বাবার স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মেয়ের কঠিন জীবন সংগ্রাম, কচুরির দোকান থেকেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছেন হাবড়ার মৌমিতা
বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই মাত্র ১৮ বছরেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল হাবড়ার মৌমিতাকে। ছোট থেকে বাবার হাত ধরে যে কচুরির দোকানে আসা শুরু হয়েছিল তার, সেই দোকানেরই কান্ডারী এখন সে।
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব আর স্বপ্নপূরণে নিজেই চালাচ্ছেন কচুরির দোকান।টিম জিও বাংলা পৌঁছে গিয়েছিল হাবরা স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে মৌমিতা ওঝার কচুরির সেই দোকানে।
এই দোকানের বিখ্যাত কচুরির কথা হাবরার মানুষের মুখে মুখে। সকাল হতে না হতেই দোকানের সামনে ভিড় লেগেই থাকে। ২ পিস কচুরি মাত্র ১০ টাকায়। কম দামে পেট ভর্তি লোভনীয় কচুরি মন কেড়েছে সকলের।
দোকানে মৌমিতাকে সাহায্য করার জন্য সঙ্গে থাকেন তাঁর মা কল্পনা ওঝা। প্রথমেই লোভনীয় কচুরি টেস্ট করার পর সরাসরি কথা বলে নেওয়া হল তাঁর সাথেই, তিনি জানালেন – দীর্ঘ ৪০ বছর পুরোনো এই পারিবারিক কচুরির দোকান, আগে একসঙ্গে দোকান থাকলেও পরে দোকানের মালিকানা দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়। ২০২০ সালে লকডাউনের সময় পারিবারিক বিভিন্ন কারণে দোকান ভাগ হয়। তিনি জানান, ২০২১ এর জুলাই এ মৌমিতা বাবাকে হারিয়েছেন। লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন তিনি।পরে ধরা দেয় লাং ইনফেকশন। বাবার মৃত্যুর পর স্বপ্নপূরণ এবং সংসার চালানোর তাগিদে কচুরির দোকানের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মৌমিতা।দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেই দোকানের টুকটাক কাজে সাহায্য করতো মেয়ে। স্বামী হারানো বিদীর্ণ হৃদয়ে মেয়ের কথা বলতে বলতে চোখে জল এলো কল্পনা ওঝার।
তারপর নিজের সংগ্রামের কাহিনী বলতে গিয়ে মৌমিতা জানিয়েছেন, “বাবার মৃত্যুর পর আমি দোকানের হাল না ধরলে পরিবারটা হয়ত ভেসে যেত। প্রথম প্রথম ব্যবসা বুঝতে কিছু সমস্যা হলেও অল্প দিনেই সবটা রপ্ত করে ফেলি। দোকানে আমি ছাড়াও আমাকে সাহায্য করতে মাঝে মধ্যে মা’ও এসে বসেন। সেই সঙ্গে জোর কদমে চলেছে আমার MA-এর সিলেবাস শেষের জন্য পড়াশুনাও” .
মৌমিতা আরো জানান , “এতো মানুষ , যাদের আমি চিনিনা , জানিওনা তাদের শুভেচ্ছা পাচ্ছি এটাই অনেক বড় পাওনা “
কাশতে কাশতে বাবার মুখে রক্ত উঠে বাবাকে কষ্ট পেতে দেখে মৌমিতা। তখন থেকেই মায়ের সাথে ভোরে উঠে দোকানে আসে সে। দোকান খোলার ১০মাস পর বাবার আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। বাবার পাশে দাঁড়াবে বলে দোকানে আসা। এখন সব দায়িত্ব তার কাঁধে।
পড়াশুনোর ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়নি ? এই প্রসঙ্গে তার বক্তব্য , “তখন তো সবকিছু অনলাইনে ছিল তাই সেরকম অসুবিধা হয়নি। বিধাননগর গভমেন্ট কলেজে তো পড়তাম আমি। তো সেখানকার স্যার ম্যাডামরা খুব সাহায্য করেছেন আমায়। বাবা মারা যাবার পর থেকে আর্থিক দিক থেকেও সাহায্য করেছেন তারা। এখনো খোঁজ খবর নেন “
সারাদিনের খাটুনির পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফায়ার ক্লান্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পড়তে বসে মৌমিতা। বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি থেকে সে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করছে ডিস্টেন্সেই।
ভবিষ্যতে কি প্ল্যান মৌমিতার ? দোকানকে নিয়েই স্বপ্ন বুনবেন নাকি অন্য পথ বেছে নেবেন ?
“আমার পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষে আমি টিচিং প্রফেশনের দিকেই এগোতে চাই। দোকানটাকেও অনেক বড়ো করার ইচ্ছে আছে। আমি জানি বাবা কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দোকান আলাদা করেছিল। যখন ভোরবেলা সাইকেল নিয়ে আলু নিয়ে যেত , আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে কতটা কষ্ট হতো বাবার আমি জানি। আমি চাই এভাবেই বাবার আশীর্বাদ ,আপনাদের আশীর্বাদ,ভালোবাসা পেয়ে আমার ও দোকান আরও বড়ো হোক।
মৌমিতা বলে,হাওড়া,রানাঘাট,টালিগঞ্জ থেকেও গুরুজনেরা আশীর্বাদ করতে , খোঁজ খবর নিতে আসে তার দোকানে। সকলের আশীর্বাদে , ভালোবাসায় স্বপ্ন সত্যি হোক মৌমিতার। তার এই প্রয়াসকে হাজার হাজার কুর্নিশ।