সমিধ-উর্ভী ‘পাওয়ার কাপল’

একসময় একের পর এক হিট বাংলা গান উপহার দিয়েছেন তিনি। 'খোকাবাবু' হোক বা 'লাভরিয়া' ছবির 'ও সোনা' শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছে সেই গান। তিনি হলেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় মিউজিক ডিরেক্টর সমিধ মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি জিয়ো বাংলার টলিকথা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমিধ মুখোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী গায়িকা উর্ভী। জিয়ো বাংলার ‘টলিকথা’য় নিজের জার্নি ও পেশাদারী জীবন কথা বললেন তাঁরা।

প্র: মিউজিক কম্পোজার, সিঙ্গার, মিউজিক ডিরেক্টর একাধারে সব কিছু। কিন্তু শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
সমিধ: এতো বিশাল গল্প। যারা বোধহয় কিছু পারে না তাদের মনে হয় গান বাজনাই হয়। ছোটবেলায় পড়াশোনায় মন ছিল না। জোর করে আমাকে ল-কলেজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তবে আগে থেকেই নিজের ব্যান্ড শুরু করেছিলাম। তখন থেকেই গান বাজনা করতাম। কতটা পারতাম জানি না কিন্তু তাও করতাম। কীভাবে যে সব কিছু হয়ে গেল জানি না। তবে প্রথম দিকের ফেজটা অটোমেটিক্যালি হয়েছে। বাবা-মা কখনও বলেনি যে এটাই করতে হবে। নিজের মতো বেড়ে উঠেছি। প্রথমে 'ব্যান্ডস' তারপর 'পরশপাথর'। এই 'পরশপাথর'-এর গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার 'হিপ পকেট' বলে একটা ব্যান্ড ছিল যেখানে আমি ইংরেজি গান গাইতাম। তারপর হঠাৎ করে একদিন মনে হল যে আমার বাবা-মা ও আশেপাশের সকলে জানে না যে আমি গান করি। তাই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। তখন আমি বাংলা সিনেমা দেখা শুরু করলাম। সেই সব দেখেই আমি ভাবলাম মিউজিক ডিরেক্টর হব। একবার বলেও ছিলাম যে আমি মিউজিক ডিরেক্টর হওয়ার অ্যাক্টিং করি। আর অ্যাক্টিং করতে করতে সত্যিই হয়ে গিয়েছে।

প্র: উর্ভীদি, আপনার ছোটবেলাটা কেমন ছিল?
উর্ভী: আমার বাড়ি বাঁকুড়াতে। সেখানে আমার বাবা, মা, ভাই, বোন সকলেই থাকেন। আমি একটা ছোট হ্যাপি ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি। আমার ঠাকুরদা-ঠাকুমা ও দিদিমা সকলে এক সঙ্গেই থাকতেন। আমার এক পিসতুতো দাদাও আমাদের সঙ্গে থাকতেন। গান, বাজনা, নাচ, কবিতা এই সব কিছুই আমি জন্মের পর থেকে দেখে এসেছি আমাদের বাড়িতে। আমার মা নৃত্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমার বাবা এখনও আবৃত্তির সঙ্গে জড়িত আছেন। বাঁকুড়া এমনিতেও ক্যালচারালি খুব রিচ। পড়াশোনাও শিখেছি, গান, বাজনা করেছি। কিন্তু গান, বাজনাকে কখনও প্রফেশন হিসেবে বেছে নেব ভাবিনি। হঠাৎ করেই এটা করেছিলাম ছোট থেকে এটা ভাবিনি। ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখতাম অনেক প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছি। কিন্তু আমার ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখতে একদমই ভাল লাগত না। আমার বাবা বলেই দিয়েছিলেন যে পড়াশোনা না শেষ করে গান নিয়ে এগোনো যাবে না। ঠাকুরদার ইচ্ছা ছিল আমি 'ল' নিয়ে পড়ি। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় আমার মনে হয়েছিল যে আমি সিঙ্গার হব।

প্র: আপনাদের দুজনের কেমিস্ট্রির পূর্বরাগ সম্পর্কে জানতে চাই।
সমিধ: কিছু কিছু জিনিসের পূর্ব রাগ হয়তো হয় না। আমি মিউজিক ডিরেক্টর আমার পরিচালনায় অনেকেই গান রেকর্ড করতে আসেন। উর্ভীও এসেছিল। উর্ভীর সঙ্গে ওর বয়ফ্রেন্ডও ছিল। কিন্তু আমি কখনই বিশ্বাস করতাম না যে একজন সিঙ্গারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানো উচিত। আমার কাছে একজন মিউজিক ডিরেক্টর আর সিঙ্গারের সম্পর্কটা হল টিচার আর স্টুডেন্টের সম্পর্ক। তবে আমাদের মধ্যে প্রেমের পূর্বরাগ ছিল না প্রথমে। চেনেশোনা ছিল।
উর্ভী: আমি এখন ভাবি কেন এতো তাড়াতাড়ি ‘হ্যাঁ’ বলেছি।

