বাংলার চিকিৎসা জগতে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে ভরসার নাম ডাঃ রবীন চক্রবর্তী। মেডিকার ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার তাঁর মজবুত কাঁধেই। তবে শুধুমাত্র চিকিৎসক হিসেবেই নন, লেখক হিসেবেও সুপরিচিত। চিকিৎসা সংক্রান্ত বইয়ের বাইরেও তাঁর লেখা অনেক বই রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম 'অষ্টম সমুদ্র'। ভালোবাসেন রান্না করতেও। অভিনয়ও করেছেন। ছোটবেলা থেকে কর্মজীবন লম্বা সফরের গল্পে ধরা দিলেন জিয়ো বাংলার পর্দায়।
প্র: আপনার ছোটবেলাটা কোথায় কেটেছে?
ডাঃ রবীন চক্রবর্তী: খুব কঠিন প্রশ্ন। আমার জন্ম হয়েছিল হাবড়ায়। তারপর আমরা চলে গিয়েছিলাম আসানসোলে। আমার বাবা সরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তবে আসানসোলেও খুব অল্প কিছু দিন ছিলাম। সেখান থেকে আমাদের চলে যেতে হয়েছিল বেগুসরাই। সেখানে থাকাকালীন আমি খুব ভালো মৈথিলী হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারতাম। পরবর্তীকালে স্থান ও কালের পরিবর্তনে আমার ভাষায় পরিবর্তন এসেছে। মাঝখানে আমরা একবার চলে এসেছিলাম বিষ্ণুপুরে। সেখানে থাকাকালীন আমার প্রাইমারি স্কুলের পড়াশুনা শুরু হয়েছিল। তখনকার দিনে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে বৃত্তি পরীক্ষা হত। আমি সেই ড্রিসট্রিক্টের ট্যাঙ্ক হোল্ডার ছিলাম, বৃত্তি পেয়েছিলাম। তারপর বিষ্ণুপুর হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম। কিন্তু আবার মাঝখানে বদলি। স্কুল বদল। বায়োলজি নিয়ে পড়াশুনা করার জন্যে বাবা তখন আমাকে উত্তরপাড়া হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও সেখানে চান্স পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। রীতিমত পরীক্ষা দিতে হত চান্স পাওয়ার জন্যে। আমি ভাগ্যবান যে পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তারি পড়ার সময় আমি 'এম বি বি এস' পরীক্ষায় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির টপার হয়েছিলাম। আমি আমার ডাক্তারি জীবনে মোট দশবার গোল্ড মেডেল পেয়েছি। সেই সময় আমি প্রায় সারাদিন পড়াশুনা করতাম। যার জন্যে অনেক ছবি দেখতে পারিনি। 'শোলে' রিলিজ হয়েছিল, কিন্তু আমি দেখতে যেতে পারিনি। কারণ আমার মাথায় ছিল আবার ফার্স্ট হতে হবে। তারপরে আমি আবার ফাইনাল পরীক্ষায় টপার হয়েছিলাম। কিন্তু তখন সবার একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল ডাক্তারি বিষয়ে আমি যা বলি সব ঠিক। পরিস্থিতি এমন হয় যে আমি শহর ছেড়ে চলে এলাম। ডাক্তারি এমন একটা সাবজেক্ট যে এক জন্মে তা বোঝা সম্ভব না। তাই এটা ভাবা ভুল যে আমি সব জেনে গিয়েছি। শহর ছেড়ে আমি গিয়েছিলাম চন্ডীগড়ে অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পোস্ট গ্ৰ্যাজুয়েট করতে। সেখানেও আমি প্রায় তেরো হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে টপার হয়েছিলাম। চন্ডীগড়ের বি.জি.আই ইনস্টিটিউটে আমি মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি কিছুই না। আমার মতো দেশের সব টপাররা সেই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকেই আমার যাত্রার নতুন পথ শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর ইংল্যান্ডে ছিলাম আমি। সেখানে গিয়ে আমি কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট হয়েছিলাম। আবার ২০০২ সালে কলকাতায় ফিরে এসেছিলাম আমি। আমার স্ত্রীও থাকতেন ইংল্যান্ডে। তিনি ২০০৪ সালে ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। আমাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। বর্তমানে সে আমেরিকায় ডাক্তারি প্র্যাকটিস করছে।
প্র: আপনি এতো ধৈর্য্য নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। নতুন যে প্রজন্ম আসছে তাদের মধ্যে কতটা ধৈর্য্য দেখতে পান আপনি?
ডাঃ রবীন চক্রবর্তী: প্রজন্মের কোনও দোষ আছে কী না জানি না, তবে সময়ের দোষ আছে। সময় এখন পাল্টে গিয়েছে। তাই সব কিছু আরও দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে। এখন কম সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করতে হয় সবাইকে। যার ফলে কাজের প্রতি ধৈর্য্য কমছে আর কাজগুলোও ভালো ভাবে হচ্ছে না। তাই সময়কে দোষ দিতে হবে।
প্র: আপনি তো দেশে-বিদেশে গিয়ে কাজ করেছেন। আপনার কী মনে হয়ে কলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে কী কোনও ফাঁক রয়েছে?
ডাঃ রবীন চক্রবর্তী: কলকাতার চিকিৎসা ব্যবস্থায় ফাঁক রয়েছে আর অন্য জায়গার চিকিৎসা ব্যবস্থায় ফাঁক নেই এমনটা নয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই এমন যে ফাঁক থাকবেই। চিকিৎসা শাস্ত্র এমন একটা শাস্ত্র যেটা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হয়। আমি এখন যেভাবে একজন রোগীকে দেখছি। তার এক ঘন্টা বাদে সেই রোগের এমন কোনও ওষুধ বেরিয়ে যাবে যে সেই চিকিৎসা পদ্ধতিটাই পাল্টে যাবে। তাই সব সময় খুব খোলা মন নিয়ে ভাবতে হয় ও চিকিৎসা করতে হয়। চিকিৎসা শাস্ত্র এমন একটা শাস্ত্র যেখানে সব সময় নিজেকে আপডেট করে যেতে হবে।
প্র: আপনি গান, বাজনা, অভিনয় ও লেখালেখির প্রতি একটা ভালো লাগা রয়েছে। সেটা নিয়ে কিছু বলুন?
ডাঃ রবীন চক্রবর্তী: কিছু কিছু সিনেমাতে গেস্ট আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। তবে লেখালেখি নিয়ে একটা ভালোলাগা রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই আমার লেখা বই রয়েছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের বাইরেও আমার অনেক লেখা রয়েছে। কবিতার বই লিখি, ছোট গল্প লিখি, উপন্যাস লিখি। আমার সম্প্রতিকালে প্রকাশিত পাঁচটি বইয়ের মধ্যে অন্যতম হল 'অষ্টম সমুদ্র'।
প্র: শুনেছি আপনার রান্নার হাত খুব ভালো। এই রান্নাটা শিখেছিলেন কীভাবে?
ডাঃ রবীন চক্রবর্তী: আমি খুব ছোটবেলায় খুব কৌতূহলী ছিলাম। আমার দিদিমা খুব ভালো রান্না করতেন। তার দেখা দেখি আমি রান্না শিখেছিলাম। মোটামুটি ভালোই রান্না করি। টেলিভিশনের একটা রান্নার শোতেও গিয়েছিলাম।