সঙ্গীত চর্চার ধারায় এক বিশিষ্ট নাম ‘তন্ময় বোস’

পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে নিজের দুনিয়া বানিয়ে নিয়েছেন। কম বয়সেই ওস্তাদ মুনাভর আলি খান শাহেব, ওস্তাদ আমজাদ আলি সাহেবের মতো সঙ্গীত শিল্পীর সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চার ধারায় তিনি এক বিশিষ্ট নাম। জিয়ো বাংলার ‘আড্ডা উইথ অপ্সরা’ অনুষ্ঠানে জীবনের অজানা কাহিনির সিন্দুক খুললেন শিল্পী পন্ডিত তন্ময় বসু।   

প্র: পরিবারের কেউ গান বাজনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কীভাবে শুরু হল আপনার ‌সফর?

তন্ময়: আমার দাদু মহারাজা অবনী পালের পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট ছিল। আমার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল আমি গান শিখি। আমার যখন চার-পাঁচ বছর তখন থেকেই তাদের ইচ্ছা ছিল আমাকে গান শেখানোর। তারপর আমার গান শেখা শুরু হয়েছিল। সঙ্গে তবলাও শিখতাম। আমার দুই গুরুজীর নাম হল পন্ডিত কানাই দত্ত ও পন্ডিত শঙ্কর ঘোষ। আমার একটা বড় ইনফ্লুয়েন্স ছিল আমার মামা বিখ্যাত অভিনেতা রবি ঘোষ। থিয়েটার ও সিনেমার বহু মানুষ আড্ডার আসর জমাতেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের ওষুধের দোকান ছিল 'বাসু ফার্মেসি'। এখানকার অনেক আর্টিস্ট আসতেন আমরা দোকানে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পূরবী দত্ত, মহাশ্বেতা দেবী মতো মানুষেরা আসতেন আমাদের বাড়িতে। তাঁরা এলে বাবা আমাকে ডেকে পাঠাতেন প্রণাম করার জন্য।  তাদের দেখে আমার আকাঙ্ক্ষা হল আমি ওদের মতো হবো। কিন্তু আমার দাদু বলেছিলেন আমাকে গান বাজনা করতে দেবেন না। আমার মা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে  নিয়ে যেতেন গানের কনসার্ট শোনাতে। আমার স্কুলের টিচার মিস্টার গুহ, কবিতা আন্টি, নন্দিতা আন্টি, সোমেশ দাশগুপ্ত এনকারেজ করতেন রেওয়াজ করার জন্য।

প্র: আপনার কী মনে করেন যারা বাংলা থেকে উঠে আসা মিউজিশিয়ন বা যারা ক্লাসিক্যাল মিউজিক নিয়ে চর্চা করছেন, তাদের কী স্ট্রাগেল করতে হয়েছে বা রেকগনাইজেশন পেতে কী কোথাও কোনও অসুবিধা হয়েছে?

তন্ময়: আমি এটা জোরের সঙ্গে বলতে পারি, বাঙালি এপার আর ওপার আমরাই জগৎ শ্রেষ্ঠ। তাই সঙ্গীত, বিজ্ঞান, অভিনয়, সিনেমা আমাদের ছাড়া হবে না। আর সেই গর্ব বোধ আমার আছে। আমি মনে করি আমার আগে যারা ছিলেন তাঁরা হলেন এক একজন ভগবান। আমারা ভগবান দেখিনি তবে তাঁদের কাজ দেখেছি। কিন্তু অন্য প্রান্তের মানুষদের মধ্যে আমাদের নিয়ে একটা ইটিমিডেশন রয়েছে।

প্র: আপনি ফোক মিউজিক নিয়ে কাজ করেছ। টেলিভিশনেও মিউজিক নিয়ে কাজ করেছেন। তার সম্পর্কে একটু বলুন।

তন্ময়: আমি একদমই ধৃষ্টতা করছি না। আমার কেরিয়ার সম্পর্কে যাঁরা জানেন, আমি কখনও বি-গ্ৰেড কোনও আপকামিং আর্টিস্টের সঙ্গে কাজ করিনি। সব সময় টপ মোস্ট আর্টিস্টরা আমার মাথায় হাত রেখেছেন‌। আমার বন্ধুরা যাদের সঙ্গে আমি বাজিয়েছি। তাঁরা এখনকার সবাই কিংবদন্তি। সুজাদ ভাই, রাশেদ, তেজেন্দ্র, শাহেদ ভাই। আমি এদের সঙ্গে আমি গান বাজনা করে বড় হয়েছি। আমার এটা কপাল‌। আমার যখন ২১ বছর বয়স তখন ওস্তাদ মুনাভর আলি খান সাহেব, বড়ে গুলাম আলি খান সাহেবের ছেলে ক্যালকাটা মিউজিক কনফারেন্সে আমাকে শুনলেন।  তার সাত দিন পর খান সাহেব আমার বাবাকে ডেকে পাঠালেন। বলে ছিলেন, "ইস ল্যাড়কে কো লেকার হাম লন্ডন যায়েঙ্গে।" তারপর একের পর এক গ্ৰেটেস্ট মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে আমি বাজিয়েছি। কলকাতায় না জন্মালে হয়তো আমার গান বাজনা হতো না। আমার আগে মঞ্চে ঢাককে কেউ প্রজেন্ট করেননি। আমি প্রথম গোকুলকে নিয়ে ঢাক আমার তাল তন্ত্রের সঙ্গে বাজাতে শুরু করেছিলাম। ওকে নিয়ে আমেরিকা গেলাম। ওকে নিয়ে ইউরোপ গেলাম। জাকির ভাই ওকে শুনে এতটাই আনন্দ পেলেন যে ওকে নিয়ে আমেরিকায় শো করতে চলে গেলেন। ঢাক নিয়ে আমি কী কান্ড করেছি বাউল ফকির ও ঢাক নিয়ে তা হয়তো অনেকেই জানেন। আমি বাউল সম্প্রদায়ের শিল্পীদের নিয়েই কাজ করেছি। শুধুমাত্র একবার আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে কাজ করেছিলাম। যিনি বাউল সম্প্রদায়ের ছিলেন না।

