড়ে তোলা। আত্মার সঙ্গে আত্মার প্রীতির বন্ধন পাতানো হয় এই বিশেষ দিনে।বাংলার অনেক অঞ্চলে এক সময় কুমারী মেয়েরা মকরব্রত পালন করত একমাস ধরে। কনকনে ঠান্ডায় নদী বা পুকুরে স্নানের কষ্ট ভুলতে বলা হত ছড়া-“এক ডুবিতে আই- ঢাই/ দুই ডুবিতে তারা পাই/ তিন ডুবিতে মকরের স্নান/ চার ডুবিতে সূর্যের স্নান/ পাঁচ ডুবিতে গঙ্গাস্নান”।
এই দিনে বিশেষ ক্ষণে কিছু কিছু নদীতে স্নান করলে নাকি গঙ্গাস্নানের পুণ্য লাভ হয়। এই ধারণার ওপর ভর করেই বীরভূম জেলার কেন্দুলিতে অজয় নদে স্নান করতে আসেন বিশ্বাসী মানুষেরা। অজয়ের তীরে বসে বাউলদের বিশাল মেলা। এই বিশ্বাসের পিছনে আছে এক লোককথা। কবি জয়দেব প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিন কাটোয়ায় গঙ্গাস্নান করতে যেতেন। কিন্তু একবার অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি। স্বপ্নে তিনি শুনতে পান যে তিনি গঙ্গাস্নানে যেতে পারেননি বলে মা গঙ্গাই উজিয়ে আসবেন অজয় নদে। ফলে এই দিন অজয় নদের কদম্বখন্ডির ঘাটে স্নান করলেই গঙ্গাস্নানের পুণ্য লাভ হবে।
স্নানকে কেন্দ্র করে মকর সংক্রান্তিতে অজয়ের তীরের মেলার বর্ণনা আছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়, “মেলায় বাউলদের আকর্ষণটাই ছিল আমাদের কাছে মুখ্য। বাউলরা আখড়া বানাতেন। এক একটা আখড়ায় এক একজন বাউল এবং তাঁর সম্প্রদায়। গান শুনতাম, খেতাম, শুতাম। আমাদের সঙ্গে দারুণ জমে গিয়েছিল তাদের”। এই মাসেই হয় তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত। অঘ্রাণ মাসের সংক্রান্তি থেকে সারা পৌষ মাস জুড়ে ব্রত পালন করে পৌষ সংক্রান্তিতে হয় উদযাপন। চালের গুঁড়োর নাড়ু করে গুড় মেশানো দুধে ফুটিয়ে মিষ্টি তৈরী করতে হয়। খাওয়া শেষে জলে মাটির হাঁড়ি ভাসিয়ে বলতে হয় “তুঁষ তুঁষুলি গেল ভেসে/ বাপ-মার ধন এল হেসে।/ তুঁষ- তুঁষুলি গেল ভেসে/ আমার স্বামীর ধন এল হেসে”।
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায় এই দিনটিকে বলা হয় “ সাকরাইন”। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে সেখানে ঘুড়ি উড়িয়ে উৎসব করা হয়। ধামরাই অঞ্চলে হয় “বুড়াবুড়ির পূজা”। রাণী চন্দের লেখায় ধরা আছে অনেক কাল আগের বাংলাদেশের ঢাকা জেলার এক গ্রামের পৌষ সংক্রান্তির বর্ণনা।
“আসে পৌষ সংক্রান্তি। মহা ধূমধামের সংক্রান্তি। বসতভিটার মঙ্গলের জন্য বাস্তুপূজা হয় এদিন। তুলসীমন্ডপে ‘ঝিকা’ গাছের ডাল কেটে তার তলায় পূজা হয়। পুরুতমশাই নিজে ‘চরু’ রান্না করে দিয়ে যান। আজ এই চরুই পূজার প্রধান অঙ্গ। এ গ্রামে ব্রাহ্মণ নেই। পাশের গ্রাম থেকে আসেন সীতানাথ পুরোহিত। কত বাড়িতে পূজা করতে হয় তাঁকে- ছুটে ছুটে বাড়ির পূজা সারেন। পাটশলমি দিয়ে আগুন জ্বেলে নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধে চালে বাতাসায় কোনো রকমে ফুটিয়েই ‘নমো নমো’ করে পূজা সাঙ্গ করে লাল গামছাখানা কাঁধে ফেলে ছুট লাগান”। এ ছাড়াও হত আর এক উৎসব- “এত যে উৎসব- এত হইচই এখানে- আমার তবু বেশি ভালো লাগে ‘বট- পাকুড়’তলার পুজো দেখতে। সে পুজো হয় পৌষ সংক্রান্তির দিনে। এই দিন বট- পাকুড়ের বিয়ের দিন- এদের প্রতিষ্ঠা দিবস।