ফটোগ্রাফির পেশায় রেনেসাঁস এনেছিলেন উনিশ শতকের বাঙালি কন্যেরা

এক গৃহবধূ। সময়টা মোটামুটি ঊনিশ শতক ধরা যেতে পারে। নাম ধরে নেওয়া যাক অনন্তবালা। পালকি থেকে নেমে ধীর পায়ে অনন্তবালা চলেছেন। লম্বা ঘোমটায় মুখ প্রায় ঢাকা। ধীরে ধীরে তিনি পৌঁছন একটা ছোট্ট দু’কামরার ঘরে। আস্তে আস্তে সরান ঘোমটা। কালো রংয়ের বাক্সের মত একটা যন্ত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ান অনন্তবালা।

প্রথম দিকটা বেশ ভয় করছিল অনন্তবালার। সেই কোন ছোটবেলায় শ্বশুরবাড়িতে আসা। তারপর থেকে ঘোমটার আড়াল ওর সঙ্গী। এই প্রথম একটা সাহসী, অন্যরকমের ইচ্ছেপূরণ করতে এসেছেন  অনন্তবালা।

কালো রঙের বাক্সের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একটু অস্বস্তিতেই পড়েছিলেন অনন্তবালা। কিন্তু ও প্রান্তের মানুষটি সহজ করে দিলেন সবটা। অনন্তবালা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই বিষয়টা খুব কঠিন হবে। একে তো ছবি তোলানোর মতো এমন আশ্চর্য শখ তার, অন্যদিকে ক্যামেরা হাতে নিয়ে দাঁড়াবে এক মহিলা, তাও আবার সেই মহিলার নিজের স্টুডিওতে, এত সহজে কি আর সবটা মিটবে!

ও মা! কোথায় কী! অনন্তবালার সব অস্বস্তি দূর হয়ে ঝকঝকে তকতকে একটা ছবি উঠল। তাও আবার এক মহিলার হাতে। অনন্তবালা নিশ্চিন্ত।

FotoJet - 2022-08-19T173022.792

মহিলা চিত্রগ্রাহিকা বলেই আসলে স্বামী অনুমতি দিয়েছিলেন ছবি তোলার। সেই কোন মেয়েবেলা থেকে লালন করা একটা শখ অবশেষে পূর্ণ হল অনন্তবালার।

ওপরে বর্ণিত গোটা ঘটনাটা আপাত-কাল্পনিক হলেও, বিষয়টা সত্যি। মহিলা ফটোগ্রাফার অর্থাৎ চিত্রগ্রাহীকার প্রথম আবির্ভাব ছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।

ছবি, সে কি শুধুই ছবি? ছবি মানে তো শুধু ছবি নয়। এক টুকরো দৃশ্যমান স্মৃতি। যাতে ধরে রাখা যায় কত রঙের অনুভূতি। পেশাগতভাবে বা শখে এই ছবির জগতে একসময় পুরুষরাই রাজত্ব করেছে। বহু বছর ধরে তারাই ছবির জগতের রক্ষাকর্তা ছিলেন। ছবিটা বদলালো ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে।

স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার তখন অনেকটাই অগ্রগতি লাভ করেছে। মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছেমতো উপার্জনের পথ বেছে নিচ্ছে। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের ইচ্ছের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তারা। ফটোগ্রাফি অর্থাৎ ছবি তোলার ক্ষেত্রে এই সময়েই নারীদের যোগদান শুরু হয়। যদিও প্রথম বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফার হিসেবে জানা যায় ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের তৃতীয় স্ত্রী মনোমহিনীর কথা। প্রথম ফটোগ্রাফি চর্চার শুরু হয়েছিল তাঁর মাধ্যমে। তবে সে চর্চা নেহাতই শখে। এর সঙ্গে উপার্জনের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

যে দুজন বাঙালি মহিলার নাম ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে উঠে আসে তারা হলেন- সরোজিনী ঘোষ এবং অন্নপূর্ণা দত্ত। এদের মধ্যে সরোজিনী ঘোষকে প্রথম বাঙালি পেশাদার মহিলা ফটোগ্রাফার হিসেবে ধরা হয়।

১৮৯৮ সাল। ১০ই জানুয়ারি। অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। 'দ্যা লেডি ফোটোগ্রাফার উইথ হার আর্ট স্টুডিওঅ্যাট ৩২ কোন বালিশ স্ট্রিট’।

