দিল্লিতে ছোটবেলা কাটিয়েছেন। কিন্তু বাংলা সিনেমা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর মেধা ও চর্চা প্রশ্নাতীত। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি অভিনেতা। কিন্তু অভিনয়ের পাশাপাশি কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি অন্যমাত্রার। সুপারহিরো চরিত্র 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা'র ভয়েস ডাবিং করেছেন তিনি। অভিনীত বাংলা ছবি 'বিলু রাক্ষস' দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অভিনেতার নাম জয় সেনগুপ্ত। জিয়ো বাংলার ‘টলিকথা’ অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের অজানা দিকগুলো তুলে ধরলেন অভিনেতা।
প্র: 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা'র ভয়েস আর্টিস্ট আপনি। কীভাবে এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন?
জয় সেনগুপ্ত: যখন শুরু হয়েছিল 'অ্যাভেঞ্জার্স', তখন কেউ জানত না যে এটা এতটা সাকসেসফুল হবে। মার্ভেল 'স্পাইডারম্যান দিয়ে নিজের যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর ওরা 'অ্যাভেঞ্জার্স'টা একটা এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই করেছিল। কিন্তু কোনও ভাবে ভারতীয়দের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ছবিটি। তারপর 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা' এসেছে, 'আয়রনম্যান' এসেছে। সবগুলোই খুব পছন্দ হয়েছে ভারতীয় দর্শকদের। 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা'র ভয়েস হিসেবে আমার গলাও সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। মাঝখানে বরুন ধাওয়ান একটি ছবিতে 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা'র ভয়েস দিয়েছিল। কিন্তু সেটা রেসপন্স পায়নি। তাই আমাকে আবার ফিরিয়ে এনেছিল তারা। সেই ছবিটা ছাড়া আমি প্রত্যেক ছবিতেই ক্যাপ্টেন আমেরিকার ভয়েস দিয়েছিলাম। তার আগেও আমি অনেক বড় বড় হলিউডের ছবিতে ভয়েসিংয়ের কাজ করেছি। ‘২০১২’। ‘এ টিম’র মতো জনপ্রিয় ছবি ডাব করেছিলাম আমি। তবে অনেক সময় অন্য কাজের জন্যেও ভয়েসিংয়ের কাজ করা হয়ে ওঠেনি।
প্র: আপনি ভয়েস ডাবিংয়ের পাশাপাশি নাটক ও ছবিতে অভিনয় করেন। এত কিছু কীভাবে সামলান?
জয় সেনগুপ্ত: এটা খুবই সহজ। তুমি যদি কোনও জিনিস বিশ্বাস করো, সেটার উপর যদি তুমি নিজেকে উজাড় করে দাও, তাহলে কখনও বাধা আসবে না। তুমি যেটা করছ সেটাকেই অনেস্টলি তোমার সময় দিতে হবে। যেমন- আমাকে একজন বেঙ্গালুরু থেকে ফোন করে বলেছেন যে একটি নাটক করার জন্য। তিনি নিজেই সেই নাটকটা লিখেছেন। আমি তাঁকে বলেছি আমার যদি ভাল লাগে তাহলে নিশ্চয়ই নাটকটা করব। আমি বিশ্বাস করি মানুষের মধ্যে বিভিন্ন এবিলিটি রয়েছে। এক সময় ভারতীয় সমাজে যে ধরনের অভিনেতারা বেরতেন তাঁরা গান, নাচ, অভিনয়, লেখালেখি ও স্টেজ সাজাতে পারতেন। তাই থিয়েটার আর্টিস্ট হিসেবে আমি আমার সব রকমের স্কিল ডেভেলপ করার স্কোপ পেয়েছি ও চেষ্টা করেছি। সারা দিন আমি প্রায় কুড়ি ঘন্টা শুধুমাত্র নাটক রিলেটেড কাজ করেছি। আমি নিজেকে অনেকটা সময় দিয়েছি শেখার জন্যে। আমার বাবা-মা ছোটবেলা থেকেই একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নজরুল গীতির চল ছিল আমার বাড়িতে। বাংলা সাহিত্য আমার বেস ছিল। তারপর আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছি। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতি আমার শিকড়। তাই আমি বাংলা ছবি করি।
প্র: প্রাইম টাইম থিয়েটার গ্ৰুপের সঙ্গে আপনি অনেক দিন ধরেই জড়িত। সেখানে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
জয় সেনগুপ্ত: ড্রামা কোর্স শেষ করার পরেই আমার কাছে টেলিভিশন থেকে অনেক কাজের অফার আসে। একটা সিরিয়ালের কাজের অফার পেয়েছিলাম যেটার শুটিং হচ্ছিল দিল্লিতে। সেখানে লিলেট দুবের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানে সে আমাকে একটা ইংলিশ নাটকে কাজ করার কথা বলেন। নাটকটার নাম হল 'ডান্স লাইক আ ম্যান'। তখনকার দিনে ইংরেজি নাটক সেভাবে কেউ দেখতেন না। কিন্তু আমাদের এই নাটকটা হাউজফুল শো করেছিল বহুদিন। সাহিত্য কলা পরিষদ থেকে সেরা নাটকের পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল। এই নাটকটা করে আমার অনেক সুনাম হয়েছিল। আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডে, অস্ট্রেলিয়াতে আমরা এই নাটকের শো করেছি। এবছরেও জুলাই মাসে আমাদের একটা শো রয়েছে। আসলে সেই সময় নাটকটার জন্য আমি অনেক খেটেওছিলাম। এই নাটকের পর আমি লিলেটের সঙ্গে আরও সাতটা নাটক করেছিলাম।
প্র: অনেক জায়গায় দেখা গিয়েছে পার্শ্বচরিত্র হয়েও প্রধান চরিত্রকে ছাপিয়ে গিয়েছে আপনার অভিনয়? তোমাকে মূল চরিত্রে দেখতে পাই না কেন?
