ব্ল্যাক স্ক্রিন। ব্যাক গ্রাউন্ড থেকে উৎকন্ঠা ভরা একটি মেয়ের গলা শোনা যাচ্ছে - "বাবা, বাবা"। এরপর ডায়লগের সঙ্গে একজন বয়স্ক লোককে স্ক্রিনে দেখা যায়। গল্প এগোলে বোঝা যায় বাবা আর মেয়ের গল্প। তবে অন্য আর পাঁচটা বাবা-মেয়ের গল্প থেকে একটু আলাদা। মেয়ে চাকুরিরতা। অসুস্থ বাবাকে একা বাড়িতে রেখে অফিস যেতে হয়।
অফিসে গিয়েও বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এক বিকেলে মেয়ের অফিসে থাকাকালীন তাঁর সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং ঘটে যায় চরম দুর্ঘটনা। লণ্ডনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল "দ্য লিফট অফ"-এ অফিসিয়াল সিলেকশন হওয়া ছবি "আখরোট" সিনেমার গল্প এতক্ষণ বলছিলাম।
হঠাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন অনেক ঘটনা স্মৃতির শ্লেট থেকে মুছে গেছে, তাহলে ব্যাপারটা কিরকম হবে? খারাপ স্মৃতি, কষ্ট-যন্ত্রণা যদি নিমেষে ভুলে যাওয়া যায় তাহলে মন্দ হয় না। তাই না? পিছু ধাওয়া দেওয়া কিছু স্মৃতির কানাগলি থেকে অন্তত মুক্তি পাওয়া যায়। খলিল জিবরানের কথা ধরে বলা যায়- "forgetfulness is a form of freedom".
তবে এই ফরগেটফুলনেস অনেকের কাছে মুক্তির খোলা বাতাস না এনে যন্ত্রণাবিদ্ধ কাঁটার সজ্জা তৈরি করতে পারে। ভুলে যাওয়া বা স্মৃতিভ্রংশ সাময়িক ঘটনা বা খনিকের মুক্তি না হয়ে চিরদিনের যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠতে পারে। তার প্রভাব যে শুধু সেই ব্যক্তির উপর পরে তা নয়, পরিবারকেও সেই কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেয়। ডিমেনশিয়া এমনই একটি রোগ যাতে মানুষের স্মৃতিভ্রংশ ঘটে। ল্যাটিন শব্দ "ডিমেনস" থেকে ডিমেনশিয়া শব্দটি এসেছে যার অর্থ "আউট অফ মাইন্ড"।
"ডিমেনশিয়া" রোগটি "আখরোট" স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। ছবি শুরু হয় একটি মেয়ের উৎকণ্ঠায় ভরা সংলাপ দিয়ে। তারপর কিছু ছোট ছোট শটে একজন প্রবীণকে কখনো হাসপাতালে আবার কখনো বাড়িতে দেখা যায়। গল্প এগোলে বোঝা যায় প্রবীণ ব্যক্তিটি ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট। যাঁকে নিয়ে শুধু তাঁর মেয়ে চিন্তিত নন, তিনি নিজেও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। হাসপাতাল আর বাড়ি প্রায় প্রতিদিনের রুটিন। ছোট ছোট চিরকুট আর ডাইরিতে তাঁর লিখে রাখা সারাদিনের রুটিন!
শ্যামবাজারের মোড়ে একদিন এক বয়স্ক বৃদ্ধকে অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় দেখেন ছবির পরিচালক ইন্দ্রজিৎ দাস। তাঁকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য লোক। তিনি কিছু বলতে পারছেন না। কিছু চিনতেও পারছেন না। হঠাৎ সেই ভিড় ঠেলে এক ব্যক্তি তাঁকে নিয়ে যান এবং যাওয়ার আগে বলে যান তিনি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। বাড়ি ফিরে পরিচালকের মাথায় "আখরোট" শর্টফিল্ম তৈরি করার ভাবনা আসে এবং তিনি স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করেন।
স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি পরিচালনা, এডিটিং, স্পেশাল এফেক্ট সব ইন্দ্রজিৎ দাসের নিজের করা। ছবিটি শ্যুট করা হয়েছে মোবাইল ক্যামেরায়। সাত মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে ডিমেনশিয়া রোগীর যন্ত্রণা পরিচালক বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্ক্রিপ্টের পাশাপাশি এই ছবির মিউজিকও গল্পকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। মিউজিক কখনও কখনও গল্প হয়ে উঠছিল। এই ছবির মিউজিক করেছেন পরমাণু সরকার। ছবিটি ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের ডেডিকেট করা হয়েছে।
লণ্ডনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল "দ্য লিফট অফ"-এ "আখরোট" অফিসিয়ালি সিলেক্ট হয়েছে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার ইন্দ্রজিৎ দাসের এটি দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি। প্রথম ছবিটিও একটি সমস্যার কথা বলছে। সেই ছবিতে তিনি বয়স্কদের একাকিত্বের যন্ত্রণার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যা তাঁকে ভাবায় সেই বিষয় নিয়ে তিনি ইন্ডিফিল্ম তৈরি করতে চান। বেশ কিছু গল্প তাঁর ভাবনায় রয়েছে। আশা করা যায় সেগুলোও খুব তাড়াতাড়ি রিলে আমরা দেখতে পাব।
"আখরোট"। বাইরেটা শক্ত। ভিতরটা নরম। উপরের খোল ভাঙলে দেখতে কিছুটা মস্তিষ্কের মতো। মস্তিষ্ক বিকল হলে জীবন এলোমেলো, ছন্দহীন।