কখনও আবৃত্তিকার কখনও সঞ্চালক আবার কখনও তিনি অভিনেতা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তিনি। ইনি হলেন সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সঞ্চালনার পাশাপাশি তাকে আমরা দেখেছি 'বেলাশুরু' ও 'শাহজাহান রিজেন্সি'র মতো ছবিতে অভিনয় করতে। সম্প্রতি জিয়ো বাংলার টলিকথা অনুষ্ঠানে আড্ডা দিতে এসে নিজের জীবনের অজানা কথা সকলের কাছে তুলে ধরলেন সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
প্র: এতো স্বাভাবিকভাবে সঞ্চালনা। বাক শিল্পকে একটা অন্য রূপ দিয়েছেন আপনি। কীভাবে করেছেন?
সুজয়: সঞ্চালনার কাজটা কিন্তু আমি কনসাসলি করা শুরু করিনি। সঞ্চলনাটা আমি শিখেছি দুজনের কাছে চৈতালি দাশগুপ্ত আর শাশ্বতী গুহঠাকুরতা। চৈতালি দাশগুপ্তকে আমি এই ক্ষেত্রে গুরু মনে করি। যে ভাষায় কথা বললে দর্শককে সম্মান দেখানো হবে, তিনি সেই ভাষায় কথা বলতেন। সঞ্চালনাটা কিন্তু তিনি অনেক পরে করেছেন। অ্যানাউন্সার হিসেবে তিনি কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই ঘোষণার মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা ছিল। সঞ্চালক হিসেবে তোমার ভাষায় এই স্বাভাবিকতাটা রাখতে হবে। আর তুমি সঞ্চালক হিসেবে দর্শকদের বিনোদনের উপকরণ কীভাবে সাজাচ্ছ সেটা কিন্তু তোমার উপর নির্ভরশীল। তুমি কিন্তু দর্শকে উপাদেয় কিছু দিতে পারো। তুমি উপাদেয় কিছু দিলে দর্শক সেটা গ্ৰহণ করবে।
প্র: আপনি এতো ভালো একজন সঞ্চালক, তাও আপনি কাউকে শেখাতে চান না কেন?
সুজয়: আমি তো এখন শেখাই। আমি সঞ্চালনা শেখাই না। যে বছর কোভিড পরিস্থিতি শুরু হল দেশে তখন আমার সব কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন একটা সময় আমার মনে হল যে কত মানুষ আমার কাছে কবিতা শিখতে চান। তাই ভাবলাম কাব্যচর্চা তো নিজের জন্য করা হয়। একটু অন্যদের জন্য করলে কেমন হয়। সেটার সূত্র ধরেই কিন্তু আমার অনলাইন আর্টস ক্যালেকটিভ এ পি সি ক্রাফ্টের জন্ম। প্রথমে একটা ওয়ার্কসশ করেছিলাম। আর কিছু দিনের মধ্যে একটা ওয়ার্কশপ হওয়ার কথা রয়েছে। আমি যখন এই ক্যালেকটিভটা সৃষ্টি করলাম তখন আমি জানতাম না যে এতো মানুষ শিখতে চায়। আমি তখন শুধুমাত্র একটা ফেসবুক লাইভে এসে ঘোষণা করেছিলাম যে আমি এই ওয়ার্কশপটা শুরু করবো।
প্র: গুলজারজী আপনার কন্ঠ শুনে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এটা বাঙালি হিসেবে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা। কেমন লেগেছিল আপনার?
সুজয়: আমি যদি কবিতার জন্যে সারা জীবন কোনও পুরস্কার না পাই তাতে আমার কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু গুলজারের সামনে যখন আমি কবিতা পড়েছিলাম তখন আমার মাথায় ছিল একটাই কথা সেটা হল, আমি যে আর্টফর্মটায় বিশ্বাস করি সেটার যেন নজির রাখতে পারি। শিল্প মানুষকে সততা শেখায়। শিল্প মানুষকে সত করে তোলে। তাই সায়নী মিত্র বার বার করে বলতেন আমি সৎ নাট্যে বিশ্বাসী। যে নাট্য জীবনের আয়না তুলে ধরে। আমি তো উর্দু পড়তে পারিনা। তাই গুলজারের উর্দু কবিতার ইংরাজিতে অনুবাদ করা একটি কবিতা সেদিন পড়েছিলাম আমি। তবে গুলজারের সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমার জীবনের একটা বড় মুহূর্ত।
প্র: 'বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব'-এ আপনি নন্দিনীর সংলাপ পাঠ করেছিলেন। সেই পাঠ শুনে এক মহিলা আপনার হাত ধরে কেঁদেছিলেন। কী বলবেন সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে?
