রাজার হালে থাকা এক যুবরাজ

১ এপ্রিল, ২০১১। ঈশ্বরের সঙ্গে 'ডিল' হয়েছিল তাঁর— যা চাও, নিয়ে নাও। ইচ্ছে করলে জীবনটাও। কিন্তু কাপটা দাও!‌
২ এপ্রিল, ২০১১। চেতানো বুক। দু'পাশে বিস্তৃত বলশালী দু'বাহু। ওয়াংখেড়ের পিচের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে সিংহগর্জন করেছিলেন তিনি। সিংহগর্জন? আলবাত!‌ তিনি তো সিংহই!‌ যুবরাজ সিং।

তার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের 'প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট' ঘোষিত হবেন। ম্যাক্সিমাম সিটি মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের ওপর সেই মায়াবী রাত। ১২১ কোটির দেশকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তুঙ্গ আবেগ, উন্মাদনা আর জয়ের ঢেউ। বিভ্রমের মতোই লাগে কখনও–সখনও। এখনও।

উনিশে জানুয়ারি, ২০১৭। কটকের বরাবাটি স্টেডিয়ামের উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো হাত মাথার ওপর তুললেন তিনি। শিরস্ত্রাণে ঢাকা মাথা খানিকটা হেলে গিয়েছে পিছনে। দৃষ্টি শূন্যে। আকাশের দিকে তোলা দু'হাতের কোথাও কোনও আস্ফালন নেই।

 

yubrajsingh1

 

কয়েক লহমা কাটল। দস্তানা–পরা মুষ্টিবদ্ধ বাঁ'হাত দিয়ে ডানহাতে ধরা ব্যাটের ব্লেডে একটা চাপড় মারলেন (‌নাকি আদর করলেন? প্রিয় পোষ্যের মতো)‌ তিনি। তারপর একবার ব্যাটের হ্যান্ডেলটা আরেকবার মুঠো–করা বাঁ'হাতটা ঠুকতে লাগলেন বুকের বাঁ'দিকে (‌ওখানেই তো হৃদয় থাকে।‌‌ বিসিসিআইয়ের কোনও এক অর্বাচীন অবশ্য পরদিন তাঁকে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে প্রশ্ন করবেন, বিসিসিআইয়ের লোগোর ওপর কেন বারবার ব্যাটের হাতল ঠুকছিলেন!‌ সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বসা বেতনভুককে কে বোঝাবে, কোনও লোগো–টোগো নয়। ওই ইনিংসটা হৃদয়ের জন্য। সেটাই দেখাচ্ছিলেন যুবরাজ)‌।

সেই ভঙ্গিতে পাঁচ বছর আগের সেই রাতের মতো ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছনোর নির্ঘোষ নেই। তা হলে কী আছে? আছে কৃতজ্ঞতা। আছে আকুতি। আছে  নীরব বিবৃতি আর অমোঘ আত্মবিশ্বাস।

খানিক পরে তিনি বলবেন, 'ইটস প্রোব্যাবলি মাই বেস্ট ইনিংস। ওয়ান–ফিফটি ওয়াজ আ টার্গেট ফর মি। আই ওয়ান্টেড টু প্রুভ আ পয়েন্ট টু মাইসেল্ফ। আই নিউ ইট ওয়াজ কামিং।' মানে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল যে, গোটা পৃথিবী নয়। যুবরাজ সিংয়ের নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার দরকার ছিল। এবং তিনি জানতেন, নিজেকে প্রমাণ করেই ছাড়বেন। সাধে কি তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে লেখা 'ইফ আই ক্যান, ইউ ক্যান'। যদি আমি পেরে থাকি, তোমরাও পারবে। নাকি তাঁর সংগঠনের নাম হয় 'ইউউইক্যান'! তোমরা–আমরা পারি।

