ডায়াবেটিস। শুনলেই প্রথমে আপনি ভাববেন খাওয়া-দাওয়ার কথা। মিষ্টি বাদ, ভাত মাপা, এমন অজস্র ‘না’ জায়গা করে নেবে চেনা জীবনে। রেফ্রিজারেটরে যাওয়া করে নেবে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন। হাইব্লাডপ্রেসার। আর প্যানক্রিয়াস কিন্তু চোখ নিয়ে ভেবেছেন?
ডায়াবেটিস হল সাইলেন্ট কিলার যা এক এক করে মানুষের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে দেয়। ডায়াবেটিস রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কিডনি, হার্ট, ফুসফুস সবই ক্ষতিগ্রস্থ হয় তার প্রভাবে। সঙ্গে চোখও।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় দৃষ্টিশক্তি। একটু একটু করে কমতে কমতে নেমে আসে অন্ধত্ব। প্রতি তিনজন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে একজন ডায়াবেটিস জনিত কারণে দৃষ্টিশক্তির সমস্যার শিকার।
তেমনি এক সমস্যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। ডায়াবেটিস থেকে আসা সবথেকে গুরুতর চোখের সমস্যা বলা যায় এই রোগকে।দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত সুগার এই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মূল কারণ। কীভাবে শুরু হয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি?
বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডঃ প্রেমলতা কাপুরের মতে, দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড সুগারে ভুগলে রোগীর শরীরে অত্যাধিক মাত্রায় শর্করা থাকার কারণে রক্তবাহী নালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখান থেকে চোখে জটিল সমস্যার সূত্রপাত হয়। রক্তনালিকা থেকে রক্তপাত শুরু হয়। বন্ধ হতে থাকে তা রক্তনালীর স্বাভাবিক চলন। তার কারণেই রেটিনার ভিতরে জল জমে। ফ্যাট জমে। রক্ত চলাচল কমে যায়। এরই ফলে চোখের মধ্যে যে সমস্ত সমস্যা তৈরি হয় তাকেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বলে।
কীভাবে সাধারণ মানুষ বুঝবে যে তার ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হয়েছে। কী কী তার লক্ষণ?
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সমস্যা যখন প্রথম শুরু হয় তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী বুঝতেই পারে না যে তাদের চোখের ভিতর কোনও সমস্যা তৈরি হয়েছ। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে শুরু করলে বুঝতে পারে যে সমস্যা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে চোখের সামনে কালো দাগ বা স্পট দেখতে পায় রোগী এবং ক্রমশঃ সে অন্ধত্বের দিকে চলে যায়।
তবে ডায়াবেটিস হলেই যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হবে এমন কোনও কথা নেই। ডায়াবেটিসকে যদি প্রথম থেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং যাদের কো-মরবিডিটি আছে যেমন, ব্লাড প্রেসার বা কোলেস্টেরল সেগুলোকে ঠিক রাখা যায় তাহলে রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকি অনেকটাই কমে।
কোনওদিনই আক্রান্ত হবেন না-একথা হয়ত বলা কঠিন, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ কম হবেন বা দেরীতে হবেন একথা বলাই যায়। দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে ভুগতে ভুগতে এক সময় রোগী স্থায়ী অন্ধত্বের দিকে চলে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে যখনি ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তখনই রোগীকে একজন রেটিনো স্পেশ্যালিস্টকে দেখানো উচিত।
কারণ আমরা জানতে পারি না আমাদের ডায়াবেটিসটা কতদিন ধরে আমাদের শরীরে রয়েছে। হয়তো পাঁচ বা দশ বছর ধরে এই রোগে ভুগছিলাম। কিন্তু তেমন কোনও অসুবিধে না হওয়ায় টেস্ট করা হয়নি আর সুগার ধরাও পড়েনি।
তাই ডায়াবেটিস ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নেওয়া যায় তাহলে প্রাথমিকভাবে জানা যাবে রেটিনা কী অবস্থায় আছে। তার ভিত্তিতেই চিকিৎসক ঠিক করবেন কী ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন।
অনেক সময় আবার কোনও লক্ষণই দেখা যায় না। রেটিনায় কোনও উপসর্গ নেই। দৃষ্টিও পরিষ্কার। সেক্ষেত্রেও কিন্তু অগোচরে হানা দিতে পারে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি।
সেই কারণেই ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষা খুব জরুরি। রেটিনা টেস্ট করালে চিকিৎসক চোখে এক ধরণের বিশেষ ড্রপ লাগিয়ে ইনডিরেক্ট অপথেলমোস্কপি দিয়ে রেটিনা পরীক্ষা করেন যে রেটিনা কোন পর্যায়ে আছে। কখনও আবার ওসিটি বা ফান্ডাস ফ্লুরেসিন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট করে রেটিনা পরীক্ষা করা হয়। যার ফলে রেটিনোপ্যাথির ফাইন লেয়ার বোঝা যায়।
রেটিনা ডিটাচমেন্টগুলো দুই ধরণের হয়। যেমন ট্র্যাকশেনাল রেটিনা ডিটাচমেন্ট, যেখানে রক্ত নালিকা লিক করার ফলে রেটিনার ভেতর মেমব্রেনগুলো কুঁচকে যায় এবং রেটিনাকে টেনে নেয়। ফলে রেটিনা তার জায়গা থেকে উঠে আসে। তবে এই ব্যাপারটা বেশ অ্যাডভান্স স্টেজে হয়। তখন অ্যাডভান্স রিট্রেটমেন্ট সার্জারি করতে হয়। কিন্তু এই সার্জারিতে যে রোগী ভালো হবেই এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে রোগী সেরে উঠতে পারে। কাজেই এইরকম গুরুতর সমস্যা থেকে বাঁচতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডায়াবেটিসের চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া প্রয়োজন।
এখন অবশ্য এই রোগের ক্ষেত্রে এখন অনেক উন্নত চিকিৎসা বেরিয়েছে। বেশ কিছু ইঞ্জেকশন রয়েছে যেগুলো চোখের ভেতর দিয়ে রোগীর ট্রিটমেন্ট করা হয়। কোনও কোনও রোগীকে আবার লেজার ট্রিটমেন্ট দিতে হয়। চোখের ভেতর হয়তো ব্লিডিং হয়ে গেল বা রেটিনা ডিটাচমেন্ট হয়ে গেল তখন কিন্তু চিকিৎসকদের সার্জারির দিকেই যেতে হয়।