এই মাসের শুরুতে মুম্বইয়ে নতুন রেস্তরাঁ খুলছেন বিরাট। কিশোর কুমারের ভক্ত তিনি। মুম্বইয়ে 'গৌর কুঞ্জ' নামে একটি বাড়ি ছিল কিশোরের। সেই বাড়িটি কিনেই রেস্তরাঁ বানিয়েছেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। রেস্তোরাঁ শুরুর দিন গল্পের ছলে তাঁর এক বাঙালি সতীর্থর অদ্ভুত খাওয়া দেখে অবাক হওয়ার কথা তোলেন বিরাট। তিনি বলেন, "ঋদ্ধির খাওয়া ছিল অদ্ভুত। রুটি, মুরগির মাংস খেতে খেতে রসগোল্লা খেয়ে নিত। দু'চামচ ভাত, ডাল খেয়ে এক চামচ আইসক্রিম খেয়ে নিল। একটা শেষ করে অন্যটা খাওয়ার ব্যাপার নেই ওর। সব একসঙ্গে খেত। আমি ওকে বলেছিলাম, "ভাই কী করছিস?" ঋদ্ধি বলেছিল, এ ভাবেই খায় ও।"
ঋদ্ধিমান সাহা ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় থেকেও না থাকা এক নাম। টেস্ট ক্রিকেটে এক সময় বিরাট কোহলি, রবি শাস্ত্রীদের প্রথম পছন্দ ছিলেন বাংলার ঋদ্ধিমান সাহা। ২০২১ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম উইকেট রক্ষকের ব্যাটন ঋদ্ধির হাত থেকে যায় ঋষভের হাতে। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ফিল্ডিং কোচ আর শ্রীধরের কথায়, ''ঋদ্ধিমান তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা উইকেট রক্ষক। ওকে বাদ দিয়ে টেস্ট খেলতে নামা সহজ ছিল না। তবু আমাদের ভাবতে হয়েছিল, তুলনায় ভাল ব্যাটারকে প্রথম একাদশে রাখা হবে, না ভাল উইকেট রক্ষককে।''
এবছরের শুরুতে আচমকাই কালো মেঘ ঋদ্ধিমান সাহার ক্রিকেট আকাশে। ফেব্রুয়ারীর শ্রীলঙ্কা সিরিজে টেস্ট দল থেকে ঋদ্ধিমান সাহার বাদ পড়ার প্রসঙ্গ নিয়ে সরগরম হয় ভারতীয় ক্রিকেট মহল। ঋদ্ধিকে 'টিম ম্যানেজমেন্ট' বার্তা দিয়ে দেয়, শুধুমাত্র বয়সের জন্যই টেস্ট দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হল। দেশের মাঠে শেষ সিরিজ়েও নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘাড়ে-কাঁধে চোট নিয়ে দুর্দান্ত লড়াই করা, ব্যাট এবং গ্লাভস হাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা ঋদ্ধির উপরে কোপ পড়ে।
কোচ রাহুল দ্রাবিড়দের দল পরিচালন সমিতি তুলে ধরতে চাইছে দক্ষিণাঞ্চলের কিপার কে এস ভরতকে। তাঁকেই দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে ভাবছে দল। এমনকি, অবিশ্বাস্য হলেও স্বয়ং ঋদ্ধিকেও নাকি দল পরিচালন সমিতি এই বার্তা দিয়েছিলো যে, তোমার কথা আর ভবিষ্যতের রাস্তায় ভাবা যাচ্ছে না। যা নজিরবিহীন বললেও কম বলা হয়। দল পরিচালন সমিতির এ ভাবে কোনও ক্রিকেটারকে বলার এক্তিয়ার আছে কি না, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তা হলে চেতন শর্মাদের নির্বাচক কমিটির কাজ কী?
