সাইকেলে করে আসছে কেউ। পরনে খাকি রঙের পোশাক। হাতে অনুভূতিদের বার্তা। কোন চিঠিতে প্রেমের গন্ধ। কোথাও আবার অনেক পরিশ্রমের পর চাকরির সুখবরে পরিবারের মুখে এক চিলতে হাসির অনুভূতির রং। কোন চিঠি বয়ে নিয়ে আসতো বিষাদের স্মৃতি-কথা। এত অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকা একখানা স্মৃতি-ঘর। ডাকঘর। পোস্টম্যানেদের দেখলেই অন্তরে দামামা বেজে চলত যেন। এই বুঝি কোন প্রতীক্ষার অবসান হলো। নাকি কোন নতুন অপেক্ষার শুরু। আবার কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের আগমন হৃৎকম্পন শুরু করে দিত। এমন সব অনুভূতিরা মিলেমিশে থাকতো ডাকঘরগুলো জুড়ে। সেই স্মৃতি-ঘরের জন্মদিন। ৯ই অক্টোবর। সারা বিশ্ব জুড়ে। ১৯৬৯ সালে টোকিওতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ডাক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই দিনটিতে পালিত হয় ওয়ার্ল্ড পোস্ট অফিস ডে অর্থাৎ বিশ্ব ডাকঘর দিবস। ডাকঘর মানেই জমানো স্মৃতি। তখন মানুষে মানুষে বার্তা পৌঁছানোর উপায় বলতে ছিল চিঠি। একফালি সাদা কাগজ। কখনো তা রঙিন হয়ে ওঠে অন্তরের কথায়। কখনো আবার শুধু কিছু প্রয়োজনীয় কথার ভিড়ে তার রং হয়ে যায় ফিকে। এই সাদা কাগজের অক্ষরগুলো কত মানুষকে তাদের আশার ফানুস ওড়াতে সাহায্য করেছে। তারপর এল পোস্টকার্ড। হলুদ রং। স্বাভাবিকভাবেই সীমিত শব্দ সংখ্যায় বাঁধতে হল অনুভূতিদের। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন এসব শুধুই স্মৃতি। তবেই ই-মেইলের যুগেও একটা চিঠি পাওয়ার মূল্য পরশপাথর খুঁজে পাওয়ার মতই।
বিশ্ব ডাকঘর দিবস পালিত হয় এই কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষকে সম্মান জানানোর জন্য। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা আমাদের আপনজনেদের বার্তা পৌঁছে দিয়ে চলেছেন নিরলসভাবে, এদিন তাঁদের কুর্নিশ জানানোর। আমাদের বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ডাকঘর তার ভূমিকা পালন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। বিশ্বের সমস্ত ডাক্তারদের একত্রিত করে রাখার দায়িত্ব-প্রাপ্ত সংস্থা ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন। বিশ্ব ডাকঘর দিবসের দিন তারা সাধারণত আয়োজন করে চিঠি লেখার প্রতিযোগিতার। এবছর খুব স্বাভাবিকভাবেই তা অনলাইনে আয়োজিত। নানান উৎসাহমূলক সৃজনশীল বিষয়ে চিঠি লিখতে হয় প্রতিযোগীদের। ২০২০ সালে বিশ্ব ডাকঘর দিবসএর থিম "আমরা সবসময়ই পৌঁছে দিই" অর্থাৎ "উই হ্যাভ অলওয়েজ ডেলিভারড"। কোভিডের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেও ডাক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সবসময় কাজ করে গেছেন। ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের মতে কোভিডের সময় ডাককর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করেছেন। অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন কোভিডে। তবুও থেমে থাকেননি। সুস্থ হয়ে আবার কাজে যোগদান করেছেন। ডাকঘর মানেই পৃথিবীর প্রত্যন্ত প্রান্তেও পৌঁছে যাওয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা। এমনকি দেশের সীমান্ত অঞ্চলে যেখানে সুরক্ষার প্রয়োজনে কোনো ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা পৌঁছতে পারে না, সেখানে একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায় হয়ে ওঠে ডাকঘর।
বর্তমানে ডাকঘর অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এমনকি জীবনদায়ী ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে প্রান্তিক এলাকায়। সব মিলিয়ে সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন ডাক কর্মীরা। সেই সব স্মৃতির ভারবহন করে অশীতিপর বৃদ্ধের মত সব অনুভূতিদের শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে ডাকঘর। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে। এবড়ো খেবড়ো দেওয়াল। ঠিক যেন আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে বিস্তার ডাকঘরের। ভারতে জাতীয় ডাকঘর দিবস পালিত হয় ১০ ই অক্টোবর। বিশ্ব ডাকঘর দিবসের ঠিক পরের দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই 'পোস্টমাস্টার' গল্প। রতনের সারল্য। আশার হাতছানি। পোস্টমাস্টার বাবুর সঙ্গে শহরে যাওয়ার ইচ্ছে। আসলে জীবনকে একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে। বর্তমানে আমরা সকলেই নানান আধুনিক গেজেট ব্যবহারে অভ্যস্ত। কিন্তু আজও ডাকঘরের দিকে তাকালে রতনের মতোই আকাঙ্ক্ষারা মনের মধ্যে পাক খেয়ে চলে। একবার জীবন নামের আশ্চর্য প্রদীপ যদি একটা খামে মোড়া কোন চিঠিতে পাঠাতো। হলুদ পোস্টকার্ড জুড়ে যদি ভালোবাসার গন্ধ লেগে থাকত। স্মৃতি মাখানো ডাকঘরের গন্ধ বোধহয় যে কোনো ভাষাকেই ছাপিয়ে যেত তাহলে।