জয় সেনগুপ্ত: আমি সিনেমাকে সবচেয়ে সুন্দর ও পাওয়ারফুল আর্টের মর্যাদা দিয়ে থাকি। আমি মনে করি সিনেমা এমন একটা আর্ট যেটা একজন ব্যক্তি বানায় না। অনেক জন আর্টিস্ট একসঙ্গে একটা সিনেমা বানান। আর্টিস্টদের মধ্যে প্রধান হলেন ডারেকটর। আমি যখন সিনেমা দেখি তখন ভাবি অভিনেতার কথাই বলি। সিনেমার আসল আর্টিস্ট কিন্তু সিনেফ্যাটগ্ৰাফার। অভিনেতা কীভাবে অভিনয় করেছে এই সব কিছুই ক্যামেরায় তুলে ধরার দায়িত্ব তার। তবে আমি যদি ছবিতে অভিনয় করি তাহলে তার গল্প আমার পছন্দ হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে নতুনদের এনক্যারেজ করতে আমরা কাজ করি। কারণে তাতে তারা আরও ভাল কাজ করতে পারবে।
প্র: আগে যে ধরনের বাংলা ছবি তৈরি হত, এখন সেই ধরনের বাংলা ছবি তৈরি হয়ে না। আপনার কী মনে হয় কোথায় বাংলা সিনেমার দূর্বলতা?
জয় সেনগুপ্ত: বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ হল ৬০ ও ৭০ দশকের ছবি। আমি বম্বেতেও অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারাও একই কথা বলেছেন। সেই সময় বম্বের ছবিগুলিও বাংলা ছবি থেকে ইন্সপায়ার হয় তৈরি করা হত। ছবিগুলোতে খুব ডিটেলিং ছিল। কিন্তু সময়কে ধরে রাখা যায় না। ভালো সময়ের মতো খারাপ সময়ও আসতে পারে। এখন বাস্তবটাকে ধরার চেষ্টা খুব কম করা হচ্ছে। আমাদের চারদিকের যে সামাজিক পরিস্থিতি সেটা হয়ত সিনেমায় তুলে ধরা হচ্ছে না।
প্র: কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে কী কী পরিবর্তন দরকার বলে মনে হয়?
জয় সেনগুপ্ত: কলকাতায় আগে ডাবিং কালচারটা বন্ধ করা দরকার। শুটিং ফ্লোরের কাছাকাছি এতো হট্টগোল চলে অভিনয় মনযোগ দিতে একটু অসুবিধা হয়। এছাড়াও ছবির স্ক্রিপ্ট অভিনেতা ছাড়াও শুটিং ফ্লোরে উপস্থিত সকলকে দিতে হবে। যাতে তারা জানতে পারে কী নিয়ে তারা কাজ করছে। তাহলেই সবাই কাজটা আরও ভাল ভাবে করতে পারবে।
এবার র্যাপিড ফায়ার রাউন্ডে কোয়েশ্চেনে অভিনেতা জয় সেনগুপ্ত।
প্র: পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে কোন চারটে কাজ আপনি করতে চাইবেন?
জয় সেনগুপ্ত: খেতে চাইব, স্নান করতে চাইব, আমার বাড়িতে সাড়ে তিন হাজার বই পড়ে রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু বইটা আগে শেষ করতে চাইব আর যে কয়েকজন লোকের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি তাদের সঙ্গে দেখা করব।
প্র: অদৃশ্য হওয়ার শক্তি পেলে কী করবে?
জয় সেনগুপ্ত: সর্বশ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলো দেখব, শ্রেষ্ঠ আর্ট কালেকশনগুলো দেখব, পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরে আসব।
প্র: স্টেজ না লাইটস-ক্যামেরা-অ্যাকশন?
জয় সেনগুপ্ত: দুটোই।
প্র: এক প্লেট বিরিয়ানির সঙ্গে কাকে চান?
জয় সেনগুপ্ত: প্রিয় বন্ধু-বান্ধবরা থাকলেই হবে।
প্র: পাহাড় না সমুদ্র?
জয় সেনগুপ্ত: পাহাড়ে আমি বড় হয়েছি। কিন্তু সমুদ্রের কাছে তুমি রিলেক্স হয়ে যেত পারো।
প্র: ‘শহরের উপকথা’ না ‘বিলু রাক্ষস’?
জয় সেনগুপ্ত: দুটোই আমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট।
প্র: কোয়ালিটি না কোয়ান্টিটি?
জয় সেনগুপ্ত: নিশ্চয়ই কোয়ালিটি।