আলাস্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকলেও সিনেমাই করতেন তথাগত!

পাঁচ বছর বয়সে প্রথম থিয়েটারে অভিনয় দিয়ে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। বাংলা টেলিভিশনের ভীষণ পরিচিত মুখ তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবির পরিচালনায় করছেন তিনি। বাংলা টেলিভিশনের দর্শক তাঁকে চেনে ‘তথাগত’ মানে ‘তথাগত মুখোপাধ্যায়’ নামেই। চলতি বছরেই তার পরিচালনায় আসছে নতুন বাংলা ছবি 'ভটভটি'। সম্প্রতি জিয়ো বাংলার টলিকথা অনুষ্ঠানে আড্ডা দিতে এসে এই ছবি ও তার জীবন কাহিনি তুলে ধরেছেন অভিনেতা তথাগত মুখোপাধ্যায়।

প্র: আপনার 'ভটভটি' ছবিটি মুক্তি পাবে কিছু দিনের মধ্যেই। এই ছবির পিছনের গল্পগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন?

তথাগত: 'ভটভটি' আসলে ৩৫ দিনের একটা লম্বা শিডিউল। তার আগে তিন মাসের একটা রিহার্সাল। প্রায় ছয় মাসের প্রিপ্রোডাকশন। ফাইনালি 'ভটভটি'  ১১ আগস্ট রিলিজ করছে। সেই সময় একটি হিন্দি ছবি রিলিজ করছে যার নাম 'লাল সিং চাড্ডা'। যেটি 'ফরেস্ট গাম্প'-এর অফিশিয়াল রিমেক। 'ভটভটি'র চরিত্রের সঙ্গে 'ফরেস্ট গাম্প' চরিত্রটির কিছুটা মিল রয়েছে।

প্র: এই গল্পটার ভাবনা কোথা থেকে শুরু। সেই সব কিছু নিয়েই একটা গল্প শুনতে চাই?

তথাগত: 'ভটভটি'  ২০১২ সালে লেখা। একদিন আমি আর আমার বন্ধু শীতকালে লেকে গিয়েছিলাম। চারিদিকে অন্ধকার লেকের জলটা কেমন যেন শান্ত হয়েছিল। শুনেছিলাম স্কটল্যান্ডের লেকে লকনেস মনস্টার থাকে। জল এতো কালো যে দেখে মনে হবে এখুনি দৈত্য উঠে আসবে। তখন আমি বলেছিলাম দৈত্যের জায়াগায় তো জলপরীও উঠে আসতে পারে। সেখানে থেকেই পুরো আইডিয়াটা এসেছিল। অভিরূপ নামে আমার এক বন্ধু যার সঙ্গে মিলেই আমি 'ভটভটি'র সংলাপ লিখেছিলাম। ২০১২ সালে ছবির গল্প লেখা হয়েছিল। তবে আসন্ন রিলিজ ছবি 'ভটভটি'। কিন্তু আগামী পাঁচ, ছয় দিনের মধ্যে আমার 'গোপনে মদ ছাড়ান'  ছবিটির শুটিং আরম্ভ হবে। সেটার একটা এক্সাইটমেন্ট রয়েছে।

প্র: পাঁচ বছর বয়স থেকে আপনার অভিনয় জীবন শুরু। সেখানে থেকে একজন অসাধারণ অভিনেতা ও পরিচালক। এই জার্নিটা কেমন ছিল?

তথাগত: আমি পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি অভিনেতা হব। তাই সেভাবে স্ট্রাগল বলে কিছু ছিল না। স্ট্রাগল তো সব কাজেরই রয়েছে। এছাড়াও আমি এটা ছাড়া অন্য কিছু করব তা কোনও দিন ভেবে উঠতে পারিনি। সিনেমা বানাব , সিনেমায় অভিনয় করব-এই ইচ্ছাটা তো ছিলই। সেই জন্যই থিয়েটার করা,  সেখান থেকে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করা শুরু হয়েছিল। তাই এটা আমার কাছে স্ট্রাগল না। এখন যদি পৃথিবী মানুষশূন্য হয়ে যায় বা আমি যদি আলাস্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকি। তাহলেও আমি সিনেমাই বানাতাম।

প্র: তিনশো বছরের বাড়িতে আপনার ছোটবেলাটা কেটেছে। সেই সময়টা কেমন ছিল?

তথাগত: তরুণ মজুমদারের সিনেমার মতো ছিল। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। বাড়িতেই নাটক করতাম আমরা। পাড়ায় খেলাধুলা, পুজোর সময় আমরা কত মজা করেছি সবাই মিলে। আমার ছোটবেলা নিয়ে একটা ছবি হয়ে যাবে।

প্র: এখন মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন বেড়েছে। যার ফলে অনেকেই আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়েছে। এটা নিয়ে আপনার কী মত?

