ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে আজ তিনি ব্র্যান্ড। বহু সেলিব্রেটির পোশাক ডিজাইন করেছেন। আসানসোলের সেই মেয়ে আজ ফ্যাশন ডিজাইনার ছাড়াও রাজ্যের পরিচিত রাজনীতিবিদ। সকলেই অগ্নিমিত্রা পাল নামে চেনে। কীভাবে হয়ে উঠলেন ‘ব্র্যান্ড অগ্নিমিত্রা’? জিয়ো বাংলার পর্দায় আড্ডা উইথ অপ্সরা’য় আজ সেই গল্প নিয়েই মুখোমুখি ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল।
প্র: তোমার বড় হয়ে ওঠা আসানসোলে। পড়াশোনাও সেখানেই। তারপর কলকাতায়। কেমন ছিল তোমার ছোটবেলা?
অগ্নিমিত্রা: ছোটবেলার জীবন খুবই সিম্পল ছিল। আমরা দুই বোন। আমি বড়। আমার থেকে ছয় বছরের ছোট বোন। আমরা দুজনেই 'লোরেটো কনভেন্ট স্কুল'-এ পড়তাম। বাবা ডাক্তার। এখনও ডাক্তারি প্র্যাকটিস করেন বাবা। এখন বাবার বয়স সেভেনটিসিক্স। মা হোম মেকার। দুই মেয়েকে ভাল করে বড় করাই ছিল মায়ের লক্ষ্য। সেই কারণে এম.এস.সি ডিগ্ৰি থাকা সত্ত্বেও মা চাকরি করেননি। খুবই মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার যেমন হয় তেমনি আমার পরিবার। গরমের ছুটিতে কফিশপে যাওয়া, সিনেমা দেখতে যাওয়ার কোনও ব্যাপার ছিল না। আমাদের মোবাইল ফোনও ছিল না। গল্পের বই পড়া, ছবি আঁকা, নাচ শেখা, নাচের রেওয়াজ করা, বোন গান শিখত। গানের রেওয়াজ করা। খুবই ডিসিপ্লিন লাইফ ছিল।
প্র: কলকাতায় আসার পর তুমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছ। সেই সময়টা কেমন ছিল?
অগ্নিমিত্রা: আসানসোলে ক্লাস টেন পর্যন্ত লোরেটোতে পড়েছিলাম। তারপর আসানসোল গালর্স কলেজ থেকে ইলেভেন-টুয়েলভ কমপ্লিট করার পর বিবি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করেছিলাম বোটানিতে। বাবা ডাক্তার ছিলেন বলেই ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ওয়েটিং লিস্টে ডেন্টালে নাম এসেছিল। কিন্তু তখন ডেন্টাল পড়ার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। বাবা বললেন তোর এতই পড়ার ইচ্ছা যখন তখন আমি ডোনেশান দিয়ে তোকে সাউথে ভর্তি করে দিচ্ছি (প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে)। তারপর আমার মা আর আমার জেঠু আমাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত ভর্তি হইনি। কলেজের প্রফেসররা খুব ভাল ছিলেন বলেই হয়তো ভর্তির টাকাটা ফিরত দিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বিবি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম গ্র্যাজুয়েশন করব বলে। তারপর এম.বি.এ করার জন্য আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। এম.বি.এ করার সময় ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্সের কথা জানতে পেরেছিলাম। ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম। কোর্স করতে করতেই একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলাম। এই চাকরিটাই আমাকে একটা অ্যাডভান্টেজ দিয়েছিল। তারপর কোর্স শেষ করার পর আমি আমার নিজের ব্র্যান্ড লঞ্চ করলাম। আমার ব্র্যান্ডের নাম ছিল 'ইনগা'। এখন ওই দিনগুলোকে প্রিহিস্টোরিক টাইম মনে হয়।
প্র: তুমি শ্রীদেবী, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, মিঠুন চক্রবর্তী, নেহা ধুপিয়া মতো সেলিব্রেটির জন্য ডিজাইন করেছ। এই জার্নিটা কেমন ছিল?