সাধারণত, জাতীয় নির্বাচকদের কাজ ১৫ বা ১৬ জনের দল নির্বাচন করা। তাঁরা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও ঋদ্ধিমানকে রেখেছিলেন। সেখানে ঋদ্ধিকে একটি ম্যাচও খেলানো হয়নি। তা হলে কীসের ভিত্তিতে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে? দেশের মাঠে নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ যে সিরিজ়ে ঋদ্ধি খেলেছিলেন, তাতে ৬১ নট আউটের অদম্য ইনিংস পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ব্যাট থেকে। ঘাড়ের যন্ত্রণা নিয়েও কানপুরে দাঁতে দাঁত চেপে ৬১ অপরাজিত। তাঁর সেই অদম্য ইনিংস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়। অপরাজিত ৬১ রানের ইনিংস খেলার পরে রাহুল দ্রাবিড় বিশেষ কিছু বলেছেন? সংবাদ মাধ্যমের এই প্রশ্নের উত্তরে ঋদ্ধি বলেছিলেন, " হ্যাঁ। রাহুল ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে দলের জন্য দু'টি জুটি গড়তে পেরেছি বলে পিঠ চাপড়ে দেন। তবে খুব লজ্জা লেগেছিল, উনি দলের জন্য অবদান রেখেছি বলে ধন্যবাদ দেওয়ায়। ওঁর মাপের ক্রিকেটারের থেকে এ রকম মন্তব্য শুনতে পাওয়াটা সত্যিই বিরাট প্রাপ্তি।"
কানপুরে সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে মায়াঙ্ক আগরওয়াল থেকে শুরু করে চেতেশ্বর পুজারা, অজিঙ্ক রাহানে সকলে ব্যর্থ হয়েছিলেন। রান পেয়েছিলেন একমাত্র ঋদ্ধি, শ্রেয়স আয়ার এবং কিছুটা অশ্বিন ও অক্ষর পটেল। ঋদ্ধির ইনিংস প্রায় জিতিয়ে দিয়েছিল ভারতকে। এ ছাড়াও কে না জানে, তাঁর চেয়ে ভাল কিপার এখনও কেউ নেই। এমনকি, তাঁকে বিশ্বের সেরা উইকেটকিপারও আখ্যাও দিয়েছেন অনেকে। আর এরপরই ঋদ্ধি বিস্ফোরণ ঘটান। তাঁকে বোর্ড তৎকালীন সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি বোর্ড সভাপতি পদে থাকাকালীন ঋদ্ধিকে কখনই দল থেকে বাদ পড়তে হবে না!
সবকিছুর পরও ঋদ্ধিমান সাহার পৃথিবী আসলে অপেক্ষার পৃথিবী। মার্সিডিজ় বা বিএমডব্লিউ চড়ে হাইস্পিডে একের পর এক মাইলফলক পেরিয়ে যাওয়া নয়, তাঁর যাত্রা মানে সিগন্যালে ঠোকর খেতে খেতে এগোনো। কখন সিগন্যাল সবুজ হবে আর তাঁর গাড়িও চালু হবে। কবে অস্ট্রেলিয়ায় ড্রেসিংরুমে এসে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি টেস্ট অবসর ঘোষণা করবেন আর তিনিও ওয়েটিং লিস্ট থেকে 'আরএসি' টিকিট হাতে পাবেন।
কখন রোহিত শর্মা পা হড়কে চোট পাবেন আর কোনও রকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই টেস্ট অভিষেক ঘটাতে নেমে পড়তে হবে। নাগপুরে সেই টেস্টে এক দিন আগেই তাঁকে বলে দেওয়া হয়, খেলছেন না। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি থাকতে কে আর তাঁকে বলবে, তুমি খেলছ! রোহিত চোট পাওয়ায় টসের ঠিক কয়েক মিনিট আগে তাঁর নাম টিমলিস্টে ঢোকাতে হয়, ঋদ্ধি খেলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে, কিপিং দস্তানা সেই ধোনির হাতে এবং ব্যাট হাতে ক্রিজ়ে গিয়েই দেখেন সামনে ডেল স্টেন।
সে দিনই জীবনের অমূল্য শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন ঋদ্ধি। সুযোগ কবে আসবে, তার জন্য কিছু ফেলে রেখো না। নিজেকে তৈরি রাখো অগ্নিপরীক্ষার জন্য। নাগপুর-উত্তর যখনই ভারতীয় দলে জায়গা পেয়েছেন, সব সময় নিজেকে বলেছেন, এই টেস্টে তুমি খেলছ। তৈরি থাকো। তা সে টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁর জন্য যে বিধানই তৈরি রাখুক। ২৭ বছরের তরতাজা তরুণ হিসেবে যখন দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে, কোনও কোচ সুযোগের ডালি নিয়ে উদয় হননি। পিঠে হাত রেখে বলেননি, তোমার দিন ঠিক আসবে। আজ যখন যৌবনের সেই হারানো সময়কে যতটা সম্ভব পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ছুটছেন তিনি, ভারতীয় কোচ দৌড় থামিয়ে দিলেন! কি না, তিনি ৩৭ হয়ে গিয়েছেন! ফিট আছেন তো কী, উড়ন্ত ক্যাচ নিচ্ছেন তো কী!
