উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রভূমি বলতে বিশ্ববিদ্যালয়, মানে ইউনিভার্সিটি - বোঝায়। আর প্রথমেই সেই তালিকাভুক্ত হয়, ঐতিহ্যশালী বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষা দান বা গ্রহণ, নিদেন পক্ষে গবেষণালব্ধ জ্ঞানার্জনও এক বিশাল সম্মানের। আর তা বলতে বোঝায় পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি। অনুমিত হয় যে, ১১শ শতাব্দীর শেষ দিকে অথবা ১২শ শতাব্দীর প্রথমে এই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই চিরাচরিত প্রাচীনত্বের তকমা আর এই দুই প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া চলে না। কারণ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এখনও মরক্কোর বুকে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেখানে শিক্ষা দান, প্রদান, গবেষণা এবং ডিগ্রি প্রদান সবই সাফল্যের সাথেই হয়ে চলেছে। আরো আশ্চর্যের, কারণ যে সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম তখন নারী স্বাধীনতা মূলত মুসলিম সমাজের ক্ষেত্রে, স্বাধীন চিন্তা মূলত নারীদের ক্ষেত্রে তেমন ছিল না। আজ সেই ইতিহাসই জানবো ।
সময়টা ৮৫৯ সাল। মরক্কোর ফেজ শহরের বুকে তৈরি হলো ইউনিভার্সিটি অফ আল-কারাউইন। এটিই ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের প্রাচীনতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এখানে ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। পড়ানো হতো প্রাকৃতিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো বিষয়। আর যার মানস সন্তান এই বিশ্ববিদ্যালয় তিনি ছিলেন একজন মুসলিম মহিলা, নাম ফতিমা আল-ফিহরি।
খ্রিস্টীয় নবম শতকে বর্তমান টিউনিশিয়ার কায়রাওয়ান শহরে জন্মেছিলেন ফতিমা। তারপর পারিবারিক সূত্রেই চলে আসেন মরক্কোর ফেজ শহরে। সেখানে ফতিমার পিতা বিন আবদুল্লাহ হয়ে ওঠেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী, মালিক হন প্রভূত সম্পত্তির। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা ফতিমা ও মারিয়াম সেই বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। ইতিমধ্যে মরক্কোর মুসলিম সম্প্রদায় মানসিক এবং সার্বিক উন্নতির দিকে অগ্রণী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ফতিমা তাঁর বিপুল সম্পত্তি মসজিদের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করলেও উচ্চ শিক্ষার ব্যাপ্তি যে জীবনের মানে ও গতি পরিবর্তন করতে পারে সেই তাগিদে সেখানকার মানুষের সার্বিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেন।
আর তার এই উদ্যোগকে সফল করতে সহযোগী হয় আল-কায়রাওয়ান মসজিদ। ফাতিমার আনুকূল্যে ও এই মসজিদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৮৫৯ সালে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, নাম হয় ইউনিভার্সিটি অফ আল-কায়রাওয়ান এবং প্রথম মহিলার শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অভিনব ও অভাবনীয় উদ্যোগ। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মধ্যযুগে বৌদ্ধিক চর্চার পীঠস্থান। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আবুল আব্বাস, মোহাম্মদ ফাসির মতো ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থী হিসেবে সমৃদ্ধ হন এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। ঐতিহাসিক ইবন খালদুন, জ্যোতির্বিদ আল বিত্রুজির নাম জড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টারের আরবি সংখ্যা আবিষ্কারের কথা অজানা নয় আর তাঁর সমৃদ্ধির ক্ষেত্র ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। তিনিও এখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে অন্যতম প্রাচীন একটি গ্রন্থাগার। আর এখনো সেই গ্রন্থাগারের সংগ্রহে আছে ৪০০টিরও বেশি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। আছে ঐতিহাসিক ইবন খালদুনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত। যদিও ক্রমশ বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। তার অস্তিত্ব থাকলেও ম্লান হয়েছে আভিজাত্য।
আজ বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ভুক্ত না হলেও, শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে ফতিমার মতো মহীয়সী মহিলা ও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মহিলাদের ক্ষেত্রে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা আজ আছে, নানা রূপে। আজও উচ্চশিক্ষায় নানান বিভাজন হয় অথচ সভ্যতার ইতিহাসে উচ্চশিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছিলেন একজন মহিলা। ফতিমা আল-ফিহরি। তার মানসিক ব্যাপ্তি এ যুগে অনুপ্রেরণা তো বটেই।