সুজয়: আমার মনে আছে আমি নিউইয়র্কের একটি হোটেলে আমি 'রক্তকরবী'র নন্দিনী চরিত্রটি পাঠ করছিলাম। আমার মনে হয় একজন অভিনেতা যখন নিজের সংলাপের নৈঃশব্দটা খুঁজে পাবে তখন সে অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারবে। আমিও চেষ্টা করি সেটা করার।
প্র: আপনি একজন দুর্দান্ত অভিনেতা। নাটকে অভিনয় করেছেন।
সুজয়: তোমার টলিউড সেটা মনে করে না। তুমি তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিও যে ‘আমি ভালো অভিনেতা’। ফিল্মফেয়ারের এডিটর সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, 'শাহজাহান রিজেন্সি'তে দুজনের অভিনয় স্মরনীয় হয় থাকবে। একজন হলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ও সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। অথচ আমি কিন্তু কোনও পুরস্কারের জন্য ডাক পাইনি। নমিনেশনও পাইনি। তবে ঐ কাজটি করে আমি একটা সমষ্টির কন্ঠ স্বর হয়ে উঠেছি। এখনও আমার ঐ কাজ দেখে তারা অনেক সাহস পেয়েছেন। আমি তাদের সাহস দিতে পেরেছি। এটাই আমার অ্যাক্টিভিজম।
প্র: 'শাহজাহান রিজেন্সি'তে এমন একটা ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছ। এই ছবির শুটিংয়ের মেমরেবল কিছু ঘটনা শেয়ার করুন?
সুজয়: আমার যেদিন শেষ শুটিং ছিল সেদিন সকলে আমার অভিনয় দেখে হাততালি দিয়েছিলেন। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর আমার স্কুলের বন্ধু পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রশংসা করেন আমার কাজের জন্য।
প্র: প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে আপস অ্যান্ড ডাউন একটা বেসিক জিনিস এটা হবেই। আপনার জীবনেও এসছে। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলো সম্পর্কে শুনতে চাই?
সুজয়: যে কোনও সম্পর্কে যদি তুমি নিজেকে পাপস করে তোলো তাহলে তার জন্যে তুমি রেপন্সিবেল অন্য মানুষটি নয়। তাই নিজেকে ভালোবাসাটা জরুরি। কোনও বই তোমাকে মোটিভেট করতে পারবে না। তোমাকে নিজেকেই মোটিভেট করতে হবে। তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু আমি অনেককে ক্ষমা করে দিয়েছি। তবে ঘটনাগুলো ভুলে যায়নি।
প্র: আপনার চোখে আদর্শ নারী বা আদর্শ পুরুষ বলতে কী বোঝায়?
সুজয়: আমি অবশ্য লিঙ্গ বিভেদে বিশ্বাস করি না। তাহলে যদি আদর্শ নারী বলতে হয় সেটা হবে 'মা'। আমার মা আমাকে নির্ভিক হতে শিখিয়েছেন। আমার মা আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করাতে শিখিয়েছেন। আমার মা আমাকে সাবলম্বী হতে শিখিয়েছেন। আমার মা আমাকে স্ব-শিক্ষিত হতে শিখিয়েছেন। তাই মা আমার কাছে আদর্শ নারী। এছাড়াও আমার দিদি অনুরাধা সেন আমার কাছে একজন আদর্শ নারী। তিনি আমাকে আমার যৌন প্রবৃত্তি সম্পর্কে কনফিডেন্ট হতে শিখিয়েছেন। আদর্শ পুরুষ খুঁজে পাইনি।
প্র: আপানার চোখের কল্পনায় কে আদর্শ পুরুষ?
সুজয়: জর্জ ক্লুনি। আমার ক্রাশ।
এবার র্যাপিড ফায়ার রাউন্ডে কিছু ফাস্ট কোয়েশ্চেনের উত্তর দেবেন সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
প্র: নীরবতা না স্পষ্ট কথা?
সুজয়: স্পষ্ট কথা
প্র: থিয়েটার না সিনেমা?
সুজয়: থিয়েটার।
প্র: ‘বেলাশেষে’ না ‘বেলাশুরু’?
সুজয়: বেলাশুরু।
প্র: পাহাড় নাকি জঙ্গল?
সুজয়: পাহাড়।
প্র: অমিত-লাবণ্য না নন্দিনী?
সুজয়: নন্দিনী।