টুইটারে যখন প্রশংসার ঝড় বয়ে যাচ্ছে (‌শচীন তেন্ডুলকার 'সুপারস্টার' আখ্যা দিয়েছেন। চিরকালীন সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন লিখছেন, 'চ্যাম্পিয়নরা হাতেকলমে প্রমাণ দেয়। আজ তুমি সেই বিরল চ্যাম্পিয়ন'), তখন প্রাক্তন টিমমেট লিখলেন, 'আরে এই লোকটা ক্যান্সারকে হারিয়েছে। আজ তো স্রেফ কয়েকটা ইংরেজ বোলারকে হারাল! ওকে দেখে সকলের শেখা উচিত যে, কখনও হাল ছাড়তে নেই।'

 

yubrajsingh2

 

বীরেন্দ্র শেহবাগ যা লিখেছেন, সেই কথাটাই খানিক বিস্তারে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন যুবরাজ—'যতই খারাপ সময় আসুক, আশা, সঙ্কল্প আর সাহস দিয়ে তা কাটিয়ে ওঠা যায়। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সেই শক্তি আছে। স্বপ্ন দেখা ছেড়ো না। হাল ছেড়ো না।' বলেছেন, 'সেদিন আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। ক্যান্সার কী করতে পারে, সেই ভয়ে নয়। আমি চোখের জল ফেলেছিলাম, কারণ, আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলাম। আমি ওই বিশ্রী অসুখটা চাইনি। ওই অসুখটা আমার স্বাভাবিক জীবনটা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।'

ক্রিকেট থেকে ক্যান্সার। সেখান থেকে ফিরে আসা আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্পোর্টে, যা ফিটনেসের সঙ্গেই সমানে সমানে দাবি করে কঠিন মনন এবং বুকের কলজে। সেই বুক, যা ক্যান্সারের আক্রমণে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। একে কি নিছক 'ফিরে আসা' বলা যায়‌? এত অনায়াস শব্দবন্ধে বোঝানো যায় এই তিতিক্ষা, অধ্যবসায়, দাঁতে দাঁত চাপা হার মানতে না–চাওয়া মানসিকতাকে? নাহ্‌‌! একটু ভারিক্কি তৎসম শব্দ থাক। স্রেফ বিষয়টার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য—'প্রত্যাবর্তন'।

একদা (‌বিরাট কোহলি জমানা শুরুর আগে)‌ তিনি ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের একমেবাদ্বিতীয়ম পোস্টার বয় (‌অনেকে দুষ্টুমি করে ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাড বয়ও বলতেন)‌। এখন তিনি জীবনের রূপকথার রোল মডেল!‌ ২০১১ সালের এপ্রিলে বিশ্বকাপ ফাইনাল। মে মাসে ফুসফুসে টিউমার ধরা পড়া (‌দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ান ডে খেলতে গিয়ে কাশির সঙ্গে রক্তপাত। গলা খাঁকারির কাশির সঙ্গে হোটেলের ওয়াশবেসিনে রক্ত দেখে খানিকটা উচাটনও হয়েছিলেন। পাত্তা দেননি। কিন্তু ক্রমশ দেখছিলেন, রাতে ঘুম আসছে না।

 

yubrajsingh3

সিঙ্গলসকে দৌড়ে দুই করতে গিয়ে হাঁফ ধরছে অনবরত। হাঁ করে বাতাস গেলার চেষ্টা করতে হচ্ছে। তখনও তোয়াক্কা করেননি। হাজার হোক, সামনে বিশ্বকাপ। তা–ও দেশের মাটিতে। কিন্তু বিশ্বকাপের সাতটা সপ্তাহ কেটেছিল অসহ্য শারীরিক কষ্টে। রক্তবমি, শ্বাসকষ্ট আর অনিদ্রায়)‌। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে যখন তাঁর জার্ম সেল ক্যান্সার ধরা পড়ল, তার আগে যুবরাজ আঙুল ভেঙে ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়ে গিয়েছেন। কোথায় দলে ফেরার জন্য লড়াই শুরু করবেন, না তাঁকে যেতে হল ডাক্তারের চেম্বারে!‌ ২৫ জানুয়ারি আমেরিকার ইন্ডিয়ানাপোলিসে ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু হয়েছিল তাঁর। মৃত্যুভয়। কেমোথেরাপির চোটে মাথার চুল পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নিজে নিজেই মাথা মুড়িয়ে ফেলা।