অগ্নিমিত্রা: আমার পরিবারে কেউ কোনও দিন ডিজাইনার হয়নি। পুরোটাই আমার কাছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত হচ্ছে শেখা। তখন মনীশ মালহোত্রা ফিল্ম কস্টিউম ডিজাইন করা শুরু করেছিল। তখন আমারও মনে হল মনীশ মালহোত্রা যদি করতে পারে, তাহলে আমিও করতে পারবো। তখন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাই প্রশ্ন উঠেছিল বম্বে গিয়ে একা থাকা ও যাওয়া নিয়ে। তখন আমার বাবাকে বললাম। বাবা বললেন ‘চলো’। বাবাকে নিয়েই বম্বে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে কারুর অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়াটাই বিরাট ব্যাপার।
অনেক ওয়েট করার পর শ্রীদেবীর অ্যাপয়েনমেন্ট পেয়েছিলাম। তারপর দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। প্রথমে শ্রীদেবী নিজের ড্রেস ডিজাইন করতে বলেছিলেন আমাকে। কিন্তু তিন চার মাস পর আমাকে হঠাৎ তিনি ফোন করে একটা ছবির ড্রেস ডিজাইনের দায়িত্ব দেন। ছবিতে এষা দেওলকে লঞ্চ করার কথা ছিল। সেই সূত্রেই প্রথম দেখা হয়েছিল এষা দেওলও হেমা মালিনীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। তারপর আমি এখানে টলিউডে ঋতুপর্ণাদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে আমাকে ডাকা হয়েছিল। তারপর ওঁর একটা সিনেমার কস্টিউম ডিজাইন করেছিলাম আমি। তারপর ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের অনেক ছবিতে কস্টিউম ডিজাইন করেছিলাম আমি। সেখানেই মিঠুনদার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল আমার। আমাকে একজন বলল মিঠুনদা হেল্প করতে পারে বলিউডে কাজ পাওয়ার জন্যে। তারপর মনীষা কৈরালা, নেহা ধুপিয়া, ইয়ামি গৌতমের জন্য ডিজাইন করেছিলাম। এভাবেই একটার পর একটা ফ্যাশন আমার ডিজাইন করা ড্রেশ দেখানো হতে লাগলো। আমি হিলারি ক্লিনটনকে একটা শাল গিফট করেছিলাম। যার জন্যে আমাকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন।
প্র: এত কিছু তুমি ডিজাইন করেছ। সেখানে থেকে তুমি রাজনীতিতে এসেছ। কিন্তু তোমার মনে যে দুটো ফিল্ডকে ব্যালেন্স কীভাবে বা এই ইচ্ছেটাই কেন হয়েছিল তোমার?
অগ্নিমিত্রা: রাজনীতি সাচ অ্যা ডিফিকাল্ট প্রফেশন। সব প্রফেশনেই রাজনীতি থাকে। কিন্তু আমি রাজনীতিতে এসেছি সেবা করার জন্য। আমার নিজের হোম টাউন আসানসোল দক্ষিণের এমএলএ হয়েছি আমি। এটা আমার একটা বিরাট পাওয়া। আমি যখন ডিজাইনিং করেছি তখনও ট্রাফিকড ওম্যানদের জন্য ফ্যাশন শো করেছি। ভিজুয়ালি চ্যালেঞ্জড শিশু তাদের জন্য কাজ করেছি। বাংলাদেশে গিয়েছি ওখানে যাদের উপর অ্যাসিড অ্যাটাক হয়েছে তাদের নিয়েও শো করেছি। আজ আমি একটা বড় জায়গায় এসেছি। মানুষের হয়ে কাজ করার জন্য একটা পাওয়ার দেওয়া হয়েছে আমাকে।
প্র: নেক্সট যারা আপকামিং জেনারেশন পলিটিক্সে জয়েন করতে চায় তাদের জন্য কী বলতে চাইবে তুমি?
অগ্নিমিত্রা: আজকের ছেলেমেয়েরা খুবই কেরিয়ার ওরিয়েন্টেড। তুমি রাজনীতিতে না ঢোকো কিন্তু দেশের জন্য কাজ করতে হবে তোমাকে। তুমি দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাও, ব্ল্যাড ডোনেশন ক্যাম্পের ব্যবস্থা করো। হোয়াট এভার দেশের আপলিফটের জন্য কিছু করো।
প্র: তোমার কাছে পলিটিক্সের কথা শুনছিলাম। তুমি ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড থেকে নন ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে এসেছ। এই ট্রান্সফরমেশানটা কেমন লাগে?
অগ্নিমিত্রা: সত্যি বলতে নর্থ পোল আর সাউথ পোল হয়ে গিয়েছে। তবে জীবন একই রকম আছে। কিন্তু যে প্রফেশনাল ওয়ার্ল্ডে আগে ছিলাম বা যাদের সঙ্গে আগে দেখা হতো। তারা ছিলেন ক্রিম অফ দ্য সোসাইটি। যদিও বা খুব সাধারণ মানুষও আমার আসে ড্রেস ডিজাইন করাতে। তবে এখন যারা গ্ৰাস রুট লেভেলে রয়েছেন তাদের সঙ্গে আমার কাজ।
প্র: তুমি মা হিসেবে কীভাবে সব কিছু ম্যানেজ করো। আর কতটা টাইম স্পেন্ড করতে পারো?
