পীত সাংবাদিকতা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত আর ১০টি পণ্যের মতোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য-সংবাদ। যা শুধু মানুষের মনোরঞ্জন নয়, প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দৈনিক ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে। কিন্তু সংবাদকে জনপ্রিয় পণ্যে পরিণত করার সাথে সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন, রোমাঞ্চকর হলুদ বা পীত সাংবাদিকতা। সংবাদ পরিবেশই হলো হলুদ সাংবাদিকতা। সংবাদের এই নতুন রূপের ধারক ছিলেন দুই মহারথী - জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম রোলফ হার্স্ট। তাঁদের পত্রিকার চাহিদা বৃদ্ধির জন্য অর্ধসত্য, অসত্য( গুজব), ভিত্তিহীন খবর ছাপানোর নেশা এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরী করে।

        সংবাদপত্র কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯ শতকের আমেরিকাতে শুরু হওয়া সংবাদপত্রের বিপ্লবের নেপথ্যে ছিল এই দুই নেতার দৈরথ। হাঙ্গেরি থেকে অভিবাসী হয়ে আশা পুলিৎজারের শৈশব কেটেছে অর্থাভাবে। কিশোর বয়েসে রাস্তায় ঘুরে সংবাদপত্র বিক্রি ও মানুষের দুর্দশা দেখে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল নিজের পত্রিকা প্রকাশ করার। সেখানে তিনি দরিদ্র মানুষের দারিদ্রতার সংগ্রাম লিখবেন- এই ছিল তার সংকল্প। স্বপ্ন পূরণের প্রথম পদক্ষেপ  হিসেবে  ‘সেন্ট লুইস পত্রিকায়’  তিনি প্রথম সাংবাদিকতার সুযোগ পান। সঠিক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সমাজের বিত্তশালী ও রাজনৈতিক দুর্নীতি প্রকাশ করে তিনি স্বল্পদিনেই জনপ্রিয় হন। এর পর “সেন্ট লুই পোস্ট ডেসপ্যাচ ” পত্রিকার মালিক হন তিনি।

১৮৮৩ সালে তিনি সংবাদপত্রের পীঠস্থান নিউইয়র্ক নগরীতে যান। সেখানে ' New York world' নামে পত্রিকা কিনে নেন। সে সময় এখানে অনেক অভিবাসী এসে বেকারত্ব, দারিদ্রতায় জীবন কাটাচ্ছিলেন। তিনি এই অবস্থা থেকে উঠে আসায় চেয়েছিলেন এদের কথা প্রচার করতে। সে সময় সংবাদপত্রের কিছু বিষয়গত ও দৃশ্যমানতার সমস্যা ছিল। আলোচনার কেন্দ্র ছিল বিত্তশালী ও উচ্চবিত্ত মানুষ। বেশিরভাগ পত্রিকা ছিল রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত। আর সংবাদপত্রের কোনো শিরোনাম না থাকায় তা একপ্রকার ছিল বিরক্তিকরও বটে । 

        পুলিৎজার তাঁর পত্রিকায় প্রথম শিরোনাম, নতুন হরফ চালু করেন, old typography র পরিবর্তন করে। ৩ মাসের মধ্যেই তাঁর পত্রিকার গ্রাহক ৩ গুণ বেড়ে যায়। দেড় বছরের মাথায় ১ লক্ষ গ্রাহক তার পত্রিকা পড়তে শুরু করে। তাঁর সাহসী পদক্ষেপ তাঁকে প্রভাবশালী মানুষে পরিণত করে। ইতিমধ্যেই নিউ ইয়র্ক থেকে ২০০ মাইল দূরে ম্যাসাচুসেটস-এ বসে পুলিৎজারের উত্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন উইলিউম হার্স্ট। তিনি পারিবারিক কারণে একাধারে ছিলেন বিত্তশালী ও উচ্চাভিলাষী। ১৮৮৭ এ তাঁর পিতার মালিকানাধীন পত্রিকা 'সানফ্রান্সিসকো এক্সামিনার' এর দ্বায়িত্ব নেন।

নিম্নমানের খবরের জন্য পত্রিকার অবস্থা ছিল খারাপ। পুলিৎজারের কৌশলে অনুপ্রাণিত হয়ে হার্স্ট পত্রিকার নতুন রূপ দেন। তাঁর পত্রিকাতে অভিনব কৌশল হিসেবে মিথ্যা, ভুয়ো তথ্য,মুখরোচক খবর ছাপাতে থাকেন - যা বর্তমানে ' পীত সাংবাদিকতা' নামে পরিচিত। তার জনক হার্স্ট। স্বল্প দিনেই এই পত্রিকা চরম পাঠক পায়। এরপর তিনিও আসেন নিউ ইয়র্ক এ -পুলিৎজারের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায়। 