বিনিদ্র রাতে একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলা। প্রাইভেট অ্যাপার্টমেন্টের নিচের ঘরে মা শবনম সিং। ওপরে কালান্তক ব্যাধিতে আক্রান্ত তাঁর যুবক পুত্র। কেমোথেরাপির সময় যে ক্যান্সারকে জয়–করা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সাইক্লিস্ট ল্যান্স আর্মস্ট্রংয়ের আত্মজীবনী পড়ে। দু'মলাটের পেপারব্যাককে মনে হয় একমাত্র বন্ধু, গাইড, সঙ্গী। কখনও কখনও বিষণ্ণ বিকেলগুলোয় যে ভাবে, তার সঙ্গেই কেন এমন হল!‌ যে ভাবে সেই পয়লা এপ্রিল রাতের কথা— কী বোকার মতো 'ডিল' করেছিলাম!‌ জীবন নাও। বিশ্বকাপ দাও। হাঃ!‌ তখন কি ওপরওয়ালার কাছে ক্যান্সার চেয়েছিলাম? ঈশ্বরের সঙ্গে 'ডিল' করার সময় কি আসলে নিজের ভাগ্যকেই বাজি রেখেছিলাম?

 

yubrajsingh4

 

আবার পরক্ষণেই ভাবে, যখন এক ওভারে স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছ'টা ছয় মেরেছিলাম, যখন একটার পর একটা ম্যাচে 'ম্যান অফ দ্য ম্যাচ' হয়েছিলাম, যখন পরপর উইকেট পেতাম, বড় রান পেতাম, তখন কি ঈশ্বরকে প্রশ্ন করেছিলাম, হোয়াই মি? আমার ওপরেই তোমার এত করুণা কেন? কেন আমাকেই বেছে নিলে এই সাফল্যের জন্য? তা হলে এখন দুরারোগ্য অসুখে পড়ে কেন ঈশ্বরের কৈফিয়ত চাইব?

১৮ মার্চ কেমোথেরাপি শেষ। দেশে ফেরা এবং বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে জাতীয় দলে ফেরার লড়াই শুরু। ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভারতের হয়ে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইয়ে একদিনের আন্তর্জাতিকে ফেরার শুরু। বস্তুত, ফেরার ম্যাচটা ছিল তার আগে, বিশাখাপত্তনমে। বৃষ্টিতে ম্যাচটা ধুয়ে যায়। 'প্রত্যাবর্তন' পিছিয়ে যায় আরও একটা ম্যাচ।

বিবাহবিচ্ছিন্ন বাবা–মায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাটানো সমস্যাসঙ্কুল ছেলেবেলা। বাবা যোগরাজ সিং ছেলেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার বানাতে চান। তাঁর নিজের যে স্বপ্ন সফল হয়নি (‌'দঙ্গল' মনে পড়ছে?)। চণ্ডীগড়ের মারুনে শীতের রাতে বিছানায় বালতি–ভর্তি জল ঢেলে ছেলেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দৌড়তে নিয়ে যাওয়া, রঞ্জি ম্যাচে বোকা শট খেলে আউট হয়ে ফেরার পর বাড়ি ফিরে ছেলের দিকে জলভর্তি কাচের গ্লাস ছুঁড়ে মারা— বাবা যোগরাজকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিলেন যুবরাজ। নেহাতই 'চাপে পড়ে' ক্রিকেটার হয়েছিলেন তিনি। অধুনা হেজেল কিচের স্বামী নিজের জীবনকে দু'ভাগে ভাগ করেন। প্রথমভাগে তাঁর অনিচ্ছুক ক্রিকেটার হওয়া। দ্বিতীয়, ক্যান্সারের সঙ্গে তাঁর লড়াই।

এতটা ঘাত–প্রতিঘাত, এতখানি চড়াই–উতরাই, খাদের ধারে গিয়েও ফিরে আসা, আইপিএলে ইচ্ছে করে ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ডোবানোর অভিযোগ, একদিকে চোট–আঘাতে টিম থেকে বাদ পড়া, তারপরে আবার রাজার মতো ফিরে আসা— এত রঙদার এবং নাগরদোলার মতো জীবন আর কার আছে?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...