শহর কলকাতা আমাদের সকলেরই চেনা। কিন্তু এই শহরেই রয়েছে আরও একটি শহর, সেই শহর ও আমাদের সকলের কাছে অচেনা। এমনকি সেখানকার মানুষগুলো ছিল অচেনা। পরিচালক ঈশান ঘোষ ছবি পর্দায় নিয়ে এসেছেন। ছবির নাম 'ঝিল্লি'। পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবিতেই ঈশান কলকাতার ধাপার জনজীবনের কাহিনীকে সকলের সামনে তুলে ধরেছে। মুক্তির আগেই ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির শিরোপা পেয়েছে 'ঝিল্লি'। এবার সেই ছবির শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা টলি কথার আড্ডায় শেয়ার করলেন পরিচালক।
প্র: 'ঝিল্লি'র এই সাফল্য কী এক্সপেক্টেড ছিল?
ঈশান ঘোষ: আমাদের কোনও এক্সপেক্টেশন ছিল না। ফিল্মটা শেষ হবে কিনা- এটাই ঠিক ছিল না। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা তাগিদ ছিল ভাল কিছু করবার। সেই জন্যই হয়তো কাজ করতে পেরেছি।
প্র: পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করার সময়ই এমন বক্ররেখায় চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়নি?
ঈশান ঘোষ: না, কারণ 'ঝিল্লি' বানানোর আগে আমি বেশ কয়েক বছর ক্যামেরা অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। আমার যে রকম ধরনের মিউজিক ভাল লাগে বা সিনেমা ভাল লাগে। সেই ধরনের ছবিই আমি বানাতে চাই। এছাড়াও আমাদের কলকাতাকে আমরা সকলে চিনি। কিন্তু এখানেও এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের গল্পগুলো সম্পর্কে অনেকে জানেন না। তাদের গল্প আমি দেখিয়েছি এই ছবিতে।
প্র: এখন তো হ্যাশট্যাগ চালানো হচ্ছে বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তাই এই সময় ছবি বানিয়েছ বলে, কী তোমার ভয় হয়নি- প্রযোজকরা পাশে থাকবে কিনা?
ঈশান ঘোষ: আমাদের ছবির বাজেটই খুব কম ছিল। সেই জন্য কীভাবে রিকভারি করব এই চিন্তাটা মাথায় আসেনি। হয়তো প্রযোজক ছিল না বলেই আমরা অনেক স্বাধীন ভাবে কাজটা করতে পেরেছি।
প্র: আমাদের শহরের মধ্যে থাকা অচেনা রুক্ষ শহরটাকে কীভাবে এক্সপ্লোর করলে?
ঈশান ঘোষ: ২০১৬ সাল নাগাদ আমি একটা ডকুমেন্ট্রি শ্যুট করছিলাম তিলজলায়। তখন ওখানে যারা আবর্জনা পরিষ্কার করে তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমি তাদের কাছে তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। আমি এই সব কিছুই আগে জানতাম না। তাই কী ধরনের স্ট্রাগেল করতে হয়ে তাদের সেটা সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম।
প্র: এই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবন যাত্রার অনেক ঘটনাই তুমি দর্শকদের দেখাতে পারনি। সেই রকম হার্ট টাচিং কিছু ঘটনা আমাদের সঙ্গে শেয়ার কর।
ঈশান ঘোষ: কিছু কিছু ঘটনা এমন ছিল যেগুলো আমরা হয়তো কখনই সাধারণ মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে পারব না। তবে একবার আমরা একটা ফুটেজ শ্যুট করেছিলাম যেখানে ওরা একটা শুয়োর ধরে সেটাকে কেটে ছিল। পুরো ঘটনাটা আমরা রেকর্ড করেছিলাম।
প্র: তুমি প্রথমে তথ্যচিত্র বানাবে ভেবেছিলে?
ঈশান ঘোষ: না, আমি আমার অ্যাক্টরদের বলতাম ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে হাড়ের ফ্যাক্ট্রিতে কাজ করতে। ও কাজ করত আর আমি শ্যুট করতাম। এভাবেই কাজ করেছি আমরা।
প্র: স্ক্রিপ্ট ছাড়া কাজ হয়েছে। তাহলে শ্যুটিংয়ের পর পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ কীভাবে হয়েছে?