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামক কিংবদন্তির গ্রহণে ঢেকে থাকা এক ক্রিকেটজীবন। ধোনি চলে যাওয়ার পরে মাঝে বছর চারেক এক নম্বর কিপার থাকার পরে উদয় হলেন ঋষভ পন্থ। তিনি— ঋদ্ধিমান সাহা যে চিরকালীন দ্বিতীয় হওয়ার বিধান নিয়ে এসেছেন। এ বার সেই দ্বিতীয় জায়গাটাও কেড়ে নেওয়া হল। বলে দেওয়া হল, ঋষভই এখন এক নম্বর কিপার। কেন তিনি এক নম্বর? কেন ঋদ্ধি দ্বিতীয় হিসেবেও ব্রাত্য, কেউ ব্যাখ্যা দেবে না। নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ টেস্টেও ওষুধ খেয়ে, ইঞ্জেকশন নিয়ে, সারারাত না ঘুমিয়ে রান করে দলের রক্ষাকর্তা হওয়া তিনি দু'নম্বর কিপার হিসেবেও রাতারাতি অযোগ্য হয়ে গেলেন! চিরকালের নীরব যোদ্ধা তিনি।
ঋষভ ঋদ্ধির থেকে অনেক আক্রমণাত্বক ব্যাটার তা যেকেউ স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু এবছরের (২০২২) আইপিএল আবার অনেক কিছু ঘেঁটে দিলো। কুড়ি ওভারের ক্রিকেট মানেই রানের বন্যা। পাওয়ার প্লে-র সময় রান ওঠে আরও দ্রুত। যে সব ব্যাটাররা বড় শট নিতে পারেন সাধারণত তাঁরাই টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ইনিংস শুরু করার দায়িত্ব পান। যাঁরা এই দায়িত্ব পান, তাঁরা সকলেই কিন্তু দারুণ আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পারেন না। যাঁরা পারেন, তাঁদের মধ্যেই রয়েছেন বাংলার ঋদ্ধিমান সাহা।
আইপিএলের পরিসংখ্যান বলছে ইনিংস শুরু করতে নেমে ঋদ্ধিমানের আগ্রাসন অবাক করতে পারে অনেককেই। আপাত শান্ত স্বভাবের ব্যাটার ঋদ্ধিমান কম যান না ক্রিস গেল, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের থেকে। আইপিএলের প্রথম ছয় ওভারের মধ্যে অর্থাৎ পাওয়ার প্লে-তে যে ব্যাটাররা কমপক্ষে ৫০০ বল খেলেছেন, তাঁদের নিয়ে করা হয়েছে একটি সমীক্ষা। এমন ব্যাটারদের মধ্যে মাত্র ১০ জন ওভার প্রতি আট বা তার বেশি রান করতে পেরেছেন। তালিকার নবম স্থানে রয়েছে বাংলার উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের নাম। অষ্টম স্থানে গেল এবং দশম স্থানে গিলক্রিস্ট। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে ঋদ্ধিমান কতটা আক্রমণাত্মক ব্যাটার।
আইপিএলের পাওয়ার প্লে-তে ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে ঋদ্ধিমানের থেকেও দ্রুত গতিতে রান করেছেন পৃথ্বী শ, বীরেন্দ্র সহবাগ, রাহুল ত্রিপাঠি এবং সূর্যকুমার যাদব। ২০২০ আইপিএলের শেষ দিকে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের প্রথম একাদশে সুযোগ পান তিনি। কেন উইলিয়ামসনকে খেলানোর জন্য আক্রমণাত্মক উইকটরক্ষক-ব্যাটার জনি বেয়ারস্টোর জায়গায় ঋদ্ধিমানকে খেলানো হয়। দুরন্ত ছন্দে থাকা বেয়ারস্টোর বদলে ঋদ্ধিমানকে খেলানো নিয়ে দলের মধ্যে একাধিক মত ছিল। কিন্তু নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই ঋদ্ধিমান ৪৫ বলে ৮৭ রানের দুরন্ত ইনিংস খেলে দলের সংশয় দূর করেন।