প্র: উর্মিদি, সমিধদা আপনার হাজবেন্ড। কিন্তু একসঙ্গে কাজ করার সময় সমিধদা কেমন?
উর্ভী: একই রকম। বরং আমিই খুব রেগে যাই। ধরো একটা গান গাইছি। তখন যদি দেখেছি কথা বলার মধ্যে নম্রতা নেই তক্ষুনি গান গাওয়া বন্ধ করে দিই। বলি, ‘তুমি এবার গাও’।

প্র: সমিধদা বৌকে কতটা ভয় পায়?
সমিধ: এটা আবার বলতে হবে! আমি দেখো ঝগড়াঝাঁটি বেশি করা পছন্দ করি না। মহিলারা এমনিতেই একটু....
আমরা শিবের ভক্ত তাই শান্ত থাকাই ভালো।

প্র: এমনিতেই মিথ রয়েছে পৃথিবীতে এমন কোনও পুরুষ নেই যারা তার বৌকে ভয় পায় না। আপনাদের কী এমন কোনও মজার ঘটনা রয়েছে।
সমিধ: রোজ এতো ঘটনা হয়ে যে সেগুলোই মনে বাস্তব আর নরম্যাল।
উর্ভী: আমার মনে হয় ছেলেরা খুব শান্তিপ্রিয় হয়। তাই তারা শান্তিটাকে বিঘ্ন করতে চায় না। কিন্তু এখন এটা প্রচলিত হয়ে গিয়েছে যে তারা বৌদের ভয়ে পায়। আর বৌগুলো হয়ে যায় ‘মনস্টার’। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
সমিধ: শান্তিপ্রিয় মানে কেউ অশান্তি তো করছে। তাই জন্যেই ভয় করে। আসলে দুজন কোথাও বেরোনোর সময় ওকে অনেক আগে থেকে বলতে রেডি হতে বলতে হয়। ধরো কোনও শো বা মিটিং-এ যাওয়া আগে সাড়ে ছয়টায় সময় বেরোতে হলে আমাকে অন্তত ছয়টার আগে আমাকে ওকে রেডি হতে বলতে হয়। তবে সেই বলার একটা পদ্ধতি রয়েছে। কোথাও বেরোনোর আগে আমারও ল্যাদ লাগে কিন্তু তাও আমি সময় মতো রেডি হয় যাই।

প্র: ‘হাজবেন্ড’ হিসেবে সমিধদা কেমন?
উর্ভী: ‘হাজবেন্ড’ হিসেবে বলতে পারবো না। কিন্তু পার্টনার হিসেবে খুবই ভালো। মানে কেয়ারিং, সহ্যশীল। ওর খুব ধৈর্য্য রয়েছে। কারণ আমাকে কিন্তু ট্যাকেল করা সত্যিই খুব কঠিন। আমি নিজেও সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু ও পারে। আমি এটা ওকে আগেও বলেছি। কিন্তু কখনও কখনও যখন অনেক কাজ চলে আসে তখন মনে হয় আমাকে ও পাত্তা দিচ্ছে না। তবে ওভারল "হি ইজ অ্যা ভেরি গুড হাজবেন্ড।"

প্র: আপনারা সম্প্রতি 'পাওয়ার কাপল অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছ। কেমন লেগেছে এই অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর?
উর্ভী: খুবই ভাল লাগছে। কিন্তু ওরা যে ‘পাওয়ার কাপল’ মেনশান করে আমাদের অ্যাওয়ার্ডটা দিয়েছে। সেটা কিন্তু আমার সত্যিই মনে হয়। যখন একা একা একটা কাজ করতে পারবো না বলে মনে হয়, তখন সেটা ওর সঙ্গে করলে মনে হয় যে মোস্ট পাওয়ারফুল জিনিস এটা হতে চলেছে। আমার নিজেরই মনে যে 'উই আর পাওয়ারফুল' আর কেউ আমাদের হারতে পারবে না।
সমিধ: আমি একটা কথা বলতে চাই। যেমন আমার  একটা যাত্রা বা জার্নি ছিল তেমন ওর একটা জার্নি ছিল। এই যাত্রা বা জার্নিতে তো আমরা একটা থাকি না‌। আমাদের ফ্রেন্ডস, অভিভাবক যাদের জন্য আমাদের অস্তিত্ব। আমি তাদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ। সবচেয়ে বড় কথা, অডিয়েন্স বা দর্শকরা আমাদের অ্যাকসেপ্ট করেছে। যার জন্যে আমরা হয়তো 'পাওয়ার কাপল'।
উর্ভী: আমার মনে হয় 'ইটস পাওয়ার অফ লাভ'। আস্তে আস্তে যখন আমাদের জার্নিটা শুরু হয়েছে তখন ও কিছুটা আমার মতো হয়েছে আমি কিছুটা ওর মতো হয়েছি।

