সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তিনি 'কিং অফ স্ট্রিংস' জলি মুখোপাধ্যায় (Jolly Mukherjee)। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বলিউডি সঙ্গীতের জগতে তাঁর জার্নি। লতা মঙ্গেশকর, রাহুল দেব বর্মন, কিশোর কুমার, লক্ষ্মীকান্ত প্যায়ারেলাল, অনু মালিক, যতীন-ললিত, হরিহরণ সকলের সঙ্গে কাজ করেছেন। কীভাবে শুরু হল তাঁর বলিউড সফর, সেই গল্প শুনুন তাঁর মুখেই।
প্রঃ প্লেব্যাক সিঙ্গার থেকে ‘কিং অফ স্ট্রিংকস’-লম্বা একটা জার্নি, কেমন সেই সফরের অভিজ্ঞতা?
জলি মুখোপাধ্যায়ঃ আসলে আমার মিউজিক্যাল আপব্রিঙ্গিং হয়েছে পঞ্চমদা’র বাড়িতে। আমার জামাইবাবু ভানু গুপ্ত কাজ করতেন ওঁর সঙ্গে। আমায় ছোট বয়স থেকে কিশোরদা, রফিসাহাব এঁরা সবাই চিনতেন। কিন্তু আমি কখনও ভাবিনি গানে আসব। সবটাই ঘটনাচক্রে। বাবা অসুস্থ ছিলেন। আমি রেকর্ডিং দেখতে যেতাম। ভায়োলিনও শিখেছিলাম। একদিন ‘শালিমার’ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছিল। লাঞ্চটাইমে আমি পঞ্চমদাকে বললাম আমি গাইতে চাই। একটা সুযোগ চাই। পঞ্চমদা অবাক হয়ে আমার জামাইবাবুকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘ এ কী বলছে!’। উনি তখন বলেছিলেন, ‘ হ্যাঁ, ও তো গিটারও বাজায়। গানও করে। একটু একতু করে সবই করে।’এভাবে প্রথম ব্যাকআপ আর্টিস্ট হয়ে আমার মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রিতে আসা। মেইন সিঙ্গার রফি। ছবির নাম ‘জেলযাত্রা’। ১১ নম্বর কোরাসে আমি ছিলাম। ১৬০ টানা পেয়েছিলাম। ৮২ টাকা গিয়েছিল মেম্বারশিপের জন্য। ৩ টাকা ছিল বাসভাড়া। ৭৫ টাকা মাকে দিয়েছিলাম। এভাবেই জীবনটা শুরু হয়েছিল। প্রতিদিন সকাল সাড়ে নটায় স্টুডিয়ো চলে আসতাম। জানতাম না কী গান হবে। কিন্তু প্রতিদিন নতুন গান আসত। এটাই আমার মধ্যে একটা আগ্রহ তৈরী করেছিল। তারপর মিউজিশিয়ানদের থেকে শিখতে শুরু করলাম। সেটাই শুরু।
প্রঃ আপনার খুব ভাল বন্ধু হরিহরণজী। অনেক গজল, অ্যালবাম একসঙ্গে করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
জলি মুখোপাধ্যায়ঃ হরিহরণ আর আমি প্রায় একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো বন্ধু। ওর স্ত্রীর থেকে ভাল করে ওকে চিনি। আমাদের এক বন্ধু কিছুদিন আগে আমাদের ‘ফিফটি ইয়ারস অফ ফ্রেন্ডশিপ’র পার্টিও দিয়েছে। ‘অবসর-ই-গজল’ বলে আশাজীর জন্য একটা গজল অ্যালবাম হয়েছিল,তখন ওঁকে অ্যাসিস্ট করেছিলাম। ‘হাজির’ আমার প্রথম অ্যারেঞ্জমেন্ট। তারপর থেকে অনেক অ্যালবাম করেছি হরির সঙ্গে। প্রায় দশটার মতো। আমরা শুধুমাত্র বন্ধু নই, আমি এখনও শিখি ওঁর থেকে।
প্রঃ লতাজী, আরডি, রফি সাহাব, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক- বলিউড গানের সোনালী যুগে আপনি কাজ করেছেন, এত জনের সঙ্গে একসঙ্গে প্লেব্যাক, কেমন ছিল সেই দিনগুলো?
