শিবপুরাণ মতে দেবাদিদেবের আসল স্বরূপ কী, জানুন সেই আধ্যাত্মিক মহিমান্বিত কাহিনী!

শিব পুরাণে শিবকে সর্বেসর্বা ভগবান হিসেবে বলা হয়েছে। আসলে যত মত তত পথ হলেও যেকোনো একটি পথ ধরেই এগিয়ে যেতে হয় তবেই ভগবত প্রাপ্তি সম্ভব। তাই সনাতনধর্মের মধ্যে কেউ শৈব মতাবলম্বী হতে পারেন, কেউ আবার বৈষ্ণব ধর্ম অবলম্বী হতে পারেন, কেউ আবার গাণপত্য ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারেন কিন্তু যে যে ধর্মে বিশ্বাসীই হোক না কেন তাকে ধরে নিতে হবে সেই ধর্মের সেই ভগবানই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং চূড়ান্ত। শিব স্বরূপ সম্পর্কে শিব পুরাণে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আজকে আমি সেই কথায় বলব।

 ঋষিগণ সূতকে বললেন, “কে শিব, কে হরি, কে রুদ্র এবং যিনি জগৎকর্তা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বলে খ্যাত তিনিই বা কে? এদের মধ্যে নির্গুণ কে? আমাদের এই সংশয় ছেদন কর। যিনি নির্গুণ হয়েও গুণবান তিনি কে? তুমি আমাদের এই সংশয় ছেদন কর।"  সূত তখন বলতে শুরু করলেন তিনি যা বললেন তাই শিব পুরাণের ভারতীয় জীবনধারায় শিব চেতনার জ্ঞান সংহিতার ৩৬তম অধ্যায়ে ‘ঋষিদের নিকট সূত কর্তৃক শিবস্বরূপ বর্ণনা'তে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। 

সূত বলতে থাকেন, “সমস্ত জগৎ,  যে নির্গুণ পরমাত্মা হতে সৃষ্টি হয়েছেন তাঁরই নাম শিব। পুরুষের (বিষ্ণুর সঙ্গে প্রকৃতি অর্থাৎ মায়া) সেই শিব থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতি এবং পুরুষ উভয়ে মিলিত হয়ে, ত্রিশূলস্থিত পঞ্চক্রোশী কাশী নামে বিখ্যাত স্থানে তপস্যা করেছিলেন। ঐ স্থান বিষ্ণুরূপী পুরুষের আনন্দে জলে পরিপূর্ণ হলে, ক্রমে সকল স্থানই জলপূর্ণ হল। তখন স্বয়ং হরি সেই জলে শয়ন করলেন বলে মুনিগণ তাকে 'নারায়ণ' বলে অভিহিত করলেন এবং প্রকৃতিকে 'নারায়ণী' এই নামে প্রসিদ্ধ করলেন। জলশায়ী নারায়ণের নাভিকমল থেকে যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন তিনিই ব্রহ্মা। সেই সনাতন বিষ্ণুকে ব্রহ্মা তপস্যার বলে দর্শন করে। পরে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর বিবাদ ভঞ্জনের জন্য শিব যে রূপ প্রদর্শন করে, তাঁর নাম মহাদেব।”

শিব পুরাণে এরপর সূত বলতে থাকেন, শিবের মহিমা। শিব‌ই আদি, শিবই অন্ত। তিনিই বিষ্ণু,ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের যা সকল কার্য তা তিনি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন- “যিনি বিষ্ণু প্রভৃতি সকলকে সৃজন করেছেন, তিনিই বিষ্ণুকে নিঃশ্বাসবায়ুর দ্বারা বেদ নামক বাক্য,  মন্ত্র ও ধ্যান দান করেছেন।  এই শিবই বিষ্ণু প্রভৃতি সকলকে সৃজন করেছেন, তিনিই পালন করছেন, তিনিই পুণ্যপাপের সংহারকর্তা। শিবই স্বয়ং সাক্ষাৎ মহাকালস্বরূপ। মহাকালী তাঁকে আশ্রয় করে আছেন, পণ্ডিতেরা বলেছেন, যেরূপ ব্রহ্মরূপী শিব থেকে উৎপন্ন হয়েছেন, মহাকালীও সেইরূপ শিব থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। এই শিবই সমস্ত জগৎ, মহাকাল এবং মহাকালী দ্বারা ব্যাপ্ত রয়েছেন, তাঁদের ইচ্ছাতেই জগতের উৎপত্তি ও বিনাশ হয়ে থাকে। তিনি আপনিই আপনার কারণ, তাছাড়া অন্য কিছু কারণ নাই। তিনি সৃষ্টিকালে অনেকত্ব প্রাপ্ত হন।  তাঁদের ইচ্ছাতেই সকলকিছুর সৃজন ও পালনকার্য হয়ে থাকে এবং শিবরূপী মহাকালই প্রলয়কালে সবকিছু সংহার করেন।"- অর্থাৎ দেবাদিদেব মহাদেবের ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয় এবং অন্তকালে প্রলয় হয়, কিন্তু যার ইচ্ছা আদি-অন্ত হয় তিনি নিজের সবকিছু সৃষ্টি করেও কিন্তু সমস্ত কিছুর থেকে দূরে থাকেন! তিনি সংসার সৃষ্টি করেন কিন্তু তিনি এই সংসারের থেকে বহু দূরে অবস্থান করেন। 