প্র: 'সড়ক-২'তে কাজের এক্সপিরিয়েন্সটা আমাদের একটু শেয়ার করুন।
সমিধ: 'সড়ক-২'-এর কাজটা হঠাৎ করে হয়েছিল। মহেশ ভট্টের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এই সুযোগ এসেছিল। সত্যি কথা বলতে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু কোনও এক সময় নেগিটিভিটি চলে এসেছিল। একটা সময় এতো হিট গান দেওয়ার পরেও কোন গানের অফারই আসত না ইন্ডাস্ট্রি থেকে। এলেও তা অ্যাপ্রুভ হতো না। এই অবস্থায় আমি কী করতে পারি? এমন নয় যে আমার কাছে শো ছিল না। ঈশ্বরের কৃপায় সেই সময় অনেক শো করেছি আমি। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও কাজ নেই আমার। তখনই আমাকে ফোন করেছিলেন মহেশ ভট্ট। তারপর বম্বেতে আমাকে ডাকা হয়। সেখানে প্রথম 'নামকরণ' সিরিয়ালের মিউজিক দেওয়ার পর 'সড়ক-২'র মিউজিক দিয়েছিলাম আমি।

প্র: এখনকার কাপলদের মধ্যে আমরা ওঠাপড়া দেখতে পাই। যদি একই প্রফেশন হয় তাহলে সেটা আরও বেশি দেখা যায়। সেখানে আপনাদের মধ্যে এতো ভালো একটা বন্ডিং। সেখানে ইয়ং কাপলদের কী সাজেশন দেবেন?

উর্ভী: এক প্রফেশন বা আলাদা, প্রফেশন যাই হোক না কেন। জীবনের প্রায়োরিটিটা সেট করা খুব প্রয়োজন। আমার যদি অনেক টাকা রোজগার বা এখানে ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে রিলেশনশিপে না আসাই ভালো। কারণ রিলেশনশিপেও থাকব উড়নচণ্ডী হয়ে ঘুরে বেড়াব, এটা হয় না। আমার জীবনে প্রায়োরিটি ঘুম, খাওয়া, জীবনে প্রেম থাকা আর শপিং করে ওঠার মতো টাকা চলে আসলেই যথেষ্ট। এছাড়া আমার কোনও এক্সপেক্টেশন নেই।

সমিধ: পারফেক্ট বলে কিছু হয় না। কাল কী হবে আমরা জানি না। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা, রিলেশন এটার কথা যদি বলি। প্রত্যেকটা কবিতা, গানে আমরা ভালোবাসাকে একটা গুরুত্ব দিই। কিন্তু ভালোবাসায় যখন আমি চলে আসে তখন আর ভালোবাসা থাকবে না।

শেষ করার আগে একটা মিষ্টি গেম খেলব আপনাদের সঙ্গে।

প্র: কে বেশি রাগ করে?
সমিধ: উর্ভী।

প্র: কে বেশি ম্যাচিয়োর?
সমিধ: কিছু কিছু জিনিসে ও ম্যাচিয়োর। কিছু কিছু জিনিসে ও ম্যাচিয়োর।

প্র: কে বেশি ইমোশনাল?
উর্ভী: আমি একটু বেশি ইমোশনাল।

প্র: কে বেশি খেতে ভালোবাসে?
সমিধ: উর্ভীই বেশি ভালোবাসে।

প্র: কে আগে সরি বলে?
উর্ভী: সমিধ।

প্র: কে আগে প্রপোজ করেছে?
উর্ভী: সমিধ।

প্র: কে বেশি খুঁতখুঁতে?
সমিধ: ও খুঁতখুঁতে।

প্র: কে বেশি অগোছালো?
সমিধ: আমি‌ একটু অগোছালো।

প্র: কে বেশি রোম্যান্টিক?
উর্ভী: আমার মনে হয় আমিই বেশি।

প্র: কে বেশি চিৎকার করে?
উর্ভী: আমি।

প্র: কে ভালো রান্না করতে পারে?
সমিধ: ও খুব ভালো রান্না করতে পারে।
উর্ভী: ও খুব ভালো রান্না করে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...