জলি মুখোপাধ্যায়ঃ লতাজী আমাদের ‘গডেস’ উনি অনেক আগে থেকে। আমরা তাঁকে অনুসরণ করে চলতাম। আমার মনে হয় না লতাজীকে ফলো না করে কেউ বলিউডে আসতে পারে।আজকেও রিয়েলিটি শোগুলোতে যতই অন্য গান থাক ঘুরেফিরে সেই ‘লগ জা গলে’তে আসতেই হয়। আমাদের সময়ের প্রধান ব্যাপার হল তখন মিউজিক ডিরেক্টররা অনবদ্য ছিলেন। রাহুলদেব বর্মন, কল্যাণজী-আনন্দজী, লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল, রবীন্দ্র জৈন- এঁদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কালার। তার আগেও যাঁরা ছিলেন তাঁদের গানের নিজস্ব ধরন, ঘরানা ছিল। সেই জন্য আমরা যখন কাজ করতাম তখন টাকাটাই প্রধান- এমন্টা ছিল না। একটা গান চারঘন্টার মধ্যে কী করে হয়ে যাচ্ছে- এটাই ছিল আমাদের কাছে আসল আগ্রহের ব্যাপার। স্টুডিয়োতে ঢুকলাম তখন কিছু জানি না, তারপর পঞ্চমদা হঠাৎ এসে একটা কিছু করল, রিদম সেট করতে কর তে লতাদিদি-কিশোরদা এসে গেলেন, আমরা পিছনে গাইছি- এসব করতে করতে দুপুর দেড়টার মধ্যে একটা গান রেডি হয়ে গেল। এই যে ব্যাপারটা ছিল এটা এমন অনুভূতি যেটাকে কোনওভাবে শুধু মুখের কথায় বোঝানো যাবে না। সবটাই হত ‘অন দ্য স্পট’।
প্রঃ আপনি তো ‘মাদ্রাস অর্কেস্ট্রা’র জন্যও কাজ করছেন…
জলি মুখোপাধ্যায়ঃ আমি একটা অ্যালবাম করার আগে, বিদেশিদের জন্য কিছু স্ট্রিংস সেকশন করতাম। আমার এক ম্যানেজার ওখানে যে আমায় বলে কিছু একটা কম্পোজিশন তাদের চাই। তো স্ক্র্যাচ রেকর্ডিং করে পাঠাই। একটা শোয়ের জন্য গিয়েছিলাম। আমাকে চার-পাঁচ দিন থাকার কথা বলা হয়। আমাকে সেই কোম্পানিতে নিয়ে যাওয়া হল। লন্ডনে এরকম একটা কোম্পানিতে গিয়ে প্রথমে ভয়ে ভয়ে চুপচাপ বসেছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে প্রথমেই যে অ্যাপ্রোচটা দিল, বলল এমন কিছু শোনাতে যা আগে কখনও তারা শোনেনি। সেটা শুনেই আমার খুব ভাল লেগেছিল যে তাহলে বোধহয় চান্স আছে আমার। যখন বাজালাম একজন আমেরিকান মহিলা যিনি এশিয়ান কম্পোজারদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, চালাবার আগে উনি যেই দরজাটা বন্ধ করলেন ফোনটা পাশে রেখে কাউকে বললেন চা-কফি-জুস দিতে। ৪ মিনিট রুমে কেউ কথা বলেনি সেই ব্যাপারটাও আমার খুব ভাল লেগেছিল। তারপর উনি বললেন, ইটস ইনক্রেডিবল। আগে কখনও এরকম মিউজিক শোনেনি। শেষপর্যন্ত ওঁরা বললেন দশটা ট্র্যাকের অ্যালবাম বানাতে। ওরাই কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড মিক্সারজদের নিয়ে এলো যেমন কিংশুক বিশ্বাস, স্টেট অফ বেঙ্গল, ব্যাডমার্শ অয়ান্ড শ্রী, আন্ডার রুলস এরকম চার-পাঁচ জন। তারা আমার স্ট্রিংসটাকে তাদের মতো করে রিমিক্স করল। সেই অ্যালবামের নাম দিয়েছে ‘ফিউজ বক্স’। সেখানে তারা একটা ক্যাপশন দেয় ‘কিংস অফ স্ট্রিংস’। কিন্তু আমি খুব দ্বিধায় ছিলাম, কারণ আমি নিজেকে ‘কিংস অফ স্ট্রিংস’ মনে করি না। ওরাই নামটা দিয়েছে।
প্রঃ লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে আপনার একটা গান আছে ‘গোরিয়া রে গোরিয়া’। সেই সময়ের কেমন ছিল?
জলি মুখোপাধ্যায়ঃ খুব নার্ভাস ছিলাম আমি। একই রুমের মধ্যে এই লতাদিদি আর এখানে আমি। উনি বললেন খুব ভাল হয়েছে। ত ঘরেই অন্যদিকে একটা সরস্বতী মায়ের ছবি ছিল আমি সেদিকে তাকিয়ে গান গাইছিলাম। যশ চো]পড়া ছিলেন, উনি এসে বললেন ‘জলি বোহত নার্ভাস লগ রাহে হো’। আমি বললাম আপনি একবার এদিকে আসুন। হেডফোনটা দিচ্ছি বললাম আমি ভিতরে যাচ্ছি। ঘাসতে হাসতে বললাম আমার জায়গাটায় আপনি থাকলে আপনিও নার্ভাস হতেন। এসব হাসিঠাট্টা চলতে লাগল। এভাবেই হয়ে গিয়েছিল। তবে ওঁর সঙ্গে গানের সুযোগ ঈশ্বরের দান। গানটা যদিও খুব ভয়ে ভয়ে গেয়েছিলাম।