কোন দাওয়াইয়ে শান্ত করবেন আপনার শিশুর জেদ?

শিশুর অতিরিক্ত জেদ আর রাগের জেরে মাঝেমাঝেই বিড়ম্বনায় পড়েন? বায়নার বদভ্যাসে বিরক্ত? কিন্তু জানেন কী আপনার শিশু কেন করে এমন আচরণ? শিশুর এমন আচরণ কী কোনও রোগের উপসর্গ? কোন কৌশলে শান্ত করবেন জেদী শিশুকে? সাজেশন দিলেন পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট ডাঃ দীপ্তাংশু দাস  (Dr. Diptanshu Das, Paediatric Neurologist, Paediatrician, General Physician)

যখনই একটা বাচ্চা জেদ বা রাগ করছে তখন বুঝতে হবে যে এটা শিশুর ভাষা। সে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। হয়ত সে কিছু চাইছে তাই জেদ করছে। এমনও হয় বাচ্চা হয়ত কিছু এড়াতে চাইছে সেই জন্য জেদ করছে। যদি রাগ বা জেদের মাধ্যমে এটা প্রকাশ করে তাহলে ভাবতে হবে সে ঠিকমতো কমিউনিকেট করতে পারছে তো? অনেক সময় দেখা যায় শিশুর হয়ত সংযোগ স্থাপনে কোথাও না কোথাও ঘাটতি আছে। এমনও হতে পারে যে বাচ্চা ওটাকে একটা প্রফারেনশিয়াল মোড বলে ব্যবহার করছে। কেন? ধরুন আমি আপনাকে বোঝাতে পারছি না-আমি এটা চাইছি। কিন্তু আমি যেই জেদ করলাম আপনি আমাকে জিনিসটা দিয়ে দিলেন। আমার কাছে কিন্তু সিগন্যাল গেল যে আমি জেদ করলে এটা পেতে পারি। এবার প্রতি ক্ষেত্রেই আমি এই পন্থা নিচ্ছি। এটা যে কোনও শিশুই করতে পারে। সাধারণভাবে দেখা যায় যখন একটা বাচ্চা জেদ করছে তার আচরণের মধ্যে এ বি সি বলে একটা প্যাটার্ন রয়েছে। আন্টি সিডেন্ট, বিহেভিয়ার, কনসিকোয়েন্স। বিহেভিয়ার হল জেদ করা। এর পর আন্টি সিডেন্ট আছে। সে কিন্তু যে কোনও সময় জেদ করছে না। যেই পরিচিত কাছের কেউ এল অমনি জেদ করল। কেন? কারণ সে জানে যে জেদ করলে জিনিসটা সে পেয়ে যাবে। তাহলে যখন এই জেদটা সে করছে সে একটা কনসিকিউয়েন্স মাথায় রাখছে যে আমি যে জিনিসটা পেতাম না, চেনা কেউ এলে সেটা আমি পেয়ে যাব। তাহলে এখানে আন্টি সিডেন্ট যে যদি সেই প্যাটার্নটা ব্রেক করা হয়, মানে সেই ব্যক্তি আসছে না, তাহলে হয়ত বাচ্চাটি আর জেদ করবে না। এবার কনসিকিউয়েন্স ব্রেক করা হল। মানে সে ব্যক্তি এলকিন্তু সে বলল জেদ করলে তো আমি দেব না। তুমি এটা করলে আমি দেব বা অন্য কিছু। মানে ওই ব্যক্তি শিশুকে বুঝিয়ে দিল তার এই জেদকে সে মেনে নিচ্ছে না। অভিভাবকদের বুঝতে হবে যদি শিশুর জেদ মেনে নেওয়া হয় তাহলে জেদ বেড়ে যাবে। কারণ তাহলে বাচ্চা বুঝে যাচ্ছে জেদ করলে খুব সহজেই সে সব পেতে পারে। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় তার হয়ত কমিউনিকেশনেই ঘাটতি রয়েছে, বা নিজেকে কমিউনিকেট করতে পারে না। হয়ত সে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু যখন বোঝাতে পারছে না তখন ধাক্কা খাচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছে। মানে তার প্রাক্ষভিক নিয়ন্ত্রণে সমস্যা আছে। তাহলে একটা বিষয় হল কমিউনিকেশন গ্যাপ, দুই প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি। শিশুর যখন যে আবেগটা আসছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রকাশ না করা যায়, বা উচিত নয় এই বোধ যদি না থাকে তাহলে সমস্যা। যদি সহজ প্রকাশ না করা যায় তাহলে শর্টকাট বেছে নেয়। কখন এমনটা হয়?

