সত্যনারায়ণ কথা

সত্যনারায়ণ পুজো  হিন্দু দেবতার ধর্মীয় উপাসনা। সত্যের অর্থ ‘সত্য’ এবং নারায়ণের অর্থ, ‘সর্বোচ্চ সত্তা’ তাই সত্যনারায়ণ কথার অর্থ ‘সত্যের মূর্ত প্রতীক সর্বোচ্চ ব্যক্তি’। এই দেবতার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় স্কন্ধ পুরাণে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, আসাম, বাংলা, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, বিহার, ওড়িশা, মণিপুর সহ ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে শ্রী সত্য নারায়ণ পুজো একটি খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এই আচারটি সাধারণত প্রতি মাসের পূর্ণিমা দিনে করা হয়। সত্যনারায়ণ পুজোর সঙ্গে বাঙালী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একবারও সত্যনারায়ণ হয়নি এরকম বাঙালী বাড়ি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বাড়িতে কোন শুভকাজের আগে বা পরে সত্যনারায়ণ পুজো  বা নতুন বাড়িতে প্রবেশের আগে সত্যনারায়ণ পুজো , যেকোনো শুভ কাজেই নারায়ণ দেবতার আশীর্বাদ আমাদের চাইই চাই। আবার মুসলমানরা তাকে পীর হিসেবে মান্য করতো। হিন্দুরা সেই একই লোককে নারায়ন ভেবে পুজো  করতো। তিনি মুসলমানের সত্যপীর আর হিন্দুদের সত্য নারায়ণ দেবতা। এক পর্যায়ে হিন্দু মুসলমান সবার কাছেই তিনি সত্যপীর হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন। ইতিহাসে তিনিই সত্যপীর নামে পরিচিত।

ছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই কমবেশি সত্যপীরের কাহিনি শুনে আসছি। মানুষের মুখে মুখে চলে আসা কত বছর আগেকার এই কাহিনি কতটা বাস্তব আর কতটা মিথ তা নিয়ে হয়তো কখনই ভাবিনি। তবে বাংলায় হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয় তিনি। তাঁকে ঘিরে আবর্তিত গল্পটি বেশ মনোরম।

 এক গ্রামে এক বামুন বাস করত। তার সংসারে তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না। ভিক্ষা করাই তার জীবিকা ছিল। বামুন একদিন ভিক্ষায় বেরিয়ে সারাদিনে কিছু না পেয়ে গাছতলায় বসে মনের দুঃখে কাঁদছিল। তা দেখে নারায়ণের মনে করুণা হল। বামুনের পরীক্ষা নেবার জন্য ফকিরের বেশ ধরে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। ফকির বামুনকে দুঃখের কথা জানতে চাইলে বামুন বলল, ‘তোমার অবস্থা তো আমারই মতো, তুমিও তো আমার মতো ফকির। তোমাকে আমার দুঃখের কথা বলে কী করব’। ফকির বলল ‘তুমি আমাকে সামান্য ভাবছ, পরে জানতে পারবে আমি কে?’

তা শুনে বামুন বলল, “আমি ভিক্ষা করে খাই, আজ সারা দিন ঘুরেও কিছু পেলাম না তাই দুঃখে কাঁদছি”। শুনে ফকির বলল, "তুমি সত্যপীরের পুজো করো, তাহলে দুঃখ দূর হবে।"

তাই শুনে বামুন বলল, ‘আমি পীরের পুজো কেন করব? আমি তো বামুন’। তখন ফকির হেসে তাকে বলল, ‘তো কি হয়েছে? পীর আর নারায়ণের মধ্যে কোনও প্রভেদ নাই। শুধু নামেই পার্থক্য।"