ঈশান ঘোষ: ওখানে ফ্যাক্টরির সামনে একটা মাঠ তৈরি হচ্ছিল। সেটা তৈরি হলে ওদের সকলের কাজ চলে যাবে আর সকলেই নিজেদের বাড়ি ফিরে যাবে। আমি এই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই গল্পটা সাজিয়েছি। কিন্তু এই পুরো বিষয়টাকে একটা স্ট্রাকচার দেওয়ার কথা মাথায় এসেছে এডিটিংয়ের সময়।
প্র: ছবিতে একটা মৃত পশুর হাড়ের উপর শুয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে অভিনেতাদের। এটার শ্যুটিং হল কীভাবে?
ঈশান ঘোষ: ওটা কিন্তু আসল হাড় ছিল। আমাদের যে অ্যাক্টর ছিল তাকে যা বলেছি তাই করেছে। কোনও ভয় ছিল না। ও নিজেই ওই হাড়ের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তারপর আমি ওর গায়ের উপর আরও হাড় চাপা দিয়ে দিয়েছিলাম।
প্র: পরিচালক গৌতম ঘোষ যদি প্রযোজক হিসেবে এগিয়ে না আসতেন তাহলে পুরো বিষয়টাকে কীভাবে এগজিকিউট করতে?
ঈশান ঘোষ: আমরা ২০১৯ সালে ভেবেছিলাম ছবির পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু করব। সেটা করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালে আমি পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু করেছিলাম। তখন আমি ওঁকে আমাদের কাজের রাফ ফুটেজটা দেখিয়েছিলাম। সেটা ওঁর খুব পছন্দও হয়েছিল। তাই আমাদের অনেক হেলপ করেছিলেন। আর একদম স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন।
প্র: 'ঝিল্লি' ও 'দোস্তজী'র মতো ছবির জন্য কোনও প্রযোজক এগিয়ে আসেন না। তাহলে কী আমাদের ইন্ডাস্ট্রি রত্নদের চিনতে পারে না?
ঈশান ঘোষ: আসলে আমাদের কলকাতায় এই ধরনের প্রযোজকের খুব অভাব রয়েছে যারা শুধুমাত্র ছবি ভালবাসে বলে ইনভেস্ট করেন। তাই আমার মনে হয় কম বাজেটের ছবি তৈরি করাই উচিত। তাহলে পরিচালকের উপর চাপটাও কম থাকবে।
প্র: তুমি একটু আগে বললে আমাদের বাংলার প্রযোজকরা ছবিটা দেখেও বুঝতে পারেন না। সেই ছবির ভবিষ্যতটা কী? তাহলে কী তাদের ফিল্ম নিয়ে আরও বেশি পড়াশোনা করা দরকার রয়েছে?
ঈশান ঘোষ: আসলে আমাদের কলকাতায় যে ধরনের দর্শক তৈরি হয়েছে লাস্ট দশ বছরে তারা এক ধরনের সিনেমায় দেখেছে। তাই এখন ওয়ার্ল্ড সিনেমা অ্যাসথেটিকে তৈরি ছবির দর্শক তৈরি হতে একটু সময় লাগবে।
প্র: কলকাতার কোনও ছেলে-মেয়ে যদি 'ঝিল্লি' বা 'দোস্তজী'র মতো ছবি বানাতে চায়। তাকে কী অ্যাডভাইস দেবে তুমি?
ঈশান ঘোষ: গান, নাচ অথবা ফিল্ম মেকিং যে যাই করুক না কেন তাকে অবশ্যই নিজের স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য কাজের প্র্যাকটিসটা চালিয়ে যেতে হবে।
প্র: আগেও তুমি তোমার বাবা ছবিতে ডিওপি ছিলে। তাই ছোটবেলা থেকে ফিল্ম মেকিং নিয়ে তোমার চর্চাটা কেমন ছিল?
ঈশান ঘোষ: ১২ বছর হয় গিয়েছে আমি কাজ করছি। প্রথমে আমি শুরু করেছিলাম অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে। প্রথমে তিন বছর আমার দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র ক্যামেরা ক্যারি করা। তারপর ছোট ছোট ডকুমেন্ট্রি বানানোর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি। আর এই কাজের সুবাদে সারা ভারতবর্ষে ঘুরেছি।