শর্মিষ্ঠা পাল (বাচিক শিল্পী), নাগেরবাজার,
তখন হাওয়াতে হালকা ঠান্ডা।মা দুর্গা চলে যাওয়ার পরই কালীপুজোর অপেক্ষায় থাকতাম। মোম প্রদীপের আলোয় বাড়ি সাজানো, তারপর সন্ধ্যা ঘন হলেই তারাবাতি রঙমশাল কালীপটকা, তুবড়ির ঝলমল। কী আনন্দ!
তেমনই এক কালীপুজোয় একবার ছিলাম অশোকনগরে দিদাবাড়িতে। সেদিন বিকেল থেকেই সারা বাড়ি মোমবাতি আর প্রদীপ লাগিয়ে দিচ্ছিলাম, যাতে সন্ধ্যা ঘন হলেই সব জ্বালিয়ে দিতে পারি।দিদা বাড়ির পিছনের বাগানে গাছের গোড়াগুলোতেও প্রদীপ রেখে আসতে বলেছিল। ইয়া বড় বড় গাছের তলায় দুটো করে প্রদীপ। সেই প্রদীপ রেখে যেই সামনের বারান্দায় যাব, তখনই কোনো মেয়ের গলা পিছন থেকে ডাকল।
চমকে তাকালাম, ফ্যাকাশে হলুদ শাড়ি আর লাল টিপ পরে এক লাবণ্যময়ী। কিন্তু তাকে চিনি না। বললাম, “ কী চাও? মেয়েটি বলল,' কিছু না...শুধু দুটো মোমবাতি আর রঙমশাল দেবে তুমি?আমাদের ঘরে আলো নেই "....
ক্লাস নাইনে পড়া আমি কিছু না বুঝেই, অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম "মাত্র এই কয়েকটা মোমবাতি আর বাজিতে কীভাবে ঘর আলো হবে?"
এখনও মনে পড়ে মেয়েটা করুণ মুখে বলেছিল, 'তুমি দেবে কিনা বলো ?'...
কথা না বাড়িয়ে এক প্যাকেট মোমবাতি আর তারাবাতি দিয়ে বিদায় করেছিলাম(এসব পাকামো বলাও যাবে না। এদিকে সন্ধ্যা নামতেই পাড়ার সব বাড়ি একসঙ্গে মোমবাতি আর প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, তখন মোবাইল ছিল না, ছিল সুন্দরকে চুপ করে উপভোগ করার সময়।
হেঁটে হেঁটে পাড়াটা ঘুরছিলাম। শেষ বাড়ির সাজানো দেখে যেই ফিরব চোখে পড়ল হলুদ শাড়ির মেয়েটি আর তার হাতে ধরা এক ছোট্ট মেয়ে ঐ বড় গাছের নীচে দাঁড়িয়ে হাসছে।হলুদ শাড়ি চেঁচিয়ে বলল 'এই ছোট্টুর জন্য তো আলো চাইতে গিয়েছিলাম আমি। তুমি দিলে তাই তো কী খুশি আমার ছোট্টু। তোমার ভালো হোক।" আমি কিছু বলতে চেয়েও পারলাম না,ওরা হাওয়ায় যেন মিলিয়ে গেল…
এক কাকীমার ডাকে ঘোর ভাঙল। বলল ,"এখানে দাঁড়িয়ে কেন তুই, চল বাজি পোড়াবি না? " যখন রঙমশালে আগুন দিলাম, সেই আভাতে ছোট্টু আর তার মায়ের হাসিমাখা মুখ ভেসে উঠল। রাতে মা কালীর বিশালাকায় মূর্তির সামনে হাতজোড় করে বলেছিলাম "ওদের ভালো হোক, আলো হোক"... আজও জানি না ওঁরা কারা, কোথা থেকে এলেন ...কিন্তু এখনও সেই হাসিমাখা মুখদুটো মনে পড়লে মনে হয় আসল রঙমশাল তো ওদের হাসিতে। জীবন সেটি শিখিয়েছিল সেই কালীপুজোর দিন।