জশন-ই-হালিম

দুপুরের খাঁ-খাঁ তেজ তখন ঝিমিয়ে আসতে শুরু করেছে। আকাশ ঢাকা ফ্ল্যাটের লম্বা লম্বা মাথাগুলো পার হয়ে একটা-আধটা রোদের রেখা এসে পড়ছে সাজিয়ে রাখা টেবিলের ওপর। 

হাওড়ার পিএম বস্তির গলিতে। ইনায়েত আনসারিদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। টেবিলের ওপর ধবধবে প্লেট। তরমুজ, আপেল, কলা, তেলেভাজার সঙ্গে একটা প্লাস্টিকের বক্সও রাখা।

মধ্য পঞ্চাশের বুলা সরকার নেড়ে চেড়ে দেখেন বাক্সটা। ইফতারের ভোজে খেতে এসেছেন। তাঁর যাবতীয় কৌতূহলের কেন্দ্রে ওই ছোট্ট বাক্সটাই।

অপার জিজ্ঞাসা, “কী আছে ওর মধ্যে?”

নমাজের সুর মিলিয়ে যেতেই আর ধৈর্য্য দেখাতে পারলেন না। খুলে ফেললেন বাক্সের মুখ।

ভিতরে উঁকি দিচ্ছে থকথকে গাড় সোনালি রঙের ডাল। ভাজা বেরেস্তা, সবুজ ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কার কুচি ভাসছে। ম-ম গন্ধটা নাকে এলেই  দপদপিয়ে বেড়ে যায় খিদেটা। এক চামচ তুলে নিয়ে মুখে চালান। ছোট ছোট মাংসের কুচিতে জিভ ঠেকে যায়। স্বর্গীয় স্বাদ।

(জমজমাট ইফতার)

হালিম। রমজানের কলকাতার নতুন প্রেম।

বিরিয়ানি কাবাবের একচেটিয়া রাজত্বের পর কিছুটা যেন দুম করেই কলকাতা দখল নিয়ে নিয়েছে ‘হালিম’শুধু কলকাতায় নয়, জেলাগুলোতেও চলছে একই ট্রেন্ড। বড় রেস্তোরাঁ তো বটেই গলিতে গলিতেও। ছাউনি বেঁধে হালিম কাউন্টার। জায়েন্ট সাইজ পিতলের হাঁড়িতে ফুটন্ত হালিম। কাস্টমার চাইলেই লম্বা লোহার হাতায় করে তুলে কাচের বাটিতে। পরিবেশনের সময় সাথে যোগ করা হয় পেঁয়াজের বেরেস্তা, সবুজ ধনেপাতা, আদা, কাঁচা লঙ্কা ও লেবু।

২০- ৩০ থেকে শুরু করে ৩০০ সব রকম দামেই বিকোচ্ছে।

কী এই হালিম?

হালিম শব্দের আক্ষরিক অর্থ সহিষ্ণু। আল্লার নিরানব্বইটি নামের মধ্যে এক নাম।

হালিমের মূল উপাদান বিভিন্ন রকমের ডাল, গম,  সুগন্ধি চাল এবং মাংস। মুগ, মুসুর, অঢ়হড়, ছোলা আট ঠেকে দশ রকমের ডাল। ৬-৮ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেই ডাল, চাল ও গম ভালোভাবে সেদ্ধ করে নিতে হয়। পরিমাণমত পেয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা, এলাচ, মরিচ গুড়ো, হলুদ গুড়ো, দারুচিনি ও গরম মশলা সমেত আলাদা পাত্রে মাংস ভালোভাবে কষিয়ে নিতে হয়। তারপর ভালোভাবে মিহি করে নেওয়া সেদ্ধ ডাল, চাল ও গম কষানো মাংসের সাথে মিশিয়ে এর সাথে পরিমাণমত জল ও নুন দিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক নাড়তে হয়। তারপর তৈরি হয় হালিম। হালিম তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘন্টার কাছাকাছি। 

 ইতিহাস কী বলে?

রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে মধ্য-প্রাচ্যের মানুষরা, ডাল মাংস মশলা দিয়ে খিচুড়ির মত এক ধরনের পদ বানাতেন। যার ডাকনাম ছিল ‘হারিশা’। ‘হরিশা’ই নাম বদলে আজকের ‘হালিম’

হারিশা’ ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে পছন্দের পদ।

তবে লেভান্ত অঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান সিরিয়া ও লেবাননে বহুযুগ আগে থেকে খ্রিস্টানরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হারিশা বিশেষভাবে রান্না করতেন। অনেকটা বাংলাদেশে লাইলাতুল বরাতে হালুয়া রুটি তৈরির মতো।

লন্ডনপ্রবাসী প্রখ্যাত রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউতার Lebanese Cuisine(1994) গ্রন্থে লিখেছেন, লেভান্তে গরিবদের একসাথে খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিশা রান্না করা হত, যার তুলনা করা যেতে পারে বর্ষার দিনে বাঙালির প্রিয় কিমা খিচুড়ির সঙ্গে। 

হারিশার সবচেয়ে পুরনো লিখিত রেসিপি পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় দশম শতকের দিকে বাগদাদে কিতাব আল তাবিখ (The book of recipes) নামের রান্নার বইতে। এই বইটিতে সংকলন করা হয়েছিল তৎকালীন রাজা বাদশাহদের খাবার টেবিলের উপাদেয় বেশ কিছু খাবারের রন্ধনপ্রণালী। বইটির লেখক আবু মুহাম্মদ আল মুজ্জাফর ইবন সায়ার।

এমনকি ইবন বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও তিনি উল্লেখ্য করেছেন পারস্যে ডাল, ঘি এবং গোশত দিয়ে রান্না করা হারিশার কথা।

  ‘হারিশা’র ভারতীয় নাম ‘হালিম’ কেন হলো

এই প্রশ্নের নানা রকম উত্তর পাওয়া যায়। তবে সব চেয়ে লজিক্যাল কারণটা বোধহয়, হালিম স্লো কুক ডিশ।

 হালিম রান্না করতে প্রচুর সময় ও ধৈর্যের দরকার।

 আরবিতে হালিম শব্দের অর্থ হলো ধৈর্যশীল। হয়ত সেখান থেকেই নামকরণ করা হয়েছে হারিশার ভারতীয় সংস্করণ হালিমের।

হালিম’ ভারতে কী করে এল?

ভারতে হারিশা’র আগমন মুঘলদের মাধ্যমে।

দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে ভারতে হারিশার আগমন হলেও হারিশা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় হুমায়ূনের পুত্র সম্রাট জালাউদ্দিন আকবরের আমলে। সম্রাট হুমায়ূনের সাথে পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাই বলা যায় পারস্য হয়ে হারিশা ভারতে এসেছিল।

আকবরের শাসন আমলে লিখিত আইন-এ-আকবরী গ্রন্থে পাওয়া যায় হারিশার কথা। তবে ভারতবর্ষে আরব বণিক ও ইসলাম প্রচারকদের আগমন সেই রাসুলুল্লাহ হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এর সময় থেকেই। তাই আরবদের হাত ধরে যে ভারতে হারিশা এসেছিল, এ নিয়ে কোনও দ্বিধার অবকাশ নেই।

হায়দ্রাবাদী হালিম

 বিরিয়ানীর মতোই হায়দ্রাবাদী হালিমও হায়দরের শহরের সিগনেচার।

ভারতবর্ষে হালিম জনপ্রিয়করণের পেছনে হায়দ্রাবাদী হালিমের অবদান অনস্বীকার্য। হায়দ্রাবাদের নিজামদের আরব সৈন্যরাই নাকি হারিশা এনেছিল হায়দ্রাবাদে।

তবে বিংশ শতকে হালিমকে জনপ্রিয় করেছেন যে মানুষটি তিনি সুলতান সাইফ নাওয়াজ জং বাহাদুর।

 ইয়েমেনী জমিদার সুলতান সাইফ ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামদের দরবারের খানদানি আমির ওমরাহ্‌দের একজন। তাঁর বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মেহমানদের দাওয়াতে সব সময় থাকত মাতৃভূমি ইয়েমেনি ছোঁয়া। হারিশা। ইয়ামেনি হারিশা ভারতীয় মশলার আদরে আজকের হালিম।