প্র: ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের সান্নিধ্যে থেকে আপনি অনেক কিছু শিখেছেন, অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন ওঁর থেকে। সেই সম্পর্কে একটু বলুন।

তন্ময়: আগেকার দিনে বাঙালির অঙ্গ ছিল ভদ্রতা। বাঙালির মিষ্টি কথা। সেটা এখন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ওস্তাদজী বলতেন, "দেখো বেটা তেহেজীবে মশিকে বহোত জারুরি হে।" তোমার ওঠা, বসা, পা নাড়া, কথাবার্তা সব কিছু নিয়েই তুমি। একবার ওস্তাদজী আমাকে ডাকলেন,  ‘তন্ময়।‘ আমি বললাম, ‘হাঁ’। ওস্তাদ জী বললেন, “জী হাঁ বলো।”

প্র: এখনকার দিনে মানুষ যে ধরনের মিউজিক শুনছে, কোথাও কী মনে হয় যে ক্লাসিক্যাল মিউজিক হারিয়ে যেতে চলেছে?

তন্ময়: আবার মার্জনা চাইছি। এই সময় কোনও ছবির নাম বলতে পারবে? চট করে মনে পড়বে না তো। কিন্তু তুমি আমাকে বললে আমি কিন্তু আগেকার ছবির গান বলতে পারব। এখনও দেখবে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে এই গানগুলোই গাইছে ছেলে মেয়েরা।

প্র: আপনার আর বন্যাদির সঙ্গে পরিচয় কীভাবে? যারা জানে না তাদেরকে একটু শেয়ার করুন।

তন্ময়: এটা একেবারেই অনুপ্রেরণা নিও না। আমি সাউথ পয়েন্টে ক্লাস এইটে পড়তাম বন্যা ক্লাস সেভেনে পড়ত। বন্যা সেতার বাজাত। সেই সূত্রেই আমার আলাপ। তারপর যোগাযোগ থেকেই গিয়েছে। আমার একটা বিরাট সাপোর্ট সিস্টেম হল বন্যা। আমি নয় মাস করে বিদেশে থেকেছি। কিন্তু আমার কখনও এমন অবস্থা হয়নি যে বিয়ে ভেঙে যাবে। তার কারণ একটা মিচ্যুয়াল ট্রাস্ট ছিল। আর দ্বিতীয় বন্ড হল মিউজিক। এছাড়াও যা যা কিছু আমি চেয়েছি বন্যা সেগুলো সব সত্যি করেছে। আমার খাবার শখ ছিল। এই জন্য বন্যা একটা রেস্টুরেন্ট খুলতে সাহায্য করেছে আমাকে। এই জন্য বন্যার সঙ্গে আমার একটা প্রাণের খেলা চলছে।

প্র: তোমার ফেভারিট ক্যুইজিন কী?

তন্ময়: আমার মেক্সিকান খাবার খুব ভালো লাগে। জাপানিজ খাবার খুব ভালো লাগে। এছাড়াও বিরিয়ানি আমার ফেভারিট খাবার।

ফাস্ট কোয়েশ্চেনের উত্তর দিতে চলেছেন সঙ্গীত শিল্পী তন্ময় ঘোষ।

প্র: আপনার ফ্রি টাইমটা কীভাবে কাটে?

তন্ময়: আমার ছেলেদের নিয়েই সময় কাটাই। তারাই আমার সমস্ত সময় নিয়ে নেয়।

প্র: আপনার লাইফের মন্ত্র কী?

তন্ময়: আমি বেশি কিছু এক্সপেক্ট করি না। আমি আমার হার্ড ওয়ার্কের উপর বিশ্বাস করি। আমার বিদ্যের উপর আমার খুব কনফিডেন্স। আমি শিখি, আমি শেখাই।

প্র: টি না কফি?

তন্ময়: কফির আমার খুব নেশা। সারা পৃথিবীর থেকে আমি কফি কালেক্ট করি। গরমে বেশি কফি খাই না। কিন্তু দিনে একবার আমি নিজেই কফি বানিয়ে খাই।

প্র: সান রাইজ না সান সেট?

তন্ময়: আমার সান সেটের একটা বিষন্নতা খুব ভালো লাগে।

প্র: বিরিয়ানি না বাঙালি খাবার?

তন্ময়: আমার তো বিরিয়ানি। আমি ঢাকায় গেলে পুরোনো ঢাকায় আমি যাবই যাব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...