ছোটবেলায় হাওড়ার 'পদক্ষেপ' নাট্য দলে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর লম্বা স্ট্রাগল পর্ব পেরিয়ে মূল ধারার বাণিজ্যিক সিনেমায় জার্নি শুরু। শুরু থেকেই দর্শকদের চোখ টেনে নিয়েছিলেন অভিনয় দিয়ে। চরিত্রের মাপ যাই হোক না কেন, তাঁর উপস্থিতি মনে ছাপ রাখবেই। 'ভিঞ্চিদা', 'চ্যাপলিন'-এর মতো ছবিতেও সেই ধারা অব্যাহত। টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের কেরিয়ার শুরু হয়েছিল এভাবেই। খুব তাড়াতাড়ি হিন্দি ছবি 'ম্যায়দান'-এ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যাবে রুদ্রনীলকে। সম্প্রতি জিয়ো বাংলার 'আড্ডা উইথ অপ্সরা' অনুষ্ঠানে আড্ডা দিতে এসে নিজের জীবনের গল্প বললেন অভিনেতা।
প্র: আপনার ছোটবেলা কেটেছে হাওড়ায়। কেমন ছিল ছোটবেলা?
রুদ্রনীল: আমি পড়াশোনায় খুব একটা খারাপ ছিলাম না। বাবা-মা শিক্ষক ছিলেন। তাই যা দুষ্টুমি করতে ইচ্ছা করত, তা খুব সন্তর্পণে করতে হত। অন্যরা যা করত আমি তা করতে পারতাম না। আমি দুষ্টুমি করলেই আমার বাবা-মা স্কুল থেকে ফেরার পর তাঁদের কাছে নালিশ করা হত। তবে ছোটবেলা থেকেই পাড়ায় নাটক করা, ছবি আঁকার শখ ছিল আমার। সেগুলো নিয়েই আমার বেড়ে ওঠা।
প্র: আপনি বলছিলেন ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। কখনও মনে হয়েছে পেন্টার হওয়ার কথা?
রুদ্রনীল: কেউ যদি গায়ক হতে চায় তাহলে দু’ধরনের হবে। এক হল, প্রফেশনাল গায়ক ও দুই, গান গাইতে ভালোবাসে বলে গান। এখন যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তোমার গাওয়া গান সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তখন এমন ছিল না। আমি আমার ভালো লাগা থেকে ছবি আঁকতাম। আমার বাবা নিজেও পেন্টার ছিলেন। ছবি আঁকার সময় আমার বাবা মানুষের চোখকে ফলো করতে বলতেন। আর যখন আমরা অন্য ভাষায় সিনেমা দেখি তখন সব সময় সাবটাইটেল দেখতে পাই। বাবা বলতেন, ঠোঁটটা হল সাবটাইটেল। কিন্তু সাবটাইটেলের সঙ্গে যদি চোখের ভাষা না মেলে তাহলে কোনও দিন কোনও চরিত্রকে পড়তে পারা যায় না। সেটা ছবি আঁকা হোক বা অভিনয় করতে গিয়ে অভিনেতার মুন্সিয়ানা প্রকাশ করা হোক সব ক্ষেত্রেই দরকার। ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে নাটকের প্রতিও আমার টান তৈরি হয়েছিল। পাড়ার নাটক থেকে গ্ৰুপ থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
'পদক্ষেপ' বলে একটা থিয়েটারের দলে আমি অভিনয় করতাম। কিন্তু থিয়েটার করতে গেলে একটা ফান্ড লাগে। বাড়ি থেকে যতটুকু জোগাড় করতাম তা দিয়েই চলত। তারপর ইচ্ছা হল কলকাতায় এসে থিয়েটারে যুক্ত হব। হয়েওছিলাম পরবর্তীকালে। তখন একজনকেই তিন-চারটে চরিত্র করতে হত। তখন টেলিভিশনটা সবে গ্ৰো করা শুরু হয়েছিল। সেই সময়টা আজকের ছেলেমেয়েরা রিলেট করতে পারবে না।
প্র: থিয়েটার থেকে আপনার অভিনয় শুরু। থিয়েটার থেকে সিনেমা জগতে এসেছিলেন কীভাবে?