….. পৌষ সংক্রান্তির দিন সুশীলা পিসি আসেন, গ্রামের গিন্নিরাও আসেন বউদের নিয়ে। পুব পাড়ায় এঁরাই আসেন বেশি। মা – মামীরা আসেন। এসে বট- পাকুড়তলার এক পাশে সব কিছু নামিয়ে বসে যান পূজার আয়োজনে। মার কাছে বসে দেখি। কলসির জল পিতলের গামলায় ঢেলে আতপ চাল ধুয়ে ফল কেটে নৈবেদ্য সাজান।…. একটি দুটি ঢাকী আসে, তারা বাজায়। একটা ছেলে কাঁসি পেটায়। পুরোহিত পুজো করেন- মেয়েরা শাঁখ বাজান-উলুধ্বনি দেন। স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশে পুজোর আয়োজন হয়- পুজো শেষ হয়- প্রসাদ বিতরণ হয়”। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার আচার্যচৌধুরী পরিবারে এই দিনটির ক’দিন আগে থেকে উঠান পরিষ্কার করে গোবর মাটিতে নিকিয়ে রাখা হত। তারপর এই দিনে সেখানে দেওয়া হত সূর্য, চন্দ্র, গ্রহনক্ষত্রের আলপনা। তারপর হত পুজো। পিঠেপুলির সুবাস পড়ত ছড়িয়ে। এই শান্ত, স্নিগ্ধ জীবনছবি আজ নিতান্তই ইতিহাস।
পৌষের এই সংক্রান্তি আসলে আনন্দের সংক্রান্তি। তাই পুজো বা অবগাহন স্নানে এর শেষ নয়, গানে, নাচে, চড়ুইভাতিতে- সর্বোপরি নতুন চাল, তিল, নলেন গুড়ের পিঠেপুলিতে জনজীবন মেতে ওঠে নিজস্ব ছন্দে। আমাদের এই বাংলায় এই সময় নতুন ধানের নবান্ন হয়। নতুন ধানের সুবাসে মিলে যায় নতুন ওঠা খেজুরের গুড়ের সুগন্ধ।পাকা হাতে খেজুর গাছ কাটেন গাছি। তার হাতের নিপুণ টানে গাছের গা থেকে বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ে রস।জমা হয় গাছের গায়ে বাঁধা কলসিতে। সেই রস থেকে জ্বাল দিয়ে যে অমৃতসমান গুড় তৈরি হয় তার বর্ণনা আছে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখায়। সেই গুড়ের সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিলেই তো হয় পিঠে পুলি।
আসমুদ্রহিমাচলকে একসূত্রে গাঁথা যায় এই মকরসংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে।সুদূর কাশ্মীর থেকে কেরালা, কন্যাকুমারিকা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট থেকে আসাম, অরুণাচল এই দিনে সকলেরই উৎসব। আসামে এই দিন পালন করা হয় ভোগালি বিহু। খড়ের তৈরি ভেলাঘর আর মেজি গড়ে সারা রাত নাচ গান শেষে মেজিতে আগুন দিয়ে পিঠে বানিয়ে খাওয়া হয়। মহারাষ্ট্রের তিলগুল- এ থাকে বাঙালি তিলের নাড়ুর স্বাদ। সধবা মেয়েরা করেন হলদি কুমকুম। ওড়ানো হয় ‘পতঙ্গ’-ঘুড়ি। ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হয় গুজরাটেও। হিমাচল, পাঞ্জাব, হরিয়ানায় হয় ‘লোহরি’। তিলের রেউরি, চিনেবাদাম আর গুড়ের গজক খাওয়া হয়। তামিলনাড়ুতে হয় পোঙ্গল। দুধে চাল, ডাল, গুড় দিয়ে তৈরী করা হয় মিষ্টি। চলে জাল্লিকাট্টুর লড়াই। অন্ধ্রপ্রদেশে এর নাম পেড্ডা পান্ডুগা। আলপনা এঁকে দেবতাদের মূর্তি সাজানো হয়। ছোটদের নানান উপহার দেওয়া হয়। মধ্যপ্রদেশে নানান নদীতে, বিশেষত শোণ, নর্মদা ইত্যাদিতে স্নান করে তিলের মিষ্টি খাওয়া হয়। কর্ণাটকেও চিনেবাদাম ও তিল আর গুড়ের মিষ্টি খাওয়া হয়। কেরালায় অবশ্য বাংলার মতোই নারকেলের মিষ্টি তৈরী করা হয়।