কিন্তু বামুনের মন থেকে সন্দেহ যাচ্ছে না দেখে ফকির তারপর শঙ্খ, চক্র,গদা,পদ্ম ধারী চতুর্ভুজ নারায়ণের রূপে বামুনকে দর্শন দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমিই পীর ,আমিই নারায়ণ!"এই বলে তিনি তাঁর পুজোর নিয়মও বামুনকে বললেন। বামুন ভক্তিভরে নারায়ণকে প্রণাম করল এবং বাড়ি ফিরে বামুনীকে সব বলল। পর দিনই সত্য নারায়ণ পুজোর ভাল দিন ছিল, তারা ভাল করে পুজো দিল। আর পুজোর প্রসাদ প্রতিবেশীদের বিতরণ করল। এর পর দেখতে দেখতে বামুন বামুনীর সুসময় ফিরল। বামুন একদিন সত্যনারায়ণ পুজোর জোগাড় করছে, তখন বনের এক কাঠুরে তার ঘরে জল চাইতে এল। কী পুজো হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বামুন কাঠুরেকে সত্যনারায়ণ পুজোর মাহাত্ম্য বলল। সেই শুনে সেও তার ঘরে এই পুজো দিল এই ভাবে মুখে মুখে এই পুজো প্রচার পেল।

কাঠুরের ঘরে মধু নামে এক বেনে কাঠ কিনতে এল। কাঠুরে সেদিন সত্যনারায়ণ পুজোর আয়োজন করেছিল। কী পুজো হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে কাঠুরে মধুবেনেকে এই পুজোর মাহাত্ম্য খুলে বলল। শুনে মধুবেনে নারায়ণের কাছে মানত করল যদি তার একটি সুন্দর কন্যা হয় তাহলে সেও এই পুজো করবে। নারায়ণের ইচ্ছায় তার মনস্কামনা পূর্ণ হলে মধুবেনে খুব ধুমধাম করে সত্যনারায়ণ পুজো দিল। দেখতে দেখতে মধুবেনের মেয়ে বিবাহযোগ্যা হল। অনেক খুঁজে মেয়ের জন্য পাত্র স্থির হল। বিয়ের পর মধুবেনে তার জামাইকে নিয়ে বাণিজ্যে বের হল। কিন্তু ধীরে ধীরে সত্যনারায়ণের কথা তারা ভুলে গেল। তারা যে রাজ্যে বাণিজ্যে গেল সেই রাজার রাজভান্ডার থেকে বহুমূল্য রত্ন, ধন চুরি গেল। রাজা চারিদিকে লোক লাগালেন তা খোঁজার জন্য। নারায়ণের ছলনায় তা মধুবেনের নৌকায় জড়ো হল। তার নৌকা ঘাটে নোঙর করলে রাজার লোক তার নৌকা থেকেই সব ফিরে পেল। রাজা তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করল। এই ভাবে দিন যায়। ওই দিকে মধুবেনের বাড়ির সেই শ্রী রইল না, তাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। মধুবেনের মেয়ে ,বউ তাদের ফেরার আসায় প্রতিবেশীর বাড়ি সত্যনারায়ণ পুজোয় গিয়ে মানত করে এল। আর দিনরাত আবার নারায়ণের নাম করতে লাগল। তা দেখে আবার নারায়ণের মনে দয়া জাগল। তিনি রাজাকে স্বপ্নে মধুবেনে আর তার জামাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করার আদেশ দিলেন। রাজা ভয়ে নারায়ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে মধুবেনে আর তার জামাইকে মুক্ত করে অনেক ধন দিয়ে পাঠালেন। নারায়ণের এবার মধুবেনের পরীক্ষা নিতে ইচ্ছা হল। তিনি ফকিরের বেশ ধরে তার ডিঙির সামনে হাজির হলেন। বেনেকে বললেন তাকে ভিক্ষা দিলে তার ধন তিনগুণ বেড়ে যাবে,তা শুনে বেনে জানায় সে তো নিজেই ফকির সে আবার তাকে কি আশীর্বাদ করবে! ফকির বলে আমার আদেশেই তুমি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছ। বেনে তা বিশ্বাস করে না। সে জানায় তার ডিঙিতে শুধু ছাই আছে। এই কথা ফকিরের হৃদয়ে আঘাত করে। এরপর বেনে নৌকায় উঠে দেখে সত্যি সব ছাই হয়ে গেছে। তার জামাই বলল, ‘বাবা এসব ফকিরের অভিশাপে হয়েছে,চলুন তার কাছে ক্ষমা চাই।’