অগ্নিমিত্রা: আমার দুই ছেলে। বড় ছেলে বড় হয়ে গিয়েছে কিন্তু ছোট ছেলে এখনও বেশ ছোটই। আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করি তাদের সময় দেওয়ার। কিন্তু মাসের ১০ দিন বিধানসভায় থাকি। আমার এলাকার মানুষরাও তো আমার সন্তান। আমার ছেলেদের বোঝাই যে তোমরা যেমন আমার বাচ্চা ওরাও আমার বাচ্চা। তোমাদের মাকে একটু ভাগ করতে হবে। তবে ছেলেদের সঙ্গে সিনেমা দেখা, খেলাধূলোও করি সময় থাকলে। ওরা অনেক স্যাক্রিফাইস করছে আমার জন্যে।
প্র: এমন কোনও ডেজাইরেবল ব্যক্তিত্ব যার জন্যে তুমি এখনও পোশাক ডিজাইন করনি। কিন্তু তোমার ডিজাইন করার ইচ্ছা রয়েছে। কে তিনি?
অগ্নিমিত্রা: যার কথা ভেবে ছিলাম, যাদের কথা ভেবে ছিলাম তাদের মধ্যে অনেকেই এখন এই পৃথিবীতে নেই। যেমন- সুচিত্রা সেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল ওঁর ড্রেস ডিজাইন করার। স্বপ্ন ছিল মাইকেল জ্যাকসনের জন্য ড্রেস ডিজাইন করার। লেডি ডায়নার জন্য ড্রেস ডিজাইন করার স্বপ্ন ছিল। এছাড়াও অমিতাভ বচ্চনের জন্য ড্রেস ডিজাইন করার ইচ্ছা রয়েছে। তবে স্বপ্ন আছে রাজ্যের মহিলাদের কে কাজ শিখিয়ে এম্পাওয়ার করার। যাতে মাসের শেষে তাদের হাতে কিছু টাকা আসে। এই কাজ করতে পারলেও আমার অনেক আনন্দ হবে।
প্র: তোমার আপকামিং প্রজেক্টগুলো নিয়ে একটু বলো?
অগ্নিমিত্রা: প্রথমেই আমি আমার স্টুডিয়োটা চেঞ্জ করে একটা বড় স্টুডিয়ো নিচ্ছি। সেই স্টুডিয়োটা আরও অন্যরকম ভাবে করার ইচ্ছা রয়েছে। এতদিন আমি ভারতবর্ষের আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট নিয়ে কাজ করেছি। তার পাশাপাশি এবার টেক্সটাইল নিয়েও কাজ করবার ইচ্ছা রয়েছে। এছাড়াও গ্ৰাউন্ড লেভেলের মানুষগুলোকে উঠিয়ে এনে তাদের কিছু কাজ রাখা। এরকমই প্ল্যানিং রয়েছে। এটাই এখন সব থেকে বড় প্রজেক্ট। বাকি তো জীবনটা রাজনীতির মধ্যেই অনেকটাই এখন চলে এসেছে।
এবার কয়েকটা ফাস্ট কোয়েশ্চেনের উত্তর দেবেন ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পাল
প্র: তুমি তোমার ফ্রি টাইমে কী করতে ভালোবাসো?
অগ্নিমিত্রা: ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটানো বা গান শোনা।
প্র: ফুডি না ননফুডি?
অগ্নিমিত্রা: ফুডি। কমপ্লিটলি।
প্র: তোমার ফেভারিট ক্যুইজিন কী?
অগ্নিমিত্রা: সব রকমের। কলমি শাক, নিম বেগুন খেতে ভালোবাসি। থাই খাবার ও ফিস স্যুইমায় খুব ভাল লাগে।
প্র: টি না কফি পার্সন?
অগ্নিমিত্রা: আমার কফি। কিন্তু লেমন টিও খুব ভালো লাগে।
প্র: নাইট আউল না আর্লি রাইজার?
অগ্নিমিত্রা: দুটোতেই আমি কমফর্টেবল।
প্র: ফ্যাশন না পলিটিক্স?
অগ্নিমিত্রা: দুটোই আমার কাছে খুব ইম্পর্টেন্ট। দুটোই আমার অক্সিজেন।