লন্ডনে বসবাসকারী চার প্রবাসী বাঙালির গল্প নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন পরিচালক অতনু ঘোষ। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অনিন্দিতা বসু, সাহেব ভট্টাচার্য ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিন। জিয়ো আড্ডা উইথ অনিন্দিতা সরকার অনুষ্ঠানে ছবির শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন পরিচালক অতনু ঘোষ।
প্র: 'আরো এক পৃথিবী' বিদেশের পটভূমিতে নির্মিত কিছু মানুষের ক্রাইসিসের গল্প? ছবির গল্পটা সম্পর্কে একটু বলুন।
অতনু ঘোষ: 'আরো এক পৃথিবী' আমার কাছে ভীষণ ভাল একটা অভিজ্ঞতা। প্রথম কথা পুরো ছবিটার শ্যুটিং বিদেশে হয়েছে। একটা নতুন পরিবেশ কাজ করার অভিজ্ঞতা সত্যিই খুব ভাল। আর সবচেয়ে বড় হল এই প্রথমবার আমি অনেকগুলো প্রথমের মুখোমুখি হলাম। প্রথমত, এটা সিঙ্ক সাউন্ড ছবি। দ্বিতীয়ত, আমি অনেক শিল্পীর সঙ্গে কাজটা করেছি। আমার এই ছবিতে প্রায় ১২ জন বিদেশি চরিত্র রয়েছে। তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দেশের মানুষ। এই সব মিলিয়ে এটা খুব ভাল একটা অভিজ্ঞতা। আসলে বিদেশে মানুষগুলো খুব বিপদজনক ভাবে বেঁচে রয়েছে। আসলে ওখানকার সমস্যাগুলো অনেকটাই আলাদা। তাদের অনেকের মাথার উপরে ছাদ নেই। কিন্তু মাথার উপরের ছাদ হারানোর আগে তাদের অবস্থা কেমন ছিল। সেটাই দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবির মাধ্যমে।
প্র: কাস্টিংটা আপনি কীভাবে করেন? আগে থেকে কী এই নিয়ে আপনার একটা চিত্র তৈরি করা থাকে?
অতনু ঘোষ: সব সময় যে আগে থেকে থাকে এমনটা নয়। অনেক সময় এমন হয় যে কোনও অভিনেতাকে নেওয়ার জন্য স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করা হয়। যেমন- এবার কৌশিককে নেওয়া জন্য স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করতে হয়েছে। স্ক্রিপ্টটা লেখার পর আমি আমি 'লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান' তাসনিয়া ফারিনকে দেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল প্রতীক্ষার চরিত্রটাতে তাসনিয়াকে ভাল মানাবে।
প্র: কিন্তু হঠাৎ বাংলাদেশের অভিনেত্রী কেন?
অতনু ঘোষ: আমার এই চরিত্রটার কতগুলো বেসিক রিকোয়ারমেন্ট রয়েছে। এক নম্বর হল, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ কাজ করেছে এখানে। সকলেই ইংরেজিতে কথা বলেছেন কিন্তু ভাষা এক থাকলেও বলার ধরনের একটা পার্থক্য ছিল রয়েছে সঙ্গে মধ্যেই। তাদের সকলের সঙ্গেই এই মেয়েটি কথা বলেছে ইংরেজিতে। এই মেয়েটি নৈহাটিতে বড় হয়েছেন কিন্তু তারপর কেরালায় ছিল তিন বছর। এছাড়াও ছবির ৭০ ভাগে মেয়েটি খুব অন্তর্মুখী। মেয়েটি কিছু এক্সপ্রেসও করেনি। কিন্তু ছোটো ছোটো অনুভূতি রয়েছে তার মুখে ও এক্সপ্রেশনে। আমার 'লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান' দেখে মনে হয়েছিল এই মেয়েটা এই সব কিছু হ্যান্ডেল করতে পারবে।
প্র: কৌশিকদা একজন পরিচালক তাই একজন পরিচালক যখন অভিনেতা হিসেবে আসে তখন তো তোমার কথা শুনে তাকে অভিনয় করতে হচ্ছে। এই সময়ের অভিজ্ঞতাটা কেমন?