তারা আবার ডিঙি ফিরিয়ে ফকিরের পা ধরে অনেক কেঁদে ক্ষমা প্রার্থনা করল। ফকিরের আবার দয়া হল এবং তিনি সব ফিরে পাবার আশীর্বাদ করলেন। এরপর দেশে ফিরে মধুবেনে তার নৌকাতে আগে সত্যনারায়ণ পুজো দিল এবং সেই প্রসাদ প্রতিবেশী পরিজন সবাইকে বিলিয়ে নিজে খেল। এইভাবে এই সত্যনারায়ণ পুজো প্রচার পেল।

দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পৃথক পরিবেশে ও প্রথায় পুজো বা উপাসনা অনুষ্ঠিত হলেও আদি ধারা লুপ্ত হয় না, সে কারণ সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর পুজো অর্চনায় ভক্তদের স্ব-স্ব উপাস্যের প্রতি ধারণা বিশ্বাস বিভক্ত হয়নি। সে কারণে একটি উপাস্যের সঙ্গে অপরটি বহু দিক থেকে মিল দেখা যায়। মধ্য যুগে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবিদের রচিত সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য বা পাঁচালীর মধ্যে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর অভিন্ন বলে প্রচার হয়ে থাকে। এ সকল দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে মনে হতেই পারে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর আদিতে যাই থাকুন বর্তমানে গত কয়েক শতাব্দী বা মধ্যযুগ হতে হিন্দু ও মুসলমানদের একটি সমন্বিত দেবতা। কিন্তু অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ঠিক সংস্কৃতি সমন্বয় সাধন প্রচেষ্টা নয়, 'মুসলমান শাসকের চণ্ডনীতি' থেকে আত্মরক্ষার জন্য হিন্দুরা এরূপ মিশ্রদেবতার উদ্ভাবন করে নিজ নিজ ধর্মের মুসলমানি রূপান্তর ঘটিয়েছিল।

সত্যনারায়ণ পুজোর নিয়মেই আছে পাঁচ ভাগে সিন্নি ভাগ করে দিতে হবে। তীরপীঠ বা মোকামের পাশে দিতে হবে। স্কন্ধ পুরাণ অনুসারে পঞ্চ দেবতার পুজো ছাড়া সর্বাগ্রে নারায়ণ পুজো অসম্ভব।

পঞ্চদেবতা যথাক্রমে গণেশ, সূর্য্য, শিব, দুর্গা,  চারপাশ এবং মাঝখানে সত্যনারায়ণ বা নারায়ণ-এর পীঠ বসিয়ে সিন্নি নিবেদন করা হয়। যেহেতু পঞ্চ দেব-দেবী কে নিবেদন করে পুজো অনুষ্ঠান করা হয়, তাই সিন্নিও পাঁচ ভাগে দেওয়া হয়। সিন্নি নিবেদনের বিশেষ মন্ত্র আছে।

অনেকে হয়তো জানেন পঞ্চ পীর এর কথা, তাঁরা হলেন ইউনুস, হূদ, ইব্রাহিম, নূহ এবং হযরত মোহাম্মদ। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। 

সম্রাট বাবরের আমলে যখন হিন্দুদের পুজো করা নিষেধ ছিল এবং পুজো করলে অত্যাচার হত তখন প্রচলিত পাঁচালীর মধ্যে লেখকরা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহার করেন। যাতে মুসলিমরা মনে করে সত্যনারায়ণ হলেন একজন পীর যাঁর নাম ‘সত্যপীর’। এজন্য সত্যপীরের পুজো মুসলিমদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বস্তুত স্কন্দ পুরাণ এর ‘রেবা খন্ডোক্ত’ অধ্যায়েই সত্যনারায়ণের মূল ব্রত কথা আছে। এর সঙ্গে পীর-পয়গম্বর এর সম্পর্ক নেই।