মধ্যপ্রাচ্যের হারিশার সাথে ভারতবর্ষের হালিমের মূল পার্থক্যটাই হল মশলার ব্যবহারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য খাবারগুলোর মতোই হারিশাতে মশলা ব্যবহার করা হয় তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু ভারতবর্ষে মশলার সমারোহ এবং জনপ্রিয়তার কারণে হালিমও হয় বেশ মশলাদার।

 নিজামদের যুগ অবসান হওয়ার পর ১৯৫০ এর দশকে হায়দ্রাবাদের ইরানি খাবার হোটেলগুলোতে সর্বপ্রথম হালিম বিক্রি শুরু হয়।

তখন এক বাটি হালিমের দাম ছিল মাত্র ৩ পয়সা।

হালিমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার জন্য ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান পেটেন্ট অফিস হায়দ্রাবাদী হালিমকে প্রথম ননভেজ খাবার’ হিসাবে পেটেন্ট দিয়েছে।

অর্থাৎ ভারতে কেউ হায়দ্রাবাদী হালিম নামে কোনো হালিম বিক্রি করতে চাইলে তাকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড মেনে হালিম বানাতে হবে।

কলকাতার হালিম জায়েন্ট

কলকাতা শহরে বেশ কয়েকটা হালিম জায়েন্ট রয়েছে।

হালিম ট্রেন্ড’ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেই সব জায়গায় হালিমের হাঁড়ি দেখা যায়। সারা বছর ধরে ভিড় লেগে থাকে। এই শহরে হালিম খাবার পুরনো জায়গাগুলোতে মূলত বিফ হালিম মেলে, দামও অনেকটা সস্তা। সেই অর্থে ঝকঝকে-চকচকে গ্ল্যমার নেই। কিন্তু খাবারের গন্ধ আপনাকে টেনে আনবে।

 এলিট সিনেমার উল্টো দিকে ডান হাতের রাস্তায় আমিনিয়া।  সোজা হগমার্কেটে দিকে এগোলে বরদা ব্যাঙ্কের এটিএম। তার সামনেই পাবেন এই অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় হালিমওয়ালা’কে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে খাবার অভ্যাস থাকলে চেখে দেখতেই পারেন।

ওয়াটার লু স্ট্রিটের আলিয়া৷ ৭৫ বছরের পুরনো। মটন হালিমের জন্য বিখ্যাত ৷

 সেন্ট্রাল মেট্রো থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই নাখোদা মসজিদের গলি। কলুটোলাকে ল্যান্ডমার্ক ধরে এগোলে পেয়ে যাবেন জাদিদ ইসলামিয়া হোটেল। ৮০ বছরের পুরনো। এখানে স্পেশাল আরবি হালিম পাবেন। রয়্যাল ইন্ডিয়া হোটেল। চিকেন, মাটন দুই ধরনের হালিম-ই পাওয়া যায়।

গোটা জাকারিয়া স্ট্রিটফিয়ার্স লেন জুড়েই অনেক হালিমের দোকান পাবেন। প্রেসিডেন্সির পিছন দিক ধরে হাঁটলে কলাবাগান। চাঁদনি চক, রাজাবাজার বাদ দেবেন না। হালিমের জন্য ট্রাই করতে পারেন।

মিস করবেন না পার্কসার্কাস। জিশান, সিরাজ, আরসালান তো আছেই এছাড়াও হাঁটতে পারেন মল্লিকবাজার, বেকবাগানের ফুটপাত ধরেও। খালি হাতে ফিরবেন না।

খিদিরপুরের ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্ট। বিরিয়ানির জন্য জনপ্রিয় কিন্তু হালিমের জন্যও মনে রাখতে পারেন।

হালিম রমজান মাসের খাবার নয়। হালিমের ইতিহাসের সঙ্গে রমজানের কোনও সম্পর্কও নেই। কিন্তু খাবারের ইতিহাস ভূগোলের ঠেকে অনেক বেশি সুস্বাদু তা জিভে চেখে দেখা স্বাদ।

ফুটপাত থকে অনলাইন দেদার বিক্রি হচ্ছে হালিম। স্বাদের কাছে হেরে গিয়েছে জাতের লড়াই। খিদের যেমন ধর্ম হয় না তেমন বোধহয় স্বাদেরও। সব ধর্ম মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় ভাল স্বাদের কাছে। চারপাশের অস্থিরতা আর আগুনে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে লেটেস্ট হালিম ট্রেন্ড সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...