অতনু ঘোষ: বাইরে থেকে অনেক কিছু মনে হয়। কিন্তু আসলে কোনও তফাৎ হয় না। কৌশিক যখন ফ্রেমে ঢোকে তখন খুব নির্লিপ্ত ভাবে আসে। আসলে ওর অভিনয়টা পুরোটাই ভিতর থেকে আসে। আর একজন অভিনেতা হিসেবে ও তুখোড়। কিন্তু আলাদা করে যেটা যোগ হয় সেটা হল ওর জীবন বোধ। ছবিতে কৌশিকের চরিত্রের একটা গোপন দিক রয়েছে যেটা ক্রমশ প্রকাশ পাবে। চরিত্রটার কথাগুলোর মধ্যে যে মায়া বা দরদ আবেগ রয়েছে সেগুলো অসাধারণ। চিত্রনাট্যে যেটা আছে সেটার থেকে অতিরিক্ত কিছু ও দিতে পারে।
প্র: তোমার ছবিতে সঙ্গীতের একটা বড় ভূমিকা থাকে। কিন্তু এই ছবিতে বিদেশের মাটিতে এই শ্যুটিং হয়েছে। তার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অতনু ঘোষ: দেবজ্যোতি মিশ্র একজন অসাধারণ সঙ্গীত পরিচালক। তিনি সিনেমা ভীষণ ভালবাসেন এবং খুব ভাল বোঝেন। যে জায়গায় তার মনে হয় এখানে নৈঃশব্দ্যটা দরকার। তিনি কোনও কিছুই দেবেন না সেখানে। দেবুদার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল প্রতীক্ষা চরিত্রটা নিয়ে। কারণ এই চরিত্রটা অন্তর্মুখী। আমি বলেছিলাম এমনটা কী করা যায় তার মনের ভেতর যা চলছে তা গান হয় প্রকাশ পাচ্ছে। আর এটা করার জন্য আমরা আর একজন গুণী মানুষের সাহায্য নিলাম যিনি অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়। আমরা ছবির দৃশ্যগুলো চালাতাম আর কী চলছে প্রতীক্ষার মনে সেটা বলতাম আর অনির্বাণ লিখতেন। এভাবেই পুরো গানটা করা হয়েছে। গান গেয়েছেন পোর্শিয়া সেন। অনেক সময় আমরা যখন সিনেমায় মানুষের সমস্যাগুলো দেখি তখন জিনিসটা খুব ডার্ক হয় যায়। কিন্তু আমরা যখন ঐ সময়টার মধ্যে ঢুকে পড়ছি তখন সেই ব্যাপারটা থাকছে না। ছবিতে এই আলোটা দিয়েছে দেবজ্যোতিদার গান।
প্র: যখন একটা ছবি তৈরি হয় তখন টিমটা যদি ঠিক না হয় তাহলে কাজটাও ঠিক হবে না। কিন্তু তোমার ছবিতে সব সময় তুমি খুব যত্ন নিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেছে নাও।
অতনু ঘোষ: হ্যাঁ একদম, বিশেষ করে এই ছবির ক্ষেত্রে আমি প্রযোজককেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম কীভাবে করবে এই ছবি? কারণ বিদেশের লোকেশনে শ্যুটিং, এত আর্টিস্ট লাগবে। বিভিন্ন জাতির মানুষ তারা। এছাড়াও লন্ডনের এমন কিছু জায়গায় শ্যুট হওয়ার কথা ছিল। যেগুলো সাইড সিনের মধ্যে পরে না। প্রযোজনা সংস্থার তরফ থেকে আমাকে সব ধরনের সাহায্য করা হয়েছে। সেটা ছাড়া এই ছবি হতো না।
প্র: অতনুদা তোমার কী রাগ হয়? আমি তোমাকে কখনও রাগতে দেখিনি।
অতনু ঘোষ: রাগটা কমে গিয়েছে। আসলে আমি দেখেছি একটা পরিচালক যদি রেগে যান তাহলে কাজ করা মুশকিল হয় যায়। আমার সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম কাজ করেছিলেন 'অসমাপ্ত' বলে একটা টেলিফিল্মে। প্রথমদিনের শ্যুটিং আর আমার ক্যামেরা খারাপ হয় গেল। আর তারপর আলো চলে গেল। কিন্তু চার দিনের মধ্যে শ্যুটিং শেষ করতে হবে। সেই সময়ের অন্যতম ব্যস্ত শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রানী হালদার, কৌশিক সেন আমার ছবিতে অভিনয় করছিলেন। আমি জানতাম এদের কারুর ডেট পাবো না। শ্যুটিংয়ের সময় কারেন্ট চলে যাওয়ায় আমি সেই সময় একটা মোড়া নিয়ে বসে আছি ভাবছি এটা গেল। তখন আমাকে জানানো হল সৌমিত্র কাকু ডাকছে আমাকে। তিনি আমাকে বললেন, এই এদিকে এসো। আমি যাওয়ার পর আমাকে বললেন, তোমার এই কাজটা যন্ত্র আর মানুষ নিয়ে। দুটোই বিগড়য়। কিন্তু তোমাকে স্থির থাকতে হবে। তুমি যদি বিচলিত হয় পড়ো তাহলে আমরা সবাই উলটে পড়ব। তারপর থেকে রাগ আর আক্রোশ কমিয়ে ফেলতে লাগলাম। আমি নিজেও দেখেছি একবার রেগে গেলে অনেক ক্ষতি হয় যায়।
প্র: এই ছবি নিয়ে দর্শকদের তুমি কী বলবে?
অতনু ঘোষ: 'আরো এক পৃথিবী 'আমার কাছে একটা ভীষণ এনগেজিং ছবি। ছবিটার মধ্যে একটা টানটান উত্তেজনা রয়েছে তার সঙ্গে মায়া, মমতা, দরদ আছে, সহানুভূতির জায়গা রয়েছে। এই পৃথিবীতে এমন কিছু রয়েছে যাদের আমরা শেষ মুহূর্তেও পাশে পাই। এই ছবিতে এই আশাই দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।