গায়ক রূপঙ্কর নাকি অভিনেতা রূপঙ্কর?

তিনি গান দুনিয়ার নক্ষত্র। অভিনয় করেন। রেওয়াজ-গিটার আর নিজের নাটকের দলও আছে। কোন ম্যাজিকে এত কিছু সামলান একসঙ্গে? সেই উত্তর নিয়েই  'জিয়ো আড্ডা উইথ অনিন্দিতা সরকার' শোয়ে আজ অতিথি গায়ক রূপঙ্কর বাগচী।

প্রঃ গান দিয়ে তোমার শুরু, এখান আমরা তোমায় সিনেমাতেও দেখতে পাই, এত কিছু সামলাও কী করে? 

রূপঙ্করঃ এত কিছু নয় আসলে, আমার মনে হয় যে আমি যে ভীষণ ব্যস্ত থাকি এরকমও নয়। আমার একটা রেওয়াজ করার সময় থাকে, সেটা বেশ অনেকটা সময়। গিটার, পিয়ানো প্র্যাকটিসের সময় থাকে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর একটা প্রচেষ্টা থাকো। এতগুলো বছর ধরে আমি সেটা করে আসছি। ঠিকমতো প্ল্যান করলে সব কিছুই ম্যানেজ করা যায় আর কি!আমি তো এত কিছু ব্যস্ত কোনওদিনই ছিলাম না। হ্যাঁ, একটা সময় বলতে পারো ২০০৪ থেকে ১৫-১৬-১৭ পর্যন্ত ভ্যঙ্কর ব্যস্ততা ছিল মূলত কনসার্টের জন্য। এখন কনসার্ট করা কমিয়ে দিয়েছি। টাকা পয়সাটা বাড়িয়ে দিয়েছি বলে কমে গিয়েছে। আগে কম নিতাম বলে বেশি কনসার্ট করতাম। সেই জন্য সময় আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিই।   

প্রঃ তোমার কথা শুনে যেটা মনে হচ্ছে রূপঙ্কর বাগচী খুব ব্যালেন্সড মানুষ। তিনি পরিবার এবং নিজের ভাল লাগা দুইকেই সময় দেন...

রূপঙ্করঃ আমি যে খুব ব্যালেন্সড এটা আমি বলতে পারব না, তবে খুব হওয়ার চেষ্টা করি। সেই চেষ্টার জন্য আমার একটা ভাললাগা আছে।

প্রঃ সিনেমায় অভিনয় তুমি কতটা এনজয় করছ?

রূপঙ্করঃ গান বাজনা যখন শুরু করেছি ১৯৯৪-৯৫ সালে আমি অভিনয় করতাম। ‘নান্দীপট’ বলে একটা দলে আমি থিয়েটার করতাম। নিয়মিত অভিনয় করতাম। এছাড়াও সেট বইতাম, কিছু কিছু লাইটের কাজ জানি। সবই করতাম। সেই জন্য অভিনয় আর মঞ্চে নাটকের প্রতি আমার আমার একটা অদম্য প্রেম ছিরকালই ছিল। মাঝখানে আমি দেখেছিলাম আমার এই গানবাজনার ব্যস্ততার জন্য থিয়েটারের দলকে খুব সময় দিতে পারছিলাম না। রোজগারের দায় ছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। আর যে পেশা বেছেছিলাম তা খুবই অনিশ্চিত, রোজগার খুব হতেও পারে আবার রোজগার ‘জিরো’ও হয়ে যেতে পারে। সেই জন্য আমায় অনেক কিছু করতে হয়েছে। তারপর একটা সময় যখন একটু ধাতস্ত হলাম তখন মনে হল আবার দল তৈরী করি একটা। আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই ‘নান্দীপট’এ ছিলাম এক সময়। দুজনেই থিয়েটার করতাম। ওখান থেকেই আমাদের প্রেম। আমারা, আমাদের পুরনো দু’একজন বন্ধু সবাই মিলে দল তৈরী করলাম ‘কৃষ্টিপটুয়া’। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পর পর সাতটা প্রোডাকশন আমরা করে আসছি।

প্রঃ থিয়েটারের একটা অদ্ভুত টান থাকে...