                           ২ জনের মধ্যেই মৌলিক পার্থক্য ছিল - পুলিৎজার একটি বিশেষ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য আগ্রহী  ছিলেন। চেয়েছিলেন সমাজের নিচু তলার মানুষকে তাদের অবস্থান ও অধিকার নিয়ে সচেতন করতে। অন্যদিকে হার্স্ট প্রভাবশালী ও ক্ষমতালোভী ছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আত্মউন্নয়ন ও সমাজে বিত্তশালীর তালিকাভুক্ত হওয়া। তিনি নিউ ইয়র্কে মর্নিং জার্নাল’ নামক সস্তা পত্রিকা কিনে নেন। এই সময় পুলিৎজার দেশের বাইরে থাকায় সুযোগসন্ধানী হার্স্ট মোটা টাকার বিনিময়ে পুলিৎজারের দক্ষ কর্মীদের কিনে নেন। তার পত্রিকার নাম হয় ' নিউ ইয়র্ক জার্নাল' হার্স্টের পত্রিকা প্রথম পাতা ছিল অপরাধজগৎ, স্ক্যান্ডালপূর্ণ খবরে ভরা। ফলে ২ গুণ পাঠক বেড়ে যায়। প্রতিযোগিতায় এগোতে ও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য তার পত্রিকার দাম তিনি কমিয়ে আনেন। পুলিৎজারের ৮ পাতার পত্রিকার দাম ছিল ২ সেন্ট, তার ১৬ পাতার পত্রিকা পাওয়া যেত ১ সেন্টে। ফলে পুলিৎজারের পত্রিকা গ্রাহক হারায়। তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত আহত হন।

                হার্স্টের নিত্যনতুন কৌশলে ক্রমাগত ধরাশায়ী হন পুলিৎজার। সাংবাদিকরা সেসময় সেলেব্রিটির মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন। পুলিৎজারের পত্রিকার জনপ্রিয় ও বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন অর্থর ব্রিসবেন। এছাড়াও সে সময় রিচার্ড ফন্ট নাম একজন কার্টুনিস্ট পুলিৎজারের পত্রিকাতে 'ইয়েলো কিড ' নামে  প্রতিদিন ১টা করে কার্টুন আঁকতেন। এর মাধ্যমে তিনি সমাজের অনেক কথা বলতেন - যা পক্ষপাতদুষ্ট। হার্স্ট অধিক বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে এই ২ জনকে কিনে নেন। পুলিৎজার বাধ্য হয়ে জর্জ লুকাস নামে ১জন কার্টুনিস্টকে নিয়োগ করেন। এরপর ২জনের পত্রিকাতেই ইয়েলো কিডস আঁকা শুরু হয়। শুরু হলো পত্রিকার দ্বন্দ্ব- চাহিদা ও বাজারকে কেন্দ্র করে। এই ইয়েলো সাংবাদিকতা কিছু ভ্রান্ত মানসিকতা সম্পন্ন পাঠকের সৃষ্টি করে যারা এই ধরেনর চটুল খবরে তৃপ্তি পেত।

                              ১৮৯৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী কিউবার হাভানায় নোঙর ফেলা মার্কিন জাহাজের  আকস্মিক বিস্ফোরণে ২৫০ জন নাবিক মারা যান। হার্স্ট তার পত্রিকায় এই ঘটনাকে 'স্পেনের ষড়যন্ত্র' বলে ভুয়ো তথ্য দেন -ফলে ১৮৯৮ এর ২৫শে এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেস স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন বাজারের চাহিদায় পুলিৎজারও ভুয়ো খবর প্রকাশ করতে থাকে। স্পেন -মার্কিন দ্বন্দ্ব তাদের দুই পত্রিকাকেই লাভজনক জায়গাতে নিয়ে যায়। সমস্যা বাধে অন্যত্র। এই সব কাগজ পৌঁছে দিতো পথশিশুরা যারা 'নিউজি' নামেই পরিচিত ছিল।যুদ্ধের পর এই দুই পত্রিকা তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে নিউজিরা এর প্রতিবাদ স্বরূপ এই পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করে ধর্মঘট করে। পরে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে তারাও ১৮৯৯ এর ২রা মে ধর্মঘট তুলে নেয়।

            ইতিমধ্যেই পরিস্থিতিও পাল্টে যায়। পুলিৎজার সাংঘাতিক অনুশোচনা করেন কারণ প্রথম জীবনে তিনি নিজেও নিউজি ছিলেন। প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২মিলিয়ন ডলার দান করেনএখানে সর্ব প্রথম জার্নালিজম পড়ানো শুরু হয়। পরে এদের বিশেষ প্রশিক্ষনের জন্য 'কলম্বিয়া স্কুল অফ জার্নালিজম' তৈরী হয়। ১৯১১ সালের ২৯ শে অক্টোবর পুলিৎজারের মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে পুরস্কার প্রদান করা হয়। হার্স্ট রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। একসময় হলিউডেও  প্রতিষ্ঠিত হন। তবে তাদের পরিণতি যাই হোক না কেন বর্তমান সংবাদ ম্যাধ্যম এই দুই দ্বৈরথের সৃষ্ট রূপ, প্রযুক্তির মাধ্যমে তার অনেক পরিবর্তন হলেও আজ ইয়েলো সাংবাদিকতার ও তার প্রভাব বিদ্যমান।

 

  

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...