এই ঋদ্ধিমানকে নিয়েই এ বার আইপিএল নিলামের প্রথম দিন কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি আগ্রহ দেখায়নি। দ্বিতীয় দিন তাঁকে নেয় দ্বিতীয় উইকেটরক্ষকের খোঁজে থাকা গুজরাত টাইটান্স। প্রতিযোগিতার প্রথম দিকে ম্যাথু ওয়েডই ছিলেন উইকেটের পিছনে হার্দিক পাণ্ড্যদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু তিনি কয়েকটি ম্যাচে রান না পাওয়ায় সুযোগ পান ঋদ্ধিমান। সেই সুযোগ দুর্দান্ত ভাবে কাজেও লাগিয়েছেন তিনি।
এ বারের প্রতিযোগিতায় পাওয়ার প্লে-তে ঋদ্ধিমানের স্ট্রাইক রেট ১৩৮.৫৬। আইপিএলে সব মিলিয়ে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৩৪.৬৭। তা হলে কেন কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে দলগুলির প্রথম পছন্দ হতে পারেন না দক্ষ উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমান! সমীক্ষা অনুযায়ী মাঝের ওভারগুলোয় এই আগ্রাসন দেখা যায় না ঋদ্ধিমানের ব্যাটিংয়ে। এ বারের আইপিএলে মাঝের ওভারগুলোয় তাঁর স্ট্রাইক রেট ১০১.১৩। আইপিএলে সব মিলিয়ে ১১৩.৯৩।
এক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে, পাওয়ার প্লে-তে ১৫৩টি বল খেলে ৬০টি আক্রমণাত্মক শট নিয়েছেন ঋদ্ধিমান। শতাংশের হিসেবে ৩৯। পাওয়ার প্লে-তে অন্তত ১০০ রান করেছেন এমন ব্যাটারদের মধ্যে আক্রমণাত্মক শট খেলার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন তিনি। প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে যশস্বী জায়সবাল (৫২শতাংশ) এবং রাহুল ত্রিপাঠি (৪২ শতাংশ)।
পাওয়ার প্লে-তে বেশি সফল কেন ঋদ্ধিমান। সে উত্তর নিজেই দিয়েছিলেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। ঋদ্ধিমান বলেছিলেন, ''পাওয়ার প্লে-তে ব্যাটিং আমার খেলার ধরনের সঙ্গে বেশি মেলে। সব সময়ই আমি প্রথম ছয় ওভারের ব্যাটিং উপভোগ করি। ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলতে ভাল লাগে। এটা দলকেও সাহায্য করে আর আমিও কিছু অবদান রাখতে পারি। প্রথম ছয় ওভারে একটা জুটি গড়ে কিছু রান করতে পারলে পরের ব্যাটারদেরও সুবিধা হয়। উইকেটে থিতু হওয়ার জন্য ২-৩টে বল বেশি খেলতে পারে ওরা। তাতে দলের বড় রান করার সম্ভাবনা বাড়ে।''
এবরের আইপিএল যেতে নতুন টিম গুজরাত টাইটান্স। আইপিএল ২০২২-এ নিজেকে ফের প্রমাণ করেন ঋদ্ধি। ট্রফি জেতার রেশ কাটার আগে সাহা বলেছিলেন, ''আলাদা ধরনের উন্মাদনা হয়েছে আমাদের নিয়ে। জেতার পরে সকলে প্রাণ খুলে আনন্দ করতে পেরেছি। ঘরের মাঠে দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মজাই আলাদা। এক লক্ষেরও বেশি দর্শকের সমর্থন পেয়ে দল এমনিতেই চাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের চিৎকারই বিপক্ষকে অনেকটা চাপে ফেলে দেয়। সহজ করে দেয় আমাদের কাজটা।''
হার্দিক পাণ্ডিয়ার নেতৃত্ব খুবই উপভোগ করেছিলেন ঋদ্ধি। তাঁর কথায়, ''কী ভাবে একটি দল পরিচালনা করতে হয়, তা খুব ভাল করে জানে হার্দিক। প্রত্যেকের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই একজন অধিনায়কের সব চেয়ে বড় গুণ। হার্দিকের মধ্যে তার কোনও অভাব নেই। আগে ওকে যেমন চঞ্চল দেখেছিলাম, এখন একেবারেই বদলে গিয়েছে। আমূল পরিবর্তন হয়েছে ওর মধ্যে। মাঠে কেউ ভুল করলে কখনও খারাপ কিছু বলত না। সব চেয়ে ভাল বিষয়, সবার উপরে ভরসা রেখেছে।'' যোগ করেন, ''বিভিন্ন দল যাদের ছেড়ে