বাঙালির পৌষপার্বণে থাকে নানান স্বাদের পিঠের আস্বাদন। “ আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল আর/ গড়িতেছে পিঠে পুলি অশেষপ্রকার”। অশেষপ্রকারই বটে। শুকনো খোলার চিতই পিঠে, সাজের পিঠে, আসকে পিঠে,সামান্য তেলের ছোঁয়া লাগা সরুচাকলি, পাটিসাপটা থেকে তেলে ভাজা নকশি পিঠে, মুগের পুলি, মালপোয়া, গোকুল পিঠে, ভাজা পিঠে থেকে কাঁকন পিঠে, মনোরঞ্জন পিঠে, রস পিঠে, গোলাপ পিঠে, সেদ্ধ পিঠে,চুষির পিঠে, রসপুলি, রসবড়া আরও কত কি! এরপর যখন “দিজ্জই কান্তা” হয় অর্থাৎ গৃহিণী আদরে সোহাগে পাতে তুলে দেন সেই পিঠে তখন তার স্বাদে যোগ হয় অন্য মাত্রা। “আদরে খাওয়াবে সব মনে সাধ আছে।/ ঘেঁষে ঘসে বসে গিয়া আসনের কাছে/’মাথা খাও খাও’ বলি পাতে দেয় পিঠে/ না খাইলে বাঁকা মুখে পিটে দেন পিটে”। পিঠের স্বাদে মিশে থাকে শৈশব- কৈশোরের স্মৃতিও।“পৌষপার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষয় খেয়ে/ আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে”। সুফিয়া কামালের এই ছত্রদুটি অনেককেই ফেলে আসা দিনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
আনন্দগান যে বাঁশিতে বাজে সে যে ব্যথার বাঁশি। তাই আনন্দের সাগরে যখন জোয়ার ওঠে তখন তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অখ্যাত গ্রামের এক অসহায় দুঃখী মেয়ের ছায়াটি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ভোলেন নি।
“পৌষ সংক্রান্তি। সন্ধ্যাবেলা অন্নপূর্ণা একটি কাঁসিতে চালের গুঁড়া, ময়দা ও গুড় নিয়া চটকাইতে ছিলেন- একটা ছোট বাটিতে একবাটি তেল। ক্ষেন্তি কুরুনীর নীচে একটা কলার পাত পাড়িয়া এক থালা নারিকেল কুরিতেছে”। যৎসামান্য উপকরণের সেই পিঠেতেই সেই দরিদ্রের ঘরে উঠল নির্মল আনন্দের ঢেউ। ক্ষেন্তি একাই খেয়ে ফেলল কতগুলো পিঠে। পরের বছর, আবার এক পৌষ পার্বণ। “অন্নপূর্ণা সরুচাকলি পিঠের জন্য চালের গুঁড়ার গোলা তৈয়ারী করিতেছেন”- গোলা তৈয়ারী হইয়া গেলে- খোলা আগুনে চড়াইয়া অন্নপূর্ণা গোলা ঢালিয়া মুচি দিয়া চাপিয়া ধরিলে….দেখিতে দেখিতে মিঠে আঁচে পিঠে টোপরের মতন ফুলিয়া উঠিল। পুঁটি বলিল- মা দাও, প্রথম পিঠেখানা কানাচে ষাঁড়াষষ্ঠীকে দিয়ে আসি”। তারপর পিঠে খেতে বসার সময় “পুঁটি অন্যমনষ্ক ভাবে বলিয়া উঠিল- দিদি বড় ভালোবাসত”।
যে নেই উৎসবের দিনে তাকে তো ভোলে না তার ভালোবাসার জনেরা। ভালোবাসার সেই গোপন টানই যে সব উৎসবের মূল। সেখানেই, সেই ভালোবাসাতেই পূর্ণ মন বলে ওঠে “না যেয়ো ছাড়িয়া পৌষ”।