'জিয়ো আড্ডা উইথ অনিন্দিতা সরকার' শোয়ে আজ অতিথি মোটিফেশনাল স্পিকার, জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ WTF-এর কর্তা সায়ন চক্রবর্তী (Sayan Chakraborty, TED & Josh Talks speaker, Motivational speaker, Founder of WTF)। ‘বাঙালির ব্যবসা হয় না’ এই মিথকে বদলে দিয়ে ‘বাঙালি ব্যবসা করবে’ এই তাঁর মন্ত্র। ভালোবাসেন ‘রিস্ক’ নিতে। ছকভাঙ্গা পথে হাঁটা তাঁর খুব প্রিয়। বই লিখেছেন। পেয়েছেন টাইমস আইকন অফ দ্য ইয়ার সম্মান। এছাড়া আছে অজস্র সাফল্য। সব বাধা পেরিয়ে কীভাবে স্বপ্ন পূরণ করলেন তিনি, সেই গল্প শুনুন তাঁর মুখেই
প্রঃ এক সময় ভাবনা তৈরী হয়েছিল যে বাঙালি বোধহয় ব্যবসা করতে আর পারে না। কিন্তু এক সময় ব্যবসায় বাঙালির গৌরব ছিল। তোমার এই রেস্তোরাঁ শুরুর ভাবনা কীভাবে এলো, ব্যবসা মানেই তো ‘রিস্ক’?
সায়ন চক্রবর্তীঃ একদম আগে আপনার শুরুর কথায় আসি- একসময় বাঙালি চুটিয়ে ব্যবসা করত এখন আর করে না। তার প্রধান কারণটা কী, সেটা আগে সবচেয়ে আগে বুঝতে হবে। মানসিকতার একটা আমূল বদলে ঘটেছে। যে কোনও অল্টারনেটিভ ক্ষেত্রে। আমি কাউকে ছোট করতে চাইছি না। আমি চাইছি আমাদের পুরো জাতিটা উঠে আসুক। তারা বুক চিতিয়ে ব্যবসা করুক। একটা ব্যবসা করা মানে বহু মানুষের সংস্থান। খাদ্য থেকে শিক্ষার সুযোগ সব কিছু। নতুন সম্ভাবনার জন্ম। দ্বিতীয় শব্দ ‘রিস্ক’।রিস্ক-এর একটা খুব ভুল সংজ্ঞা আমাদের ছোটবেলা থেকে পড়ানো হয়। যারা চাকরি করতে তাদের প্রতি আমার শুভকামনা। আমার সমস্যা যারা ব্যবসা করতে চাইছে তাও চাকরি করছে তাদের নিয়ে। তাদের বলছি একটা বিশাল রিস্ক আছে। রিস্কটাকে একটু ভাঙি। রিস্কটা কী? - তুমি যদি এমন কিছু কাজ করো, যেটার ব্যাপারে তোমার কোনও আইডিয়া নেই তাও সেটা করো সেটাই রিস্ক। রিস্ক তো সবাই নিচ্ছে ব্যবসার বদনাম কেন! তুমি যদি জানো যে তুমি কী করতে চাইছ, আমার মনে হয় সেটা একটা প্রসেস। রাস্তা বেরলে গাড়ি ধাক্কা মেরে চলে যেতে পারে, সেটাও রিস্ক। আমাদের বেঁচে থাকাটাই যখন রিস্ক তাহলে ব্যবসার রিস্ককে কেন বড় করে দেখা হচ্ছে!
প্রঃ তোমার একটা বই প্রকাশিত হয়েছে স্টার্ট-আপ যারা করতে চাইবে তাদের জন্য, রতন টাটাজী মুখবন্ধ লিখেছেন
সায়ন চক্রবর্তীঃ আমি সবাইকে বলতে চাই আমি রেস্তোরাঁ চালাই আমি কোনও হোটেল ম্যাঞ্জমেন্ট ডিগ্রি করিনি। স্টক মার্কেটে দশ-বারো বছর ট্রেড করছি আমার কিন্তু কমার্স ডিগ্রি নেই। আর্টসের ছাত্র। মার্কেটের থেকে বড় স্কুল আর কিছু হয় না। জীবনের থেকে বড় টিচার কেউ হয় না। শিয়ালদহ মার্কেট আমার এমবিএ স্কুল। আমি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা কাটিয়েছি। ভেন্ডারের সঙ্গে কথা বলে শিখেছি। তাদের সঙ্গে াজও কাজ করি। ব্যবসার বয়স যখন দু’দিন তখন থেকে তারা আজও আছে। ব্যবসার আয় যখন ছিল ৫ হাজার টাকা তখনও তারা ছিল যখন আয় ৫ কোটিতে গিয়েছে তখনও তারা আছে। ১৪০ কোটির দেশে সবাই যদি চাকরি খোঁজে তাহলে দেবে কে? লার্জার পিকচারে দেখলে সব ব্যবসা একদিন স্টার্ট –আপ ছিল। আজ আমরা রতন টাটাকে দেখছি সেই টাটা গ্রুপও এইদিন এই পথেই শুরু হয়েছিল। অ্যাপেল, মাইক্রোসফট যে কোনও বড় কোম্পানি তারাও।
প্রঃ কীভাবে বইয়ের ভাবনা এলো?
