নবদ্বীপ স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরের রাস্তা। নির্জন, নিরিবিলি। রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে পুরনো বাড়ি। সেই পুরাতনের গন্ধ। অতীতের স্যাঁতস্যাঁতে কথা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। জনমানবহীন রাজবাড়ি। পাশে রয়েছে মন্দির। অদৃশ্য ধূপ, ধুনো, ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে যেন। কত অজানা, অলিখিত কথা ভেসে রয়েছে বাতাস জুড়ে। অতীত তো এমনই। স্মৃতিকল্প রচনা করে। খানিক ইতিহাস থেকে পাওয়া তথ্য, বাকিটা লোকমুখে প্রচলিত কথা। মিলেমিশে এক আশ্চর্য চিত্রকল্পের জন্ম নেয়।
চৈতন্যধাম নবদ্বীপের সঙ্গে মনিপুরকে এক সুতোয় বেঁধেছিলেন মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র। ১৭৯৮ সালে পরম বৈষ্ণব মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র রাজকুমারী বিম্বাবতীকে সঙ্গে নিয়ে নবদ্বীপে প্রতিষ্ঠা করেন অনু-মহাপ্রভুর বিগ্রহ। নদীয়ার সিংহাসনে তখন মহারাজা ঈশ্বরচন্দ্র। ১৭৯৪ সালে এই নবদ্বীপের গঙ্গার ধারে গড়ে উঠেছে মণিপুরের তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশেষ যাত্রীনিবাস। স্থাপিত হয়েছে তাদের অধিষ্ঠাতা দেবতা রাধারমণের বিগ্রহ।
মণিপুরের সঙ্গে বঙ্গদেশের যোগসূত্র অনেক দিনের। মণিপুরের বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের কাজ শুরু করেছিলেন নরোত্তম দাস ঠাকুর। খেতুরী মহোৎসব পরবর্তী সময়ে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের হাত ধরে সেই সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তখন নবদ্বীপে প্রকাশ্যে মহাপ্রভুসেবা প্রায় এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল। মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র মহাপ্রভু বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে সেই খরা কাটান। মণিপুর রাজাকে ব্রিটিশরাও যথেষ্ট সম্মান করত।
মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন মণিপুর রাজবাড়ি। সঙ্গে অনু মহাপ্রভুর মন্দির। তবে রাজা বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। ১৭৯৯ সালে মুর্শিদাবাদের প্রয়াত হয়েছিলেন মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র। প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। ধার্মিক, সহৃদয় এই রাজাকে প্রজারা বড় ভালোবাসতেন। তাই তাঁকে রাজর্ষি নামে ভূষিত করা হয়।
রাজবাড়ির সঙ্গে রয়েছে নাটমন্দির, মণিপুরের নানা সংস্কৃতি অনুসরণ করা হয় এই রাজবাড়িতে। তবে এই রাজবাড়ি আজও নানা ভারতীয় সংস্কৃতিরও পীঠস্থান।
নবদ্বীপে গড়ে ওঠা এই রাজবাড়ির গোড়ার ইতিহাসটা বেশ অন্যরকম। প্রাচীনকালে এখানে অর্থাৎ মণিপুরে বহিরাগত কিছু উপজাতির মানুষ বসবাস করত। ব্রহ্মদেশ থেকে আসা এক রাজবংশ প্রথমবার রাজ্য স্থাপন করেন এখানে। সেই রাজবংশের রাজার মৃত্যুর পর আক্রমণ আবার ধেয়ে আসে। এবার স্বয়ং ব্রহ্মদেশ থেকে আক্রমণ আসে। মণিপুরের রাজা সেই আক্রমণ প্রতিহত করলেও নবদ্বীপে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তারপর ধীরে ধীরে নবদ্বীপ রাজবাড়ি যেন একটুকরো মণিপুর হয়ে উঠেছে। তবে ভারতীয় নানা সংস্কৃতিও অন্তর থেকে রক্ষা করেছেন এই রাজবাড়ির রাজারা। যেমন প্রথা মেনে দোলের পরেরদিন দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথিতে প্রথা মেনে মহাপ্রভুর মন্দির সহ বিভিন্ন নট মন্দিরে ভক্তরা আবির খেলায় মেতে ওঠেন। মণিপুর রাজবাড়ীর অনু মহাপ্রভুর মন্দিরে তার আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় ন্যাড়াপোড়া।
এই রাজবাড়ি প্রকৃত অর্থে মণিপুর ও বাংলার সংস্কৃতির মেলবন্ধনের পীঠস্থান। রাস উৎসবের সময় মণিপুরী নৃত্য প্রদর্শিত হয় এখনও। এভাবেই এই রাজবাড়ি আজও দুই সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে চলেছে।
এই রাজবাড়িতে রাজা ভাগ্যচন্দ্রের স্ত্রীর জন্য একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। সংরক্ষণের অভাবে এই ভবনটির অনেক অংশই নষ্ট হয়ে গেছে। পুরনো ক্ষত সারিয়ে তুলতে পারলেই এই রাজবাড়ি অতীতের স্মৃতির আলোয় আবার ঝলমল করে উঠবে।