ভারতচন্দ্রের সত্যপীর বিষয়ক কাব্যে বিষ্ণুশর্মা সত্যপীরের সিন্নি দিয়ে ধনসম্পদ লাভ করে এরকম বিবরণ পাওয়া যায়। সত্যপীরের সিন্নির রীতিপদ্ধতি সম্বন্ধে বিবরণ পাওয়া যায় বটতলার প্রকাশিত সত্যপীরের পুঁথিতে। সওদাগর পুত্র মদন ও কামদেব বাণিজ্য শেষে ফিরে এসে নিম্নরূপে সত্যপীরের সিন্নি করে- ‘ডাকিয়া কুটুম্বগণ আপনার ঘরে।/ ছামানা করিয়া সত্যপীরের শিরনী করে।।/ সোয়া মন আনে আটা সোয়া মন চিনি।/ সোয়া মন আনে দধি আর যে বিরণী।।/ পাকা কলা আটা আদি তাহাতে ডালিয়া।/ ভরিল বাসন সব হালুয়া করিয়া।।/ এক হাজার পান আর যে সুপারি।/ আগর চন্দন চোত্তা গোলা কস্তুরি।।/ সকল ফুলের হার আস্তানাতে দিয়া।/ চৌকির উপরে সবে সাজাইল লিয়া।।/ ঘর পুর নারিকেল রাখে তার পরে।/ চার তীর চারিধারে গাড়িল যে জোরে।।/মোল্লাজি আসিয়া ফাতেহা করিল তামাম।’