রূপঙ্করঃ হ্যাঁ, থিয়েটারের নেশাটা অনেকটা গাঁজা খাওয়ার মতো। ঐ নেশা থেকে বেরনো খুব ঝামেলার। কিছুই পাওয়া যায় না মানে আমি যদি ভেবে দেখি ১০১৩ থেকে ২০২৪ সাল, ২০-২১ সাল বাদ দিলাম ভয়ঙ্কর একটা সময় ওটা। আমি দেখেছি যে একটা শো করে আমাদের কোনও লাভ হয়নি। কিন্তু করে যাচ্ছি। এটাই নেশা- তুমি ডুববে জানো তবু তুমি করছ।  

প্রঃ তোমার একটা গান তোমায় জাতীয় পরিচিতি দিয়েছিল, সেই সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল? 

রূপঙ্করঃ প্রথমত, সুমনদার সঙ্গে কাজ করাটাই আমার কাছে বিশাল একটা পাওয়া ছিল। কারণ আমি যখন গান বাজনা যখন শুরু করতে চলেছি, ভাবছি যখন মিউজিশিয়ানই হব তখন কোন দিশাতে যাব সেটা আমার কাছে খুব পরিষ্কার ছিল না। আমি তখন হোটেলে গজল গাইতাম। একটা লক্ষ্য ছিল যে আমি বম্বে বা দুবাই চলে যাব। ওখানে হোটেলে গাইব। সেই সময় বাংলা গান যা হচ্ছিল তা আমায় খুব টানত না। সুমনদার আবির্ভাব, মঞ্চে প্রেজেন্স, নাটকীয়তা,কথা বলা তার কী-বোর্ড থেকে গিটারে চলে যাওয়া এই সমস্তটাই আমাকে একটা অন্য স্বপ্নের জগতে নিয়ে গিয়েছিল যে জগৎটা আমি একদমই পরিচিৎ ছিলাম না। সুমনদা একমাত্র কারণ যে কারণে আমি এতোদিন ধরে বাংলা গান গাইছি। সুমনদা একমাত্র কারণ যে কারণে আমি এতোদিন ধরে কলকাতাকে ভালোবেসেছি। সুমনদা একমাত্র কার যে কারণে আমি নিজের তৈরি গান, বা নতুন বাংলা গান গাইব সেই জেদে অবিচল থেকেছি সবসময়। তিনি যখন আমায় ছবিতে ডাকলেন গান গাইতে, সেটা আমার কাছে বিশাল বড় পাওয়া ছিল।  ওঁর সঙ্গে কাজ করার সেশনগুলো বলে বোঝানো যাবে না মায়াবী সিকোয়েন্স, ঐশ্বরিক সময় কেটেছে। আর জাতীয় পুরস্কার পেয়ে সবার ভাল লাগে, আমারও ভাল লেগেছিল অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।  

প্রঃ তুমি প্রচুর সিনেমায় গান গাইছ, ‘মায়া’ আসছে, অন্য ধরনের সিনেমা  

রূপঙ্করঃ সিনেমা অন্য ধরনের গানও অন্য রকমের। রনজয় খুব অন্যরকমের সুর করেছে। রাজর্ষির লেখা। গানটার মধ্যেই ছবিটার প্রিলিউড আছে। এই সময় যারা ভাল কাজ করছে রণজয় তার মধ্যে অন্যতম। স্নেহ করি। ওর সঙ্গে কাজ করতে ভাল লাগে। পুরনো দিনের মেলোডি আজকের দিনের অ্যারেঞ্জমেন্ট-এই দুয়ের অদ্ভুত সংমিশ্রণ শুনতে পাই ওর মিউজিকে।  

প্রঃ তোমায় রিয়েলিটি শো’তে দেখি। মেন্টর হিসেবে দেখি, প্রতিযোগী হিসেবেও। আজকের প্রজন্ম যারা গানের দুনিয়ায় আসছে তাদের কাছে অপশন বেশি, বাবামা’র সাপোর্ট কাজ করে। আর টেকনোলজি মারাত্মক সাপোর্ট সিস্টেমে চলে এসেছে তোমা র কী মনে হয় এই ব্যাপারটা কি ভাল হচ্ছে না রেওয়াজ আর শেখায় মন দিলে ভাল হয়?   