রুদ্রনীল: আমার থিয়েটারের পাশাপাশি যেটা খুব হার্ডকোর ভাবে চলত। বন্ধুদের নিয়ে অনেক সামাজিক কাজ করতাম আমরা। কাউকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া, কারুর ব্লাড কালেকশন করা, কেউ মারা গিয়েছেন তাকে শশ্মানে নিয়ে যাওয়া, রক্ত দেওয়া। একদম ছাত্র রাজনীতি করতে করতেই আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম। ধীরে ধীরে মেইনস্ট্রিম পলিটিক্স আর থিয়েটার মানুষের বিভিন্ন ধরনের ক্রাইসিস সম্পর্কে জানতে আমাকে হেল্প করে। আমি অভিনয়কে ভালোবাসতাম। আমি মানুষ ভালোবাসি। সেই সময় নন্দনে সব ধরনের শিল্পীদের দেখা পাওয়া যেত। যারা শিল্প নিয়ে কাজ করতে তারা ওখান থেকেই বিভিন্ন আইডিয়া এক্সচেঞ্জ করতেন। টেলিভিশন ও সিনেমার জগতের অনেকেই আসতেন নন্দনে। তাদের মধ্যেই একজন আমাকে বলেছিলেন একটা চরিত্র করবার জন্যে। কিন্তু সেটা একটা জুনিয়ার আর্টিস্টের রোল ছিল। তখন আমি জানতামও না স্টুডিয়ো কেমন হয়। আমাকে চার লাইনের একটা ডায়লগ বলতে বলা হয়েছিল। যা দেখে আমার মন ভেঙে গিয়েছিল। আর এই রোলটা করার জন্য মাত্র দেড়শো টাকা পেয়েছিলাম আমি। তবে ধীরে ধীরে চার লাইনের ডায়লগ থেকে এক পাতার ডায়লগ বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপর একদিন বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরনাথ চক্রবর্তী আমার অভিনয় দেখে দুটো ফিল্মে কাস্ট করেছিলেন। একটা কর্মাশিয়াল ফিল্ম 'রিফিউজি' যেখানে আমি ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আর অন্যটি হল বাপ্পাদিত্যের 'কাঁটাতার' ছবি। যেখানে আমি একটি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সেই সময় একটা অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হত। সেই অ্যাওয়ার্ডটা আমি দুটো সিনেমার জন্যেই পেয়েছিলাম। অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার সময় আমার সামনে বসেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী ও যশ চোপড়া। সেখান থেকেই আমার জার্নি শুরু হয়েছিল।
প্র: আপনি অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু আপনার কী ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে?
রুদ্রনীল: একজন অভিনেতা হিসেবে আমার কোনও পছন্দ থাকা উচিত না। কিন্তু আমার পার্সনাল পছন্দ আবার মানুষের পছন্দের সঙ্গে মিলবে না। আমরা যে যেরকমই হই না কেন? অডিয়েন্স আমাদের একটা ধরনে পছন্দ করতে ভালোবাসে। যেমন- ধরো আবিরকে অডিয়েন্স বাড়ির জামাই হিসেবে দেখতে চান। মেয়েরা তার সঙ্গে প্রেম করার চেয়ে সংসার করবে এটাই বেশি ভাবে। এবার আবির কতটা এমন সেটা আবিরের বৌ নন্দিনী বলতে পারবে। আমাদের ইচ্ছাগুলো যেমন তার সঙ্গে অডিয়েন্সের ইচ্ছাগুলো মেলে না। কারণ তারা অভিনয়কে অন্যভাবে দেখেন। তাদের কাছে অভিনয়টা গ্ল্যামারও হতে পারে শিল্পও হতে পারে।
প্র: আপনার কেরিয়ার অনুযায়ী তুমি কী যথাযথ রেকগনাইজেশন পেয়েছ?
রুদ্রনীল: রেকগনাইজেশন...ধরো পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আজকে 'টনিক' নিয়ে বলছে। আজকে 'বরুণ বাবুর বন্ধু' নিয়ে বলছে। কয়েক বছর আগে 'প্রলয়' নিয়ে বলেছিল। ফ্যাক্টরটা হল একজন অ্যাক্টরের যতদিন শরীর সুস্থ থাকবে। তার স্মৃতি শক্তি ঠিক থাকবে ও অভিনয় অধ্যায়ন ক্ষমতা ঠিক থাকবে ততদিন তার সময় ফুরিয়ে যাবে না। চারটে পুরস্কার কে কাকে দিল কে কাকে দিল না সেই নিয়ে তো বিতর্ক চলছেই। তাই এর চেয়ে মনে হয় রাস্তায় যখন মানুষ আমার কাজের প্রশংসা করেছেন তখন বেশি খুশি হয়। যারা অ্যাওয়ার্ডের জন্য নমিনেটেড হয় তাদের মধ্যে তফাৎ উনিশ বিশের। আর অনেক ক্ষেত্রে যারা অ্যাওয়ার্ড দিলেন তাদের মধ্যেও একটা ব্যায়ার্স কাজ করে। ভালো অভিনেতা সেই, যে ভালো সহ অভিনেতা হতে পারেন। তাই যখনই কোনও অভিনেতা অ্যাওয়ার্ড পান তখন সেই অ্যাওয়ার্ড শুধুমাত্র তার যোগ্যতায় নয়, যারা তাকে চরিত্রটা হয়ে ওঠবার বিশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন তারাও কিন্তু সমান ভাবে ঐ পুরস্কারটার জন্য দায়।