তথাগত: আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় আমরা একটি উন্নত মননের দিকে এগিয়েছি। আমরা ট্রুথের আরও এগিয়েছি। তাই এত কিছু ধরা পড়ছে। তখনও মেয়েলি স্বভাবের ছেলেকে পাড়ার লোকেরা 'লেডিস' বলে ডাকতেন। কিন্তু এখন 'গে' মুভমেন্ট হয়। তাই এই বিষয়ে নিয়ে মানুষ জানে। তখনও ছিল, আরও বেশি সংখ্যায় ছিল। শুধু আমরা খবর পেতাম না। আসলে সব ফিল্ডে সব মানুষ লড়াই করতে পারে না। তাই পালিয়ে যাওয়াটাও তার ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। আমার মনে হয় যে মানুষটা পালাচ্ছে তাকে জার্ না করে তার প্রতি সহমর্মী হওয়া উচিত। কেউ তো ইচ্ছা করে পালিয়ে যেতে বা মরতে চায় না।

প্র: কম বয়সে প্রথম নাটকের পরিচালনা 'উৎপল দত্তের রাইফেল'। এমন একটা পলিটিক্যাল ড্রামা কেন?

তথাগত: আমার ভালো লেগেছিল। তাছাড়াও আমি উৎপল দত্তের অভিনয়ের ভক্ত। উৎপল দত্তের যা মনন আর মেধা সেটাও চমৎকার লাগত আমার। কিন্তু কমিউনিজমের প্রতি আমার আলাদা কোনও আকর্ষণ নেই। আমি সম অবস্থানে বিশ্বাস করি সম বন্টনে বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি সবার সমান অধিকারে বিশ্বাস করি। অন্তত কর্মগত ক্ষেত্রে। 'রাইফেল' নিয়ে আমার সত্যের প্রতি একটা আকর্ষণ রয়েছে। কারণ সত্য বলে যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় সেই আত্মতৃপ্তিটার প্রতি আমার লোভ রয়েছে। সেই লোভ থেকেই উৎপল দত্তের নাটক বেছে নেওয়া।

প্র: তখনকার দিনের প্রযোজক ও এখনকার দিনের প্রযোজক। এই টপিকটা সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

তথাগত: তখনকার দিনের প্রযোজকরা সিনেমার শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সিনেমার শিক্ষা মানে সিনেমা বানানোর টেকনিক্যাল প্রসেস সেটাকে বলা হয়েছে। সিনেমা বানানোর দুটি প্রসেস রয়েছে একটা বৈজ্ঞানিক দিক আর অন্যটি হল লিটারেচারের দিক। তাদের এই দুটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা ছিল। আর তাদের রুচিবোধটা উঁচু তাড়ে বাধা ছিল। এখনকার প্রযোজকরা এটা বোঝে না। তারা বোঝেন ভালো স্টারকে কাস্ট করতে পারলেই ছবি হিট। কিন্তু এমনটা নয়। তাই এখন অনেক ছবি বড় স্টার থাকা সত্ত্বেও ফ্লপ করেছে।

প্র: বাংলা ছবিতে কনটেন্ট নির্ভর ছবি হচ্ছে। সেগুলি নাকি পাবলিক ডিমান্ড। এটা নিয়ে কী বলবে?

তথাগত: পাবলিক ডিমান্ড যদি হত তাহলে তো বাংলা সিনেমার সুদিন হওয়ার কথা। ধরো, আমি এখন অভিনেতা হিসেবে যে টাকায় কাজ করি তার চেয়ে দশগুণ বেশি  টাকায় কাজ করতাম। কিন্তু সেটা তো সত্যি নয়। সত্যিটা তো আমাদের সামনেই। আমি কয়েকটা কাগজ কিংবা পোর্টালে টাকা দিয়ে পেড রিভিউ করালাম। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হওয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে বাংলা সিনেমা চলছে না। কলকাতার যদি ১০ লক্ষ বাঙালি বাংলা সিনেমা দেখতে যেত তাহলে বাংলা সিনেমার এই অবস্থা হতো না। তার মানে ১০ লক্ষ বাঙালিও বাংলা সিনেমা দেখতে যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় থিয়োরি কোনও প্রোডাকশন হাউজ নাকি হলে চলতে দিচ্ছে না। দুটো হলে চলতে দিচ্ছে। যদি দুটো হলে চলতে দেয় তাহলে তো তোমার সিনেমা হাউসফুল হবেই সেই দুটো শো। কেন হাউসফুল হয় না। আজ অনীক দত্তের 'অপরাজিত' তিরিশ না পঁচিশটা হলে রিলিজ করেছিল আজ কতগুলো হলে রিলিজ করেছে। কারণ মাউথ পাবলিসিটির চেয়ে বড় পাবলিসিটি নেই। অনীক দত্ত কিন্তু এটা দ্বিতীয় বার প্রমাণ করলেন। তার ছবির মান নিয়ে আমি কথা বলছি না। আমি ব্যবসা নিয়ে কথা বলছি। আমার বক্তব্য হল যদি ছবি ভালো হয় তো লোকের মুখে মুখে ছড়াবে।

