কানায় কানায় ভর্তি প্রেক্ষাগৃহ। পিন পড়লেও বোধহয় শব্দ শোনা যাবে। দর্শকরা কিন্তু ভিতর ভিতর ফুটছেন টগবগিয়ে। কী হয় কী হয় ভাব!
স্টেজে এক্ষুনি মানুষ কাটা হবে যে! একেবারে করাত দিয়ে!
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেল গোটা মঞ্চ। তখন আর সেটা মঞ্চ নয়, মনে হবে হাসপাতালের অস্ত্রপ্রচার কক্ষ। এক মহিলাকে শোয়ানো হল টেবিলে। জাদুকরের ইশারায় মঞ্চের ওপর থেকে নেমে এল ইলেকট্রিক করাত! মহিলার পেট বরাবর। দু’ভাগ হয়ে গেলেন!
ধীরে ধীরে সরে গেল ধাতব পাত। জাদুকর ডাকতে লাগলেন সেই নারীকে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন। জাদুকর বিছানা থেকে তাঁকে তুলে হাত ধরে নিয়ে এলেন দর্শকদের সামনে। এমন আজব ভোজবাজিতে হতবাক প্রেক্ষাগৃহ! বাড়ি ফিরেও তাঁরা ভুলতে পারেন না ইন্দ্রজালের মোহ আর জাদুকরের সম্মোহন। জাদুকরের নাম যে পি সি সরকার। তিনিই আধুনিক জাদুর জনক প্রতুলচন্দ্র সরকার।
জাদুর জগতে মহারাজা তিনি। তাঁর ইন্দ্রজালের কৌশলে মুগ্ধ হয়েছিল গোটা বিশ্ব। নিজের মঞ্চ উপস্থাপনার নাম দিয়েছিলেন ‘ইন্দ্রজাল’। ‘জাদু’ তাঁর কাছে কোনও দিনই নিছক ‘জাদু’ ছিল না। তিনি বলতেন ‘মায়াবিদ্যা’। মাথায় পাগড়ি, গায়ে ঝলমলে পোশাক, পায় নাগরায় সত্যি সত্যিই মঞ্চে হাজির হতেন রাজার বেশে। তবে জাদু বিদ্যায় দীক্ষাগুরু ছিলেন তাঁর এক মামা, দীনেশচন্দ্র নন্দী। পথে পথে ভানুমতীর খেল দেখিয়ে বেড়ানো মাদারিদের কাছে খেলা দেখেও আগ্রহ বাড়ে।
অধুনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার আশেকপুর গ্রাম জন্ম। সেখানেই জন্ম হয় ভগবানচন্দ্র সরকার ও কুসুমকামিনীদেবীর প্রথম সন্তান প্রতুলের। ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। চরম দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠা। কিন্তু বালক প্রতুল ছিল অত্যন্ত মেধাবী।
বাড়ির পাশেই শিবনাথ হাই স্কুলে পড়াশোনার শুরু। অঙ্কে দারুণ মাথা। প্রতিদিন স্কুল যাওয়ার পথে পড়ত একটা ঝিল। ঝিলের দু’পাশে ছিল মাদারিদের বাস। তাদের কাছেই হয় প্রতুলের জাদুবিদ্যার হাতেখড়ি। তবে তাদের কাছে পৌঁছানো খুব একটা সহজ ছিল না শুরুতে।
বেজায় ভালবাসতেন মাদারির খেলা। একদিন সেই খেলা দেখতে দেখতে নিজেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন একটা খেলা। মাদারির দল প্রথমে তাকে বিশেষ পাত্তা না দিলেও পরে বেশ ‘দোস্তি’ হয়ে যায়। সেই থেকেই খেলা শেখার শুরু।
ইস্কুলের বন্ধুরাও তার খেলা দেখে চমকে যেত! আস্তে আস্তে স্কুওলের অনুষ্ঠানেও ম্যাজিক দেখানোর ডাক আসত। বাড়িতে বাবা-মা কিন্তু চাইতেন ছেলে ‘শিক্ষক’ হোক। ১৯৩৩ সালে অঙ্ক নিয়ে কলেজের গণ্ডি পার হলেন। আর তার পরেই পুরোপুরি নিজেকে সঁপে দেন মায়া বিদ্যার কাছে।
আইএ পড়ার সময় তাঁর আলাপ হল জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীর সঙ্গে। হাতেকলমে জাদুবিদ্যা শেখা ও চর্চার আরও সুযোগ হয় তাঁর। সঙ্গে দেশি-বিদেশি বই থেকেও চলতে থাকে জাদু বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা।
১৯৩৪ সালে প্রথম বার বিদেশ সফরের সুযোগ এল। কিন্তু বিদেশ যাওয়ার রাহা-রেস্ত আসবে কোথা থেকে? নিজের বাড়ি বন্ধক রেখে, সেই টাকাতেই দল নিয়ে পৌঁছলেন হংকং। বিশ্বখ্যাত জাদুকর লাইয়েল-এর সঙ্গে ডুয়েল হবে। তবে জাদু বিদ্যার এই ডুয়েলের ধরণ খানিক ছকভাঙ্গা পথেই হয়েছিল।
একই দিনে দু’টি আলাদা আলাদা প্রেক্ষাগৃহে দুই জাদুকরের খেলা শুরু হয়। কয়েক দিন যেতে না যেতেই, লাইয়েল বুঝলেন যে তাঁর হার নিশ্চিত। কারণ দিন এগোতে থাকে আর খালি হতে থাকল লাইয়েলের প্রেক্ষাগৃহের দর্শকাসন। শেষে এক দিন বন্ধ হয়ে গেল তাঁর শো। ইন্দ্রজালে জিতলেন বাংলার প্রতুল। ফ্রান্স, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, মিশর, কেনিয়া, ইরাক, আরও নানা দেশে ঘুরতে লাগলেন জাদুবিদ্যার দল নিয়ে! পৃথিবী তাঁকে চিনল এক নতুন নামে- ‘জাদু-সম্রাট পি সি সরকার’। পি সি সরকার বিদেশে সব থেকে বেশি শো করেন জাপানে— ৩৭ বার। তাঁর জীবনের শেষ ম্যাজিকও জাপানের মঞ্চেই দেখান তিনি। ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি প্রয়াত হন প্রবাসে।