প্রথম পেশাদারী ভাবে কোন মহিলা ফটোগ্রাফার একটি স্টুডিয়ো খুলেছিলেন। এই স্টুডিয়োতে কিছুদিনের মধ্যেই সিল্কের ওপর ফটো তৈরির ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তিনি। অমৃতবাজার পত্রিকায় তাঁর চিত্রগ্রহণ এবং তাকে সঠিক রূপদানের প্রশংসা করা হয়েছিল। ফটো ওয়াশ করার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল উল্লেখ্য। এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ গুলিও নিজের স্টুডিয়োতে বিক্রি করতেন সরোজিনী ঘোষ। ইতিহাসের পাতায় সেই ভাবে তথ্য পাওয়া যায় না সরোজিনী ঘোষের সম্বন্ধে। তবুও এক আনকোরা পেশা বেছে নিয়েছিলেন তিনি। যে বিষয় সে সময় আধিপত্য ছিল কেবলমাত্র পুরুষদের, সেটা জেনেও পিছিয়ে যাননি। তাঁর এই পদক্ষেপ সমাজকে এগিয়ে দিয়েছিল অনেকটা। সাহসী নারী ছিলেন সরোজিনী ঘোষ। কোন পুরুষ একটি মহিলা ফটোগ্রাফারের কাছে তার ফটো তোলাতে যাবেন কিনা সমাজের সেই রক্ষণশীল সময়ে এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু কোন ভাবনাই দমিয়ে দিতে পারেনি সরোজিনী ঘোষকে। তাঁর এই পেশার নির্বাচন মহিলাদের আগামী ভবিষ্যৎকে একটা উন্মুক্ত পথের সন্ধান দিয়েছিল এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই।

এরপরই উল্লেখযোগ্যভাবে নাম করতে হয় অন্নপূর্ণা দত্তের। ১৮৯৪ সালে জন্ম অন্নপূর্ণা দত্তের। তাঁর বাবা অম্বিকাচরণ মিত্র অধ্যাপক ছিলেন। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় অন্নপূর্ণার। নেহাত শখেই শিখেছিলেন ছবি তোলা। বিয়ের পর বেশ দিন কাটছিল তাঁর। স্বামী সদাহাস্য মানুষ ছিলেন। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও রক্ষণশীল ছিলেন না। স্ত্রীর ইচ্ছের মর্যাদা দিয়ে তাকে শিখিয়েছিলেন ছবি তোলা। তখন বোধহয় তিনিও ভাবতে পারেননি সেই ছবি তোলাই পরবর্তীকালে তাদের জীবনের আলোর পথ খুঁজে দেবে।

১৯৩০ সালে প্রবল অর্থকষ্ট নেমে আসে অন্নপূর্ণা দত্তের সাংসারিক জীবনে। পেশাদারী ভাবে ফটোগ্রাফি শুরু করেন তিনি। তবে স্টুডিয়ো তৈরির ক্ষমতা ছিল না তাঁর। বাড়ি থেকেই সব কাজ করতেন। বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে ছবি তোলার জন্য তাঁর ডাক আসত। ছবি তোলা তার ওয়াশ এবং তাকে ডেভলপ করা, তারপর সেই ছবি প্রিন্ট করিয়ে তা ফিনিশ করা সব ক্ষেত্রেই অন্নপূর্ণা দত্তের দক্ষতার সুনাম ছিল। ভারতের নাইটেঙ্গেল সরোজিনী নাইডুর একটি ছবি তুলেছিলেন তিনি। কবি জসীমউদ্দীন, রাজনীতিবিদ হাসান সূরাবর্দী সকলেই অন্নপূর্ণা দেবীর প্রশংসা করেছেন।

অন্নপূর্ণা দত্ত এবং সরোজিনী ঘোষের পর পেশাদার হিসেবে মহিলা ফটোগ্রাফারদের নাম সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে শখের ফটোগ্রাফার ছিলেন অনেকেই। চঞ্চলাবালা দাসী, মীরা চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী, অন্নপূর্ণা গোস্বামীদের নাম পাওয়া যায় বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফার হিসেবে। ছবি তোলার ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকা অনন্য এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এঁরা কেউই পেশাদার ফটোগ্রাফার ছিলেন না। তবে আজ ছবি তোলাকে যে সকল মহিলা ভালোবাসার সঙ্গে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন তাঁদের সেই পথ উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে এই মহিলাদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...