প্র: মেগা করতে গিয়ে আপনার সবচেয়ে খারাপ এক্সপিরিয়েন্স কী হয়েছে?

তথাগত: শুরুর দিকে টেলিভিশনের একটা প্রজেক্ট করতে গিয়ে খুব তিক্ত একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ফ্লাইট এটেন্টডেন্টদের নিয়ে একটা শুটিং হওয়ার কথা ছিল যার জন্যে আমি হায়দ্রাবাদ গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে কোনও সংলাপ দেওয়া হয়নি। তাছাড়াও খুব বিরক্তিকর পরিবেশ ছিল। আমার একদমই ভালো লাগেনি।

প্র: কোন টেলিভিশনের শোতে কাজ করতে গিয়ে যখন নিজের শিল্প সত্তাকে বিসর্জন দিতে হবে। সেই সময় কীভাবে ম্যানেজ করো নিজেকে?

তথাগত: আমি আসলে নিজের ব্যক্তিগত শিল্প সত্তাকে টেলিভিশনের ফ্লোরে কখনও ক্যারি করি না। শুরুর দিকে করতাম। এখন যখন অভিনয় করতে যাই তখন ওটা নিয়ে ভাবি না। এই প্রশ্নটা আমি বুম্বাদা, অপর্ণা সেন ও চিরঞ্জিতকে করেছিলাম। ওঁরা আমাকে বলেছিল সুউচ অন অফ করার কথা। আমি তখন বুঝতে পারিনি। তবে এখন বুঝেছি। তাই ফ্লোরে যাওয়ার পর আমি ডিরেক্টরের কথা শুনেই কাজ করি।

প্র: পরিচালক হিসেবে ড্রিম প্রজেক্ট বিভূতিভূষণের 'চাঁদের পাহাড়'। যদি সুযোগ পাও কাকে কাস্ট করবে শঙ্করের চরিত্রে?

তথাগত: অবশ্যই একজন নতুন ছেলে হবে। কিন্তু কাকে করব সেটা এখন বলাটা সহজ হবে না। শঙ্করকে আমার খুব একা মনে হয়। কারণ সেই সময় ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলন চলছে। তাই স্বার্থপরের মতো নিজের বাবা, মাকে রেখে বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল শঙ্কর। তবে ইচ্ছা রয়েছে শুধু মাত্র বাংলা নয় সব ভাষাতেই যাতে ছবিটা মুক্তি পায় তা দেখার।

প্র: পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কী বলতে চান আপনি?

তথাগত: শুধু একটা কথাই বলবো যে, চোখ, কান খোলা রাখুন।

এবার র‌্যাপিড ফায়ার রাউন্ডে তথাগত মুখোপাধ্যায়।

প্র: এককাপ চায়ে কাকে চাও?

তথাগত: তোমাকে।

প্র: বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে প্রিয় পরিচালক?

তথাগত: জীবিতদের মধ্যে তরুণ মজুমদার। ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা ও সত্যজিৎ রায়।

প্র: প্ল্যানচেট করলে কাকে করবে? কী বলবে?

তথাগত: ভগবানকে করব। আর জিজ্ঞাসা করবো যে তুমি অনেকগুলো না একটাই।

প্র: নিজেকে এক কথায় কীভাবে ডিসক্রাইব করবে?

তথাগত: ফিলোজফার

প্র: মূর্খ বন্ধু না শিক্ষিত শত্রু?

তথাগত: মুর্খ বন্ধু।

প্র: তোমার সঙ্গে ডেটে যেতে হলে কী কী জিনিস মাথায় রাখতে হবে?

তথাগত: শুধু সেনসিটিভ হলেই যথেষ্ট।

প্র: আজ ঘুম থেকে উঠে প্রথম কোন কাজটা করেছ?

তথাগত: বাঘিরাকে চুমু খেয়েছি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...