 তাই পুঁথি ও পাঁচালি দেখে এই দেবতাকে অভিন্ন বলেই মনে করা হয়। তিনি যেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। যদিও তাঁর বিশেষ কোনও রূপের ছবি ধরা পড়ে না। দেবদেবীর মূর্তি-পূজক হিন্দুসমাজেও সত্যনারায়ণের বিশিষ্ট কোন মূর্তি দেখা যায় না। উন্নত বা বর্ণহিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সত্যনারায়ণ ও বিষ্ণু অভিন্ন বলে প্রচার করে থাকেন এবং সত্যনারায়ণের প্রতীক রূপে (বিষ্ণুর প্রতীক) শালগ্রাম শিলা পূজিত হয়। কিন্তু অনুন্নত কিংবা পল্লীর হিন্দুসমাজে যে সকল স্থানে সত্যনারায়ণ পুজোয় পৌরোহিত্য করেন ব্রাহ্মণেতর কোন জাতি, যে সকল ক্ষেত্রে শালগ্রাম শিলা থাকে না, তবে যে প্রতীক থাকে তা হল- কয়েকটি লোহার সরু শিক চার-পাঁচ ফুট লম্বা, সেগুলি একত্র করে ঠিক মাঝ বরাবর দু পাঠ করা হয়, পরে শিকগুলির শেষ অংশ তার দিয়ে বেঁধে সমগ্র অংশ লাল রংয়ের কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়, ফলে প্রতীকটি দেখতে হয় গদার মত। পল্লীর সত্যনারায়ণের একান্ত পুরোহিতের কাছে এরূপ প্রতীক থাকে, গৃহস্থের বাড়ি সত্যনারায়ণ পুজোর সময় পুরোহিতরা ওইরূপ প্রতীকটিকে সেখানে নিয়ে যান। সত্যনারায়ণের ডোম-পণ্ডিত বা পুরোহিতরা, একটি মাটির ছোট ভাঁড় বা পিতলের কলসীর উপর সিঁদুর মাখিয়ে সত্যনারায়ণের প্রতীক করে নেন। ওইরূপ প্রতীকটি একটি থালা বা বারকোষের উপর স্থাপন করে পল্লীর সকল শ্রেণির গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ভ্রমণ ও সত্যনারায়ণের গান করে থাকেন। পল্লীর বধূরা সত্যনারায়ণের পুজোর উদ্দেশ্যে ডোম পুরোহিতের হাতে ফলমূল পাঁচটি বা সংপায় আশা করে পয়সা দিয়ে থাকেন। কোন কোন ডোম পুরোহিতের পুজোর জন্য সত্যনারায়ণ পুজোর স্থায়ী থান (বা খড়ে ছাওয়া মাটির মন্দির) থাকে, তার কেন্দ্রস্থলে প্রতীক ঘট স্থাপিত হয়—পল্লীর সকল শ্রেণীর হিন্দু-মুসলমান সে রূপ থানে পুজো দিয়ে থাকেন। গাভীর প্রসব  হবার পর দুধ বা বাগানের কলা পাকাবার পর একছড়া কলা সত্যনারায়ণের থানে দিয়া আসেন। পল্লী অঞ্চলে এরূপ লোকায়ত বিধান বর্তমানেও কিছু কিছু প্রচলিত আছে। নিষ্ঠাবান উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা সত্যনারায়ণের (বিষ্ণুর) শালগ্রাম প্রতীকে এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধ্যান মন্ত্রে পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, পুরোহিতরা প্রচার করেন বিষ্ণু ও সত্যনারায়ণ অভিন্ন, কিন্তু পুজোর নৈবেদ্যের মধ্যে ও পাঁচটি মোকাম এবং প্রতীকের আসনের উপর একটি ক্ষুদ্রাকৃতি লৌহ অস্ত্র রাখা আবশ্যিক রীতি বা বিধান দেখা যায়। হিন্দুদের কোনও শাস্ত্রীয় বা লৌকিক দেবতার পুজোয় শিরনি বা কাম নৈবেদ্য রূপে থাকে না বা দেবতার মূর্তি-প্রতীকের আসনের উপর কোন অস্ত্রও রাখার রীতি নেই। উপাস্যের উদ্দেশ্যে শিরনি বা মোকাম উৎসর্গ করা সম্পূর্ণ মুসলমানি প্রথা। 'শিরনি' ও 'মোকাম' দুটিই ফারসী শব্দ। সত্যনারায়ণ পুজো য় হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধানে ধ্যান-মন্ত্র-আবৃত্তি ও আরতি অন্তে পুজো র অঙ্গ হিসাবে পুরোহিতগণ, সত্যনারায়ণ দেবতার যে মাহাত্ম্য প্রচারক কাব্য (পুঁথি) বা 'ব্রত কথা' পাঠ করে থাকেন, তার মধ্যে মুসলমান ফকিরের বা পীরের উল্লেখ শুধু নয়- সত্যনারায়ণ যে পীরের রূপ ধরেছিলেন এবং সত্যপীর ও সত্যনারায়ণ অভিন্ন এরূপ প্রকার থাকে। হিন্দুরা বহু দেবতার মূর্তি গড়ে বা প্রতীকে পুজো  করতে পারে শাস্ত্রীয় বাধা নেই, কিন্তু মুসলমানদের শরিয়তে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারুর উপাসনা করা নিষিদ্ধ, কোরানে পীরবাদও নেই, মুসলমানদের উপাস্যের মূর্তি বা প্রতীক পুজো  গর্হিত কর্ম। অথচ দেখা যায়, বাংলার বহু স্থানে কোন কোন মুসলমান সত্যপীরের  প্রতীক—মাটির তৈরি ছোট স্তূপ বা ঢিপি সম্মুখে রেখে উপাসনা করে থাকেন। নিষ্ঠাবান বা শাস্ত্রশাসিত মুসলমান সমাজে উপাস্যের মূর্তি এমনকি প্রতীক পুজো নিষিদ্ধ হলেও পল্লীর লোকায়ত বিধান অনুসরণকারী কোন মুসলমান সমাজে বা সত্যপীরের দরগায় প্রতীক দেখা যায় একটি পিঁড়ির উপর বৃত্ত এঁকে তার মধ্যস্থলে মাটির একটি ক্ষুদ্র স্তূপ রাখা হয় ও তার উপর একটি ক্ষুদ্র লৌহ অস্ত্র বা ছোরা ও ফুলের মালা দেওয়া হয়। সত্যপীরের দরগায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তি পুজো বা হাজোত দিয়ে থাকেন।

তাই দেখা যায় তিনি শুধু কোনও ধর্মের নয়, কোনও বর্ণের নয়, কারণ তিনি ব্রাহ্মণ ও অন্তঃজ্য শ্রেণীর পুজো পেয়ে থাকেন। তিনি যেন সমস্ত কিছুর উপরে। আসলে আমাদের কাছে যা সত্য তাই তিনি তাঁকে সত্য মেনে হিন্দুরা নারায়ণ ও মুসলিমরা পীর রূপে পুজো করে থাকে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...