সূত দেবাদিদেব মহাদেবের তত্ত্ব বোঝাতে প্রকৃতির বীজ থেকে গাছ হ‌ওয়ার তত্ত্ব বুঝিয়েছেন।

লেন,"‌বীজ থেকে গাছ উৎপন্ন হয়ে বহু ফল দান করে, আবার বহু ফল বীজ দান করে। তেমনি তিনি প্রলয়কালে এক হয়ে সংহার করেন। এই জগতের সবকিছু সৃষ্টিকরেও তিনি জগৎ থেকে দূরে থাকেন। সবই শিব।”

কিন্তু মানুষ একটার পর একটা পাপকার্য, অন্যায় কার্য করে যায় সে বুঝতেই পারেনা যে সে স্বয়ং পরমাত্মা ব্রহ্মের অংশ। এক্ষেত্রে সূত মানুষের মধ্যে থাকা অজ্ঞানতাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষ অবিদ্যা ও অজ্ঞানবশতই সব কিছুর মধ্যে ভেদ দেখে। প্রকৃত জ্ঞান থেকেই সব কিছুর মধ্যে একত্ব দর্শন হয়। সকল জীবই পরমাত্মা ব্রহ্মের অংশ। অজ্ঞান বা ভেদবুদ্ধিবশতই মানুষ বিভিন্ন জীবের মধ্যে ভেদ এবং জীবকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক বলে মনে করে। জীব মায়াবশে নিজেকে পৃথক জ্ঞান করে। জীব যখন মায়া থেকে মুক্ত হয়ে পরমাত্মা বা ব্রহ্মের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন দেখে তখনই সে শিবস্বরূপ হয়। সর্বব্যাপী চেতন অচেতন সকল বস্তুর মধ্যে অবস্থান করছেন। সর্বব্যাপী ভগবান শিবই নানারূপে ও স্বরূপে অবস্থান করেন।”

কিন্তু মানুষ কখন বুঝতে পারে যে সে স্বয়ং শিবস্বরূপ? কখন তার মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয়? এই ব্যাখ্যাও করেছেন সূত, তিনি শিব পুরাণে বলেছেন, “জীব যখন ‘আমি কর্তা’- এই অহংভাব বর্জিত প্রকৃত হয়, তখনই জ্ঞানের উদয় হয়। তখন তার মধ্যে কোন ভেদজ্ঞান থাকে না। তখন সে এ জগতের সবকিছুর মধ্যে শিবকে প্রত্যক্ষ করে। সে বুঝতে পারে চন্দ্র বা সূর্যের আলো পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপ্ত করে থাকলেও কোন কিছুর সঙ্গে স্পর্শদোষ তাদের হয় না। সর্বব্যাপী শিব তেমনি সর্বভূতে ব্যাপ্ত হয়ে থাকলেও কোন বস্তুর সঙ্গে লিপ্ত হন না।’’ - 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শিবপুরাণের এই শিব তত্ত্ব এবং গীতায় উল্লেখিত ভগবত তত্ত্বের মূল কথা কিন্তু একই। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, অর্জুন যখন মানুষ প্রকৃত জ্ঞান প্রাপ্ত হয় তখন সে বুঝতে পারে পরমাত্মা তার থেকে পৃথক নয়, সে স্বয়ং পরমাত্মা। নিজেকে পরমাত্মা হিসেবে জানতে পারাই বাস্তবিক জ্ঞান অর্জন।” আবার গীতায় ভগবান এও বলেছেন যে, “আমি সব, আমি এই সংসারের সমস্ত কিছু, আবার আমি কিছুই ন‌ই। আমি আদি, আমি অন্ত, আমি মায়া কিন্তু আমি মায়াতে জর্জরিত হ‌ই না কখনও।" গীতাতে ভগবান তাকে লাভ করার উপায় হিসেবে বলেছিলেন, “মানুষ যখন নিজের অহম সত্তাকে বর্জন করে চিনতে পারে যে, সে আসলে পরমাত্মার অংশ তখনই তার প্রকৃত জ্ঞান লাভ হয়।”- অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে একজন ভক্ত যে পথেই যাক ভগবানকে লাভ করার পথ সেই একই! নিজের অহম সত্তা আমিত্বকে বর্জন করতে হবে, তবে একমাত্র ভগবান প্রাপ্তি সম্ভব। শৈব মত ও বৈষ্ণব মত দুই-ই এক।

বিভিন্ন বিষয়ে মনোগ্রাহী ফিচার আর্টিকেলের জন্য আপনার ঠিকানা www.jiyobangla.com

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...