প্র: আপনার বলিউড প্রজেক্ট 'ময়দান'। যেখানে অজয় দেবগনের সঙ্গে অভিনয় করেছেন আপনি। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
রুদ্রনীল: শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা শুটিংয়ের মতোই হয়। বেসিকটা একই থাকে। ২০১৯ সালে এই ছবির শুটিং শুরু হয়েছিল। লকডাউনের জন্য সিনেমাটা এতো পিছলো। শুধু এটা নয়, অনেক ছবির এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। তবে এখন ধীরে ধীরে সেগুলো রিলিজ করছে। আর সবচেয়ে বড় কথা 'ময়দান' একটা বিগ বাজেট মুভি। ইন্ডিয়ান ফুটবলের হিস্ট্রি ও রহিম সাহেবের জীবনী নিয়ে এই ছবি। তাই খুব সূক্ষ্ম ভাবে ছবিটা তৈরি হয়েছে। তবে অজয় ছাড়াও 'বাধা হো'র গজরাজ রাও, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জয়ী অভিনেত্রী প্রিয়া মণি আর আমি। চারটে মূল চরিত্র ছাড়াও আরও অনেকগুলি চরিত্র রয়েছে ছবিতে। ট্রেলার রিলিজের আগে আমি সেটা বলতে পারব না। আশা করছি দর্শকদের ভালো লাগবে ছবিটা। এবার তফাৎটা হল খুব মজাদার যারা টলিউডে টেকনিশিয়ানের কাজ করেন তাদের দেখেছি শুটিংয়ে সময় ভুল করে শব্দ করে ফেলার পর তাদের যখন পরিচালক বলে কে শব্দ করেছে? তখন তারাও জানতে চান ‘কে কে করেছে’? কিন্তু বলিউডে এই ঘটনা ঘটলে টেকনিশিয়ানরা পরিচালকের কাছে এসে বলেন ‘সরি ভুল হয়ে গিয়েছে’।
প্র: 'ভিঞ্চি দা' আর 'চ্যাপলিন'-এ আপনাকে সম্পূর্ণ একটা অন্য রকমের লুকে দেখা গিয়েছিল। সেটা করতে গিয়ে তোমার কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে?
রুদ্রনীল: একজন অ্যাক্টর যখন মারা যান বা যখন তিনি আর কাজ করবার মতো শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় থাকেন না বা স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নেন। তখন তার করা দশটা কাজ আলোচিত হয় না। অমিতাভ বচ্চন বললেই 'দিওয়ার' বেরিয়ে আসবে 'শোলে' বেরিয়ে আসবে। তার মানে তিনি আর ছবিতে কাজ করেননি। মহানায়ক উত্তম কুমার বললে আমাদের হয়তো পাঁচ ছবির নাম মনে পড়বে। তার মানে তিনি কী বাকিগুলোতে খারাপ কাজ করেছেন। তা নয়। আমার ক্ষেত্রেও আমি যদি কাল থেকে অভিনয় করা ছেড়ে দিই, তাহলে দর্শক 'ভিঞ্চিদা' ও 'চ্যাপলিন' ছবিটা দিয়েই আমাকে মনে রাখবে। 'ভিঞ্চিদা'র গল্পটা আমি লিখেছিলাম ২০১৬ সালে। তারপর সৃজিতের সঙ্গে এই গল্পটা নিয়ে আলোচনা হয়। ও খুব ইন্টারেস্টেড ছিল এই গল্প নিয়ে। তারপর সৃজিতের গল্প বলার ধরন অনুযায়ী গল্পটাকে সাজানো হয়। তবে আমি ছাড়াও সোহিনী ও ঋত্বিক দারুন অভিনয় করেছে ঐ ছবিতে। আর 'চ্যাপলিন'-এর গল্পটা পদ্মনাভর লেখা ছিল। পৃথিবীর একমাত্র শিল্পী যাকে নকল করে সব শিল্পীরা বেঁচে রয়েছে। চ্যাপলিনের চরিত্রটা আরও কঠিন ছিল।
এবার কিছু ফাস্ট কোয়েশ্চেনের উত্তর দেবেন অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ।
প্র: আপনি ফ্রি টাইমে কী করেন?
রুদ্রনীল: পাখিদের খাওয়াতে ভালোবাসি।
প্র: আপনি কী ফুডি?
রুদ্রনীল: ইন্টারেস্টিং কিছু দেখলেই খেতে ভালো লাগে। দামের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
প্র: ফেভারিট ক্যুইজিন কী?
রুদ্রনীল: চিংড়ি মাছের যে কোনও আইটেম। সেটা ধূলো মাখিয়ে দিলেও খেয়ে নেব।
প্র: বই ভালোবাসেন না সিনেমা দেখতে?
রুদ্রনীল: মেজরলি সিনেমা দেখতে। কিন্তু যখন বই পড়ি তখন সেটা সিনেমার মতো করেই দেখি।
প্র: টিভি, ওয়েব সিরিজ না ফিচার ফিল্ম?
রুদ্রনীল: অবশ্যই ফিচার ফিল্ম।
প্র: রাত জেগে কাজ করা না ভোরে ওঠা? কোনটা তোমার বেশি ভাল লাগে?
রুদ্রনীল: ভোরবেলা উঠতে আমি একদম পছন্দ করি না। এখন তো করিই না। রাতে আমি প্রায় আড়াইটে পর্যন্ত জেগে থাকি।
প্র: চা না কফি?
রুদ্রনীল: চা। কারণ কফি খেলেই আমার মনে হয় ভালো ইংরাজি বলতে হবে। আমি তো ভালো ইংরাজি বলতে পারি না।