দিয়েছিল, যাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল, তাদের উপরে ভরসা রেখেছে ও। আমিই যেমন অবিক্রিত ছিলাম। শুরুর দিকে সুযোগ পাচ্ছিলাম না। যে দিন আমাকে এসে ও বলে ওপেনারের দায়িত্ব পালন করতে হবে, সে দিনই আমার মধ্যেও আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার মঞ্চ দিয়েছে ও। হার্দিকের এই অবদান ভোলার নয়। আমরা যদিও ওর আস্থার মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যার যতটুকু দায়িত্ব, সে সেটা পালন করেছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না।''
ঋদ্ধির মতে, সকলের উপরে পূর্ণ আস্থা ছিল বলেই গুজরাত অনেক কঠিন পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ বার করেছে। তাঁর কথায়, ''তেওটিয়া যেমন পঞ্জাবের বিরুদ্ধে মাত্র তিন বল খেলার সুযোগ পেয়েছিল। তাতেই ম্যাচ জিতিয়ে ফিরেছিল। রশিদও ব্যাট করে ম্যাচ জিতিয়েছে। ইডেনে যেমন মিলার ও হার্দিক আমাদের ফাইনালে তুলল। এ ধরনের ম্যাচগুলোই একটি দলের ভরসা তৈরি করে। মিলারের উপরে আস্থা রাখা হলে ও কী করতে পারে, আবারও প্রমাণ করে দিল।''
ঋদ্ধি নিজেও ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন না। তাঁর কাছে আইপিএল ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর মঞ্চ। ফের প্রমাণ করা যে বয়স শুধুমাত্র একটি সংখ্যা। তাঁর কথায়, ''বয়স নিয়ে আমি কখনওই চিন্তা করিনি। আগামী দিনেও করব না। কোথাও সুযোগ পাচ্ছি না, সেটা ভেবে বসে থাকলে খেলায় প্রভাব পড়তে বাধ্য। আমার যতটুকু প্রতিভা আছে, তার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছি। দল উপকৃত হয়েছে। এর চেয়ে ভাল কী হতে পারে!''
শুভমন গিল ও তাঁর ওপেনিং জুটির উপরে নির্ভর করে থাকত দল। ১১ ম্যাচে ৩১৭ রান করেছেন। সমালোচনার সব জবাব দিয়েছেন ব্যাটেই। ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছেন দু'টি। হার্দিক কী বললেন তাঁর এই মরসুমের পারফরম্যান্সের পরে? ঋদ্ধির উত্তর, ''ওপেনারেরা ভাল খেললে অধিনায়ক খুশি হবেই। ও যে আমার উপরে আস্থা রেখেছে, সেটাই আসল। হার্দিক বলেছে, একাধিক ম্যাচে আমরা শুরুটা ভাল না করলে ডাগ-আউটে চাপ বাড়তে পারত। ওপেনার হিসেবে আমার দায়িত্ব এটাই। যত দিন যাবে, আরও পরিণত হওয়ার চেষ্টা করব।''
রশিদ খানের সঙ্গে শেষ বারও খেলেছেন ঋদ্ধি। রশিদের বিরুদ্ধে কিপিং করার অভিজ্ঞতা ছিল না ম্যাথু ওয়েডের। ঋদ্ধির উপরে সেই দায়িত্বও এসে পড়ে। বলছিলেন, ''ওর কব্জির উপরে নজর না রাখলে, বোঝা যাবে না কোনটা লেগস্পিন আর কোনটা গুগলি। ওর বিরুদ্ধে কিপিং করা সত্যি কঠিন কাজ। আমি এত দিন ধরে ওর সঙ্গে খেলছি বলে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।''
আইপিএলের পরে বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরায় চলে গিয়েছেন ঋদ্ধিমান সাহা। সেই দলের এখন অধিনায়কও তিনিই। সেটাই এখন তাঁর নতুন সংসার। দলের মেন্টরও তিনি। পেতে পারেন নেতৃত্বের দায়িত্বও। ঋদ্ধি যে নতুন মরসুমে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য তৈরি আছেন তা জানিয়ে দিলেন নিজেই।
সমাজমাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট করেন ঋদ্ধি। সেখানে দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরা দলের সকলে রয়েছেন। মধ্যমণি ঋদ্ধিমান। রয়েছেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। যিনিও এ বার বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরা দলে যোগ দিয়েছেন। সেই ছবিতে ঋদ্ধি লেখেন, "নতুন মরসুম, নতুন চ্যালেঞ্জ।" এই মরসুমে ত্রিপুরার হয়ে খেলার জন্য তিনি যে তৈরি তা বুঝিয়ে দিতে চাইলেন ঋদ্ধি? এমনটাই মনে করছেন তাঁর সমর্থকরা।
চলতি সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে প্রথম ম্যাচে রান না পেলেও দ্বিতীয় ম্যাচে রান করলেন ঋদ্ধি। একার কাঁধে দলকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। যদিও জেতাতে পারলেন না।
সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে গ্রুপ বি-তে রয়েছে ত্রিপুরা। সেই গ্রুপে শুক্রবার তারা মুখোমুখি হয়েছিল পঞ্জাবের। প্রথমে ব্যাট করে ১১৮ রান তোলে ত্রিপুরা। এর মধ্যে ৬২ রান করেন ঋদ্ধি। ৫৫ বলে ৬২ রান করেন তিনি। ছ'টি চার এবং একটি ছক্কা মারেন বাঙালি উইকেটরক্ষক। ঋদ্ধি রান পেলেও সুদীপ চট্টোপাধ্যায় শূন্য করেন। আগের ম্যাচে রান পেয়েছিলেন সুদীপ। তিনিও এই মরসুমে বাংলা ছেড়ে ত্রিপুরা চলে গিয়েছেন। ত্রিপুরার হয়ে ২৫ রান করেন দীপক খতরি এবং ২০ রান করেন শুভম ঘোষ। বাকি ব্যাটারদের কেউ দু'অঙ্কের রান করতে পারেননি।
বাংলার এক কর্তার সঙ্গে মনোমালিন্য হয় ঋদ্ধির। সেই অভিমানে দল ছাড়েন তিনি। ভারতীয় দলেও যে তাঁর আর জায়গা হবে না সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এমন অবস্থায় ক্রিকেট খেলতে ভালবাসেন বলেই খেলে যেতে চান ঋদ্ধি। আইপিএলে গুজরাত টাইটান্সের হয়ে দারুণ ছন্দে ছিলেন তিনি। সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে ত্রিপুরার হয়ে সেই ছন্দ ধরে রাখতে চাইবেন বাংলার 'প্রাক্তন' উইকেটরক্ষক।
একটি সাক্ষাৎকারে ঋদ্ধির ছোটবেলার কোচ জয়ন্ত মজুমদার জানাচ্ছেন, "কোনও ক্রিকেটারকে দলে নেওয়ার জন্য তাঁর 'ফিটনেস' ও 'ফর্ম'ই প্রধান বিষয় হওয়া উচিত। সেখানে বয়স কোনও বাধা হতে পারে না। আর তাছাড়া আরও অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার আছেন, যাঁদের বয়স ৩০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তাহলে শুধু ঋদ্ধিকে বাদ পড়তে হল কেন! এক-একজন ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা রকমের নিয়ম নাকি! ঋদ্ধি অবিচারের শিকার হয়েছেন। বাকি পেশাদার ক্রিকেটারদের মতোই ঋদ্ধিমান সাহাও জানেন কখন তাঁকে থামতে হবে। কখন অবসর নিতে হবে। ওঁর একটা সম্মান আছে। অযথা জায়গা আটকে রেখে নিজের সম্মান হারানোর ছেলে তিনি নন।"
১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর ঋদ্ধির জন্ম শিলিগুড়িতে। ২০০৬-০৭ এর রঞ্জি ট্রফিতে নামার আগেই অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অনূর্ধ্ব-২২ দলের হয়ে খেলেছেন তিনি। আজ এত বছর পরে ৩৮ বছর বয়সেও কী ভাবে আরও উন্নতি করবেন, তা নিয়ে ভেবে চলেছেন ঋদ্ধিমান। বলা হয় না, ''বয়স শুধুই সংখ্যা মাত্র।'' ঋদ্ধি বারবার সেটাই প্রমাণ করে চলেছেন।
নিবন্ধকার: ঋদ্ধি রিত