থিয়েটারের গানের কথা

সময়টা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। দিকে দিকে তখন দেশাত্মবোধের ধ্বনি। থিয়েটার, সিনেমা, গান এই ধরনের বিনোদনমূলক প্রচারেও ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসার ছোঁয়া। বিপ্লবীরা চাইছিলেন বিনোদন মাধ্যমেও দেশাত্মবোধকে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু থিয়েটার তখন ছিল কেবলমাত্র গুটি কয়েক মানুষের বিনোদনের মাধ্যম। ‌

১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হল। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে থিয়েটারের দরজা খুলে গেল সর্বসাধারণের জন্য। শুরুর দিকে থিয়েটার কেবলমাত্র নাটক সম্বলিত ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে যোগ হলো গান। থিয়েটারের গায়ে লাগলো মুক্তির পালক। এই সময় বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল দেশাত্মবোধক থিয়েটারের গান।

সেসময় বাংলা গান বলতে ছিল কবিগান, আখড়াই তরজা, পাঁচালী গান ইত্যাদি। জমিদার ও রাজা রাজড়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এইসব গান। তখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে সেভাবে পৌঁছয়নি গান। বিত্তশালীদের আয়োজিত পুজো, ঝুমুর উৎসব, কবিগান, তরজা, যাত্রাপালার আসর থেকে সাধারণ মানুষ পেত গানের স্বাদ। এমনকি থিয়েটার দেখারও অনুমতি ছিল না সাধারণ মানুষের।

১৮৭২ সালে জমিদার বাবুদের প্রাঙ্গণ থেকে বাংলা থিয়েটার এল সাধারণ মানুষের নাগালে। ন্যাশনাল থিয়েটার-এর ভূমিকা এ বিষয় ছিল অপরিসীম। টিকিট কেটে রঙ্গালয়ের অভিনয় দেখার সুযোগ হল মানুষের। ধীরে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সঙ্গী হয়েছিল থিয়েটারের গান। কলের গান বা গ্রামাফোনের গান আসার আগে থিয়েটার ছাড়া গান শোনার উপায় তেমনভাবে ছিলনা।

তবে প্রথম দিকে নাটক গান ছাড়াই অভিনীত হত। কিন্তু ধীরে ধীরে নাটকের বিবর্তন হয়। এই বিবর্তনের ধারায় বয়ে আসে নাটকের গান। গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর নাটকের জন্য অনেক গান লিখেছিলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কলের গান আসার আগে পর্যন্ত প্রায়  ষাটটিরও বেশি গীতিনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছিল। বিনোদিনী দাসী, গঙ্গামণি, কৃষ্ণভামিনী, গোলাপসুন্দরী ও তারাসুন্দরীরা গিয়েছিলেন সেই সব গান।

নাটকে গানের সংখ্যা থাকত একের বেশি। আলিবাবা নাটকে ছিল ৩৬টি গান। এমনকি অনেক নাটক শুধুমাত্র গানের জন্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

শিশিরকুমার ভাদুড়ির পরিচালনায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে অন্ধ ভিক্ষুক-এর চরিত্রে দুটি গান গেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। 'মহাসিন্ধুর ওপার হতে''ঘন তমসাবৃত অম্বর ধরণী'। এই দুটি গান আজও সংরক্ষিত। এর পুনর্নির্মাণ হয়েছে বারবার।

নাটকের বেশ কিছু গান উনিশ শতকের প্রথমার্ধেও আমরা পেয়েছি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক থিয়েটারের গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। স্বদেশী আন্দোলনের মন্ত্র ছিল সেসব গান। যেমন 'সেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ', 'বঙ্গ আমার জননী আমার'

নাট্যগীতির অন্যতম সুরস্রষ্টা ছিলেন রামতারণ সান্যাল। ১৮৭৬  সালের ৪ঠা মার্চ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে গীতিনাট্য 'সতী কি কলঙ্কিনী' অভিনয়কালে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে থিয়েটারের মালিক, নাট্যকার ও অন্যান্য কলাকুশলীদের গ্রেপ্তার করে। তারপরই ইংরেজ সরকার প্রণয়ন করেন কুখ্যাত নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রামতারণ সান্যাল।

নাট্যগীতির ক্ষেত্রে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও রামতারণ সান্যাল শুরু করেছিলেন আরেক বিবর্তনের। আগে গানের কথা অনুযায়ী সুর সংযোগ করা হতো। কিন্তু এই দুই নাট্যগীতিকারের সাহায্যে প্রথমবার সুর অনুযায়ী কথা সংযোগ করা হয়।

রামতারণ সান্যালকে ‘অপেরা মাস্টার’ বলা হত। আরেকজন খ্যাতিমান নাট্যগীতি রচয়িতা ছিলেন দেবকন্ঠ বাগচী। ১৯১২ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে একে একে চলে যান গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ততদিনে গ্রামোফোন রেকর্ডও চলে এসেছে। তবে একেবারে মুছে যায়নি থিয়েটারের গান। বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলেছিল থিয়েটারের গানের জনপ্রিয়তা। কিন্তু সবাক চলচ্চিত্র শুরু হওয়ার পরে থিয়েটারের গানের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। গীতিবহুল নাটকের অভিনয় ও থিয়েটারের গানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভাটা আসে।

পরবর্তীকালে কাজী নজরুল ইসলাম অনেক এমন থিয়েটারের গান রচনা করেছিলেন ও সুর দিয়েছিলেন। ‘রক্ত কমল’ নাটকের শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। এই নাটকে ছিল নটি গান। গেয়েছিলেন ইন্দুবালা ও সরযূবালা দেবী।

পরবর্তীকালে আরও বিবর্তিত হয়েছিল থিয়েটারের গান। উৎপল দত্তর লিটল থিয়েটার-এর কল্লোল, টিনের তলোয়ার, তিতাস একটি নদীর নাম নাটকগুলিতে গানের প্রয়োগ ছিল। তবে ধীরে ধীরে এইসব গানের বিবর্তন এসছে। আধুনিকতার প্রলেপ পড়েছে এতে। এখনও টিকে রয়েছে থিয়েটার ও গান তার নিজের ধারাকে সঙ্গী করে। তবে কালের শ্রোতে এই সংক্রান্ত অনেক ইতিহাস বিলীন হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...