রূপঙ্করঃ না, আমি দেখেছি সেসব ছেলেমেয়েরা রিয়েলিটি শোয়ে প্রতিযোগী হিসেবে আসে তারা প্রচন্ড রেওয়াজ করে। অত রেওয়াজ আমি করতাম কিনা সন্দেহ। যে যুগ যেভাবে চলছে তার সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। রিয়েলিটি শো থেকে শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিৎ সিং, সুনিধি চৌহান এসেছে।আরও কত কত ছেলে মেয়ে আসছে। ওখান থাকে ভাল প্রতিভা আসছে। এবার দেখতে হবে যে সাফল্যকে কীভাবে নিলাম। চটজলদি সাকসেস পাওয়া যায়। আমাদের সময় সেই উপায় ছিল না। তবে এখন মনে হয় ছেলেমেয়েদের অনেক চাপ বেশি। সাফল্য পাওয়া আর সেটার সঙ্গে লড়াই করা খুব সোজা নয়। কম্পিটিশন অনেক বেশি এখন। আমি যেমন সাফল্য নিয়ে খুব ভাবিনি। টাকা আর কাজ নিয়ে এত দৌড়তে হয়েছে যে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় পাইনি।

প্রঃ যারা নতুন আসছে গানকে পেশা করবে ভাবছে তাদের তুমি কী বলবে?

রূপঙ্করঃ তাদের একটা বলব, যতক্ষণ না কোনও অরিজিন্যাল গান তোমার হচ্ছে ততক্ষণ তুমি থাকবে, গানও গাইবে কিন্তু ইতিহাসে তুমি থাকবে না। শ্রেয়ার নিজের হয়েছে বলে শ্রেয়া শ্রেয়া ঘোষাল হয়েছে।  

প্রঃ তোমার মন খারাপ বা আনন্দে কোন গান তোমার মনে পড়ে?

রূপঙ্করঃ আনন্দের সঙ্গে যে গান থাকে তা বেশি দিন টেকে না, দুঃখ বা যন্ত্রণার সঙ্গে যে গান থাকে সেই গানই থেকে যায়। সেখানে জগজিৎ সিং, কিশোর কুমার, আরডি বর্মন, এরিক ক্ল্যাপটন, পারফেজ সুলতা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রঃ রূপঙ্কর বাগচীর কখন রাগ হয়?

রূপঙ্করঃ অনেকসময়।

প্রঃ সেই রাগের বর্হিপ্রকাশ কেমন হয়?

রূপঙ্করঃ চিৎকার, চেঁচামেচি...রাগ হয় আবার চলেও যায়। 

প্রঃ বাড়িতে বউদিকে ভয় পাও?

রূপঙ্করঃ ভয় পাইনা। আমাদের বন্ধুত্ব খুব ভাল। ঝগড়াও করি, ভালবাসাও আছে। আমার বৌ একটু চাপা। রেগে গেলে কেলো হয়ে যায়। অনেকদিন ধরে থাকে। আমি আবার ম্যানেজ করার চেষ্টা করি।

প্রঃ বাবা হিসেবে তুমি কেমন?

রূপঙ্করঃ বাবা হিসেবে এখন দেখি খুব একটা পয়েন্ট দেওয়ার নেই। আমি ভাবতাম আমি বোধহয় খুব ভাল বাবা। কিন্তু এখন মেয়ে আমায় বলে আমি খুব একটা ভাল বাবা নই। আমি রাত আড়াইটে-তিন্টেতে ফিরতাম। ও কসবা দোলনায় পড়ত, আমরা টালা পার্কে থাকতাম। ওকে রোজ সকালে সাড়ে সাতটায় গাড়ি করে নিয়ে আসতাম। যখন ফিরি আমি নিয়ে যাবই। ওই সময়টা ওকে আমায় দিতে হবে। কিন্তু এত কিছু করার পরও ও বলে ওকে নাকি আমি সময় দিই না। ও হল আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...