সায়ন চক্রবর্তীঃ ২০২০তে লকডাউন হয়ে যায়। আমার চারটে রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। আটমাস ধরে আমি বুঝতে পারিনি যে আমি কী করব। কলেজে প্রেম, পার্টি কোনওটাই করিনি। আমি আমার সবটা দিয়েছি আমার ব্যবসাকে। আমি জাতমা আমার ৩০ বছর পর্যন্ত আমি খুব খেটে কাজ করব। বত্রিশ বছর বয়সে রিটায়ার। তারপর জীবনটাকে এনজয় করব। এভাবেই ইনভেস্ট করা শুরু করেছিলাম যাতে ৩২ পর আমায় আর না কাজ করতে হয়। কেউ ভাবেনি লকডাউন হবে। সেই সময় আমি একমাস ঘর থেকে বের হয়নি। ঘর থেকে খাবার দিত মা, ঘরে খাবার আসত। অন্ধকার ঘরে বসে থাকতাম। আমি ভেবেছিলাম আমি জীবনে যা যা করেছি সবটাই একদিনে চলে গেল। এত বছরের স্যাক্রিফাইস। আমরা তিন বন্ধু মিলে স্যান্ডউইচের ব্যবসা শুরু করেছিলাম সেখান থেকে ডব্লুউটিএফ হয়েছে। সবটা জিরো হয়ে গেল। ৩৬ জন স্টাফ। তাদের বাঁচিয়ে রাখ তে হবে। লক ডাউন তাদের দোষ নয়। স্টাক মার্কেট হাফ হয়ে গিয়েছে তখন। আমি চরম ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারছি না তখন। বাবা মা বুঝবে না। বন্ধুবান্ধব নেই। কারণ তেমন করে বন্ধু বানাইনি কখনও। কী করব, শেষ পর্যন্ত রাত্রে লিখতে শুরু করলাম। বই নয়। আমার ছেলেমেয়ে যদি কখনও জিজ্ঞেস করে কলেজে আমি কী করতাম তখন তাদের ম্যানুস্ক্রিপ্টটা দিয়ে বলব আমি দেড়শো টাকায় একটা শহরকে স্বপ্ন বেচে দিয়েছিলাম।
আমি বইটা খুব সৎভাবে লিখেছিলাম। তবে সেইসময় শুধুমাত্র সন্তানদের জন্য। একটা সময় লকডাউন শেষ হল আমরা রেস্তোরাঁতে ফিরলাম। আমার নাগের বাজার রেস্ত্রোরাঁয় একটা রিপোর্ট কার্ড ঝোলানো আছে। যেখানে লেখা আছে আমি অঙ্কে ফেল করেছি। আমি স্কুলে অঙ্কে তিন পেয়েছিলাম, আর এখন আপনি আছেন আমার তিন নম্বর রেস্তোরাঁয়। সেটা এক প্রকাশকের চোখে পড়ে যায়। আমি তখন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। খুব কেঁদেছি- যে এরকম আমাদের সঙ্গেই কেন হল। কারণ লকডাউনে হোটেল সেক্টর সব থেকে খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। সেই প্রকাশ্ন আমাকে বলে সে বইটা করত চায়। ছোট সংস্থা বেশি বই করেনি। আমি তাঁকে জানাই যে আমি তো বই করব না। লিখেছি ইংরেজিতে। উনি বলেন বাংলায় অনুবাদ করে নেবেন। কারণ বাঙালিকে এই বইটা পড়তে হবে। তখন আমি রাজি হই। একদিন গুগলে রতন টাটার মেল আইডি খুঁজে মেল করি। বইটা পাঠাই। একদিন ফোন আসে, ‘হোয়ার আর দ্য রেস্ট টেন চ্যাপ্টারস’। মানে বইটা তিনি পড়ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলান সারাদিন ওঁর কাছে এত মেইল আসে। আমার বইটা কীভাবে পেলেন। ওঁর পিএ বলেছিলেন ‘ডেস্টনি’। ওই সময় স্যার ল্যাপটপের সামনে ছিলেন। যখন আমার মেলটা পপ করে। আমি খুব ইমোশনাল মেসেজ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ওই একদিন জানায় আমার জন্য ‘বিগনিউজ’ আছে। রতন টাটা তোমায় পার্সনালি মেল করবেন। আমার বইটা প্যারিসে লঞ্চ হয় ওঁর জন্য। স্টার্ট আপ-এর ওপর প্রথম বাংলা বই যেটা এভাবে লঞ্চ হয়েছিল। তারপর জীবনটা বদলে গেল। সাফল্য এলো। আমি আরও দুটো রেস্তোরাঁ শুরু করলাম।