হতে পারে তার বুদ্ধির বিকাশে কোথাও ঘাটতি রয়ে গিয়েছে এমনটা যদি ধরে নাও নেওয়া হয় তাহলেও যখন একটা শিশু এমন জেদ করে তখন এই বিষয়গুলো দেখতে হবে যে এরকম কোনও কারণ সেখানে আছে কিনা। অনেক সময় অনেক কারণ থাকে যা শিশু হয়ত মেনে নিতে পারে না, সে জেদ করে। তাহলে বুঝতে হবে এখানে কোনও কিছুতে সে বিরক্ত কিনা, যদি সেটা হয় তাহলে শিশুকে আশ্বস্ত করতে হবে। অনেক সময় শিশুকে যদি সেইভাবে বোঝানো হয় তাহলে জেদ কমে। অনেক সময় দেখা যায় শিশুর ইনপালস কন্ট্রোলে ঘাটতি আছে। অনেক সময় এডিএসডি থাকলে দেখা যায় যে বাচ্চা জেদ করছে। এরকম নানা রকম কারণ থাকতে পারে যার কারণে শিশু জেদি হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় শিশুর জেদ শিশুর সংযোগ স্থাপনের চেষ্টার ঘাটতি থেকে, বুদ্ধির বিকাশের সমস্যা থেকে হতে পারে। যেগুলো নানা অ্যাডিশনাল সমস্যার লক্ষণ। হয়ত শিশুর অ্যাংজাইটি রয়েছে, শিশুদের মধ্যেও ডিপ্রেশন দেখা যায়। ফলে যখন সে প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তখনই সে জেদ করছে। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছে। যেমন, ধরা যাক একটি শিশুর অটিজম রয়েছে। অটিজমে শিশুর সোশ্যালাইজেশন এবং কমিউনিকেশনে ঘাটতি থাকে। যা তার আচরণেও প্রভাব ফেলে। সঠিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না।

যদি একটা শিশু জেদ করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার রক্ত চাপ বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু এটা কোনও একদিনের ব্যাপার নয়। বুঝতে হবে এটা একটা প্যাটার্ন। যদি এই প্যাটার্ন বারবার হতে থাকে তাহলে এতে শিশুর স্ট্রেস বাড়বে, যা অন্য নানা সমস্যার উৎস। অনেক সময় শিশুর মধ্যে মনোসংযোগের সমস্যা দেখা যায়। বহু সময় শিশু খেতে চাইছে না বলে বাবা মা শিশুকে মোবাইল দিয়ে দেয়। যে মুহূর্তে তারা তাকে মোবাইল দিল সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো সমস্যা চলে আসে। প্রথমত সে বুঝে যাচ্ছে জেদ করলেই মোবাইল পাব। দ্বিতীয়ত সে বুঝতে পারছে না তার নিজের খিদে, বা কতটা খাবার লাগবে। যখন সাধারণভাবে আমরা খেতে বসি অন্যদের সঙ্গে কথা বলি, সামাজিক জীবনের জন্য যা অতি প্রয়োজন কিন্তু শিশুর হাতে মোবাইল পড়লে তার মধ্যে থেকে এই ব্যাপারগুলো চলে যায়। তাই বাচ্চা যখন জেদ করছে তখনই হাতে মোবাইল দেওয়া বাচ্চাকে আরও জেদি করে তুলছে। এই বিষয়টা মা বাবাকে বুঝতে হবে। মা বাবার আচরণ এক্ষেত্রে বাচ্চার জেদকে বাড়িয়ে তুলছে। মনে রাখতে হবে একটি শিশুর ধাপে ধাপে বিকাশ হতে থাকে। যখন বিকাশ হয় তখন মা-বাবার শিশুর সঙ্গে মেশা শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে এবং সামগ্রিক বিকাশে সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই শিশুর সঙ্গে যদি সঠিক এবং দৃঢ় সম্পর্ক থাকে অভিভাবকের তাহলে সে জেদ করবে না। যখন সে সবে জেদ করতে শিখছে তখনই যদি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তার এই আচরণ গ্রহণ করা হচ্ছে না, পরিবারের সদস্য হিসেবে তার আচরণ কী প্রভাব ফেলবে এটি বোঝানো হলে সে বুঝবে না এমন নয়। একেবারে ছোট থেকেই বাবা মা অভিভাবকের আচরণ শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। বাবামার সন্তানকে সময় দিতে হবে। তাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে তাহলে মনে হয় না আর বাচ্চার জেদ বিড়ম্বনার কারণ হবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...