পুনের আগা খাঁ প্যালেসে বন্দি গাঁধীজি, সব রকম ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, এমনকি তাঁর দেহাবসান আসন্ন জেনে ইংরেজ জেলর তাঁর সৎকারের অগ্রিম পরিকল্পনা করে তাঁর জন্য চন্দন কাঠও আনিয়ে রেখেছেন। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই গাঁধীজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায়। গাঁধীজিকে অনুরোধ করলেন ওষুধ খাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি অটল। বেশ রাগী ভাবে ডঃ রায়কে বলেছিলেন, “কেন আমি তোমার কথা শুনব? তুমি কি এদেশের চল্লিশ কোটি মানুষকে আমার মতো বিনামূল্যে চিকিৎসা করো?” বিধান চন্দ্র রায় উত্তরে বলেছিলেন, “ সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। মোহন দাস করম চাঁদ গাঁধী’কে চিকিৎসা করার জন্য এখানে আসিনি। আমি এসেছি এমন একজনকে চিকিৎসা করতে যিনি আমার দেশের চল্লিশ কোটি মানুষের প্রতিনিধি।“
গাঁধীজি গোঁ সরিয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, “মফসসল আদালতের থার্ড ক্লাস উকিলের মতন তর্ক করছ। ঠিক আছে। ওষুধ নিয়ে এসো আমি খাবো।“
ডঃ বিধান চন্দ্র রায়। মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গাঁধী, বল্লভভাই প্যাটেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বদের চিকিৎসা করার পাশাপাশি তিনি যেভাবে অসহায়, আর্ত, সেবাপ্রার্থী মানুষের সেবায় নিজেকে ব্রতী করেছিলেন তা সর্বজন বিদিত। সীমাহীন প্রতিভা, সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব, গভীর হৃদয়, মানুষের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা, অবাক করা পরিশ্রমের ক্ষমতা এবং পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি দৃষ্টান্তমূলক, পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান।
গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন বিধানচন্দ্র সম্বন্ধে এতই মুগ্ধ ছিলেন যে তিনিই জওহরলালকে বলেন, "লাট সাহেবের পদে না বসিয়ে এঁকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিন।" ডাক্তারিতে প্র্যাকটিস জমাবার শুরুতে পাটনার মেধাবী ছাত্র বিধান চন্দ্র কলকাতায় পার্ট টাইম ট্যাক্সিও চালিয়েছেন ।
'হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে হেরে যাওয়া ভাল।' মেডিক্যাল কলেজে তাঁর প্রিয় মাস্টারমশাই কর্নেল লুকিসের এই কথা আজীবন মাথায় রেখেছিলেন তিনি। আর মনে রাখতেন মা-বাবার কাছ থেকে শেখা স্বার্থহীন সেবা আর সাম্যের ভাব।
১৯৬২ সালের ২৪ জুন রাইটার্সে ছিল তাঁর শেষ দিন। সেদিনই তাঁর অসুস্থতার সূত্রপাত। বন্ধু-স্থানীয় দুই ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেন- ‘হার্ট অ্যাটাক’। ৩০ জুন ডাক্তার রায় প্রিয় বন্ধু ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায়কে বলেন, “আমি তিরিশ বছর হৃদরোগের চিকিৎসা করে আসছি। আমার কতটা কী হয়েছে আমি তা ভালোই বুঝতে পারছি। কোনও ওষুধই আমাকে ভাল করতে পারবে না।“
সেদিনই রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে দেহ নিথর হওয়ার আগে এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে বলেছিলেন, “আমি দীর্ঘ জীবন বেঁচেছি। জীবনের সব কাজ আমি সমাধা করেছি, আমার আর কিছু করার নেই।“
১৮৮২ সালে বিহারের পাটনায় পয়লা(১) জুলাই তাঁর জন্ম। ১৯৬২ সালে সেই একই তারিখে, নিজের জন্মদিনেই সব কাজ মিটিয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। পয়লা জুলাই সেই সুদীর্ঘ-মহাপ্রান ব্যক্তিত্বের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে ‘জিয়ো বাংলা’র পক্ষ থেকে রইল সশ্রদ্ধ নিবেদন।