কলকাতা মানেই হলুদ ট্যাক্সি

শহর কলকাতা
সব শহরের সেরা কলকাতা
এই শহরের কত রঙ, কত রূপ…
তবু তারই মধ্যে একটা রঙ কলকাতার খুব প্রিয়। সেই রঙ একেবারে মিলেমিশে গিয়েছে এই শহরের হৃদয়ের সঙ্গে… সে রঙ ভালবাসার রঙ। সে রঙ ভরসার রঙ। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণের হৃদয়টিও রাঙানো এই রঙের ছোঁয়ায়।
সেই রঙেই রেঙেছে এই শহরের প্রতিটি অলি-গলি-মহল্লা…

যাকে লোকে আদর করে ডাকে ‘হলুদ’ বলে। আমরা সবাই জানি, মানতেও দ্বিধা নেই শহর কলকাতার অঙ্গ হলুদ ট্যাক্সি। ইয়েলো ট্যাক্সি। তিলোত্তমার রাজপথ আলো করে থাকে যে যান। এই শহরের খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার সবখানেই তার অবাধ সাম্রাজ্য। কলকাতা মানে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতা মানে রসগোল্লা।

 

কলকাতা মানে হলুদ ট্যাক্সি। শত শত বছরেও এতটুকু পুরনো হয়নি সেই প্রেম। আজও অটুট। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখতে পাব মহানগরীর বুকে প্রথম ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছিল ১৯০৭-এ।

 

মানে দেশ স্বাধীন হওয়ার বহু আগেই। আইকনিক অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সি কলকাতার রাস্তার অংশ হয়ে ওঠে ১৯৫৮-তে।
রুজি রুটির সন্ধানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কলকাতায় আসত মানুষ। তারা যুক্ত হয়ে পড়ে ট্যাক্সি সংস্কৃতির সঙ্গে।
বিশেষ করে পঞ্জাব, বিহার থেকে আগত মানুষরা। তাঁরা ট্যাক্সি ড্রাইভিংকে পেশা করে নিলেন। জীবন চলতে লাগল ট্যাক্সির স্টিয়ারিং-এ।

taxi1

শহরে ক্রমশ বাড়তে লাগল ট্যাক্সির সংখ্যা। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর। ট্যাক্সির জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত।
বলা হয়, সত্তর-আশির দশকে এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব ট্যাক্সি ছিল। এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট বলে, ষাটের দশকের শুরুতে কলকাতায় শিখ সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ ছিলেন ট্যাক্সিজীবী। সেই কারণেই ভবানীপুর হয়ে ওঠে শিখপ্রধান অঞ্চল। কলকাতা ভালোবেসে তাঁদের ‘সর্দারজী’ বলে ডাকত। আজও অমলিন সেই ডাক।

 

১৯৫৮-তে মুক্তি পায় হিন্দি ছবি ‘ হাওড়া ব্রিজ’। প্ৰধান ভূমিকায় অশোককুমার আর মধুবালা। এই ছবিতে কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি দেখানো হয়। গোটা দেশের আগ্রহের কেন্দ্রতে চলে আসে প্রিয় হলুদ যানটি।

 

১৯৬৯-এ রিলিজ হয় জিতেন্দ্র, সঞ্জীবকুমার, নন্দা অভিনীত ছবি ‘ ধরতি কহে পুকার কে’। সেই ছবিতেও হলুদ ট্যাক্সির জয় জয়কার। ১৯৮১-তে অপর্ণা সেন করলেন ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’। এই ছবিতে একটি বিখ্যাত দৃশ্য ছিল। ট্যাক্সির ব্যাক সিটে রোমান্টিক সিন। দীর্ঘদিন সিনেমাপ্রেমীদের চর্চার বিষয় ছিল হলুদ ট্যাক্সির রোমান্স।

taxi2

১৯৯২ তে ইংরেজি ছবি ‘সিটি অফ জয়’। কলকাতার ট্যাক্সি জীবন নিয়ে ছবি। মুগ্ধ হয়েছিল গোটা বিশ্ব। সে ছবি অলটাইম ক্ল্যাসিক। দুনিয়ার ছবিঘরে চলতেই লাগল হলুদ ট্যাক্সির অভিযান…
২০০৩- এ ‘ ক্যালকাটা মেল…’
২০০৫-এ পরিণীতা…
২০১২- তে এল কাহানি… বেড়েই চলেছে সেই লিস্ট…

 

কলকাতার খুব আদরের হলুদ ট্যাক্সি শুধু আর দরকারের যান নয়, হয়ে উঠেছে শহরের সিগনেচার! সংস্কৃতির অঙ্গ।
গোটা দুনিয়ার কাছে কলকাতার পরিচয় ‘ ভালবাসার শহর’ ‘সম্পর্কের শহর’ ।

 

সময় বদলেছে। শহরও খানিক বদলেছে। কিন্তু সেই বদলের প্রভাব পড়েনি মনে। এই শহর আজও বহমান ঐতিহ্যের পরম্পরায়। তারই উদাহরণ হলুদ ট্যাক্সি। ১.৫ লিটার ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। ৪.৩ মিটার লম্বা। ১.৬ মিটার চড়া। ওজন প্রায় ১ টন।
হলুদ রঙের অ্যাম্বাসাডর কারকেই ইয়েলো ট্যাক্সি নামে আমরা চিনি।

taxi3

অ্যাম্বাসাডর কারের নির্মাতা হিন্দুস্তান মোটরস। ১৯৫৭ থেকে একটানা ৬০ বছর চলার পর সংস্থা এম্বাসাডরের সব মডেলের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। সালটা ২০১৪-র ২৪ মার্চ।

 

কলকাতার রাস্তায় অবশ্য তার কোনও প্রভাব পড়েনি। হলুদ ট্যাক্সি আজও দাপিয়ে বেড়ায় শহরের সড়ক। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে কলকাতার রাস্তায় প্রায় ২১ হাজার ৮৩০ হলুদ ট্যাক্সি নিয়মিত চলে। নিন্দুকরা যতই বলুক ‘বোরিং’, দেখতেও ততটা ঝাঁ চকচকে নয়, কিন্তু টেকসই-এর প্রশ্নে বাকিদের বলে বলে গোল দেবে হলুদ ট্যাক্সি।

 

২০১৩-তে বিবিসি অটোমোবাইল শো টপ গিয়ারে কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি দুনিয়া সেরার সম্মান পায়। এখন হলুদ ট্যাক্সির ড্রাইভারসিটে ‘সর্দারজী’দের সেইভাবে দেখা যায় না। তাঁরা বেশিরভাগ বিকল্প পেশা বেছে নিয়েছেন। কলকাতার ট্যাক্সি পরিবহনের ক্ষেত্রেও এসেছে আরও নানা নতুন মাধ্যম।

 

তবু আজও হলুদ ট্যাক্সি কলকাতার প্রাণ। হারিয়ে যাওয়া সময়ের গন্ধ গায়ে মেখে ছুটে বেড়ায় শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...