যন্ত্রগুলো আতঙ্কের মতো মনে হচ্ছে মেয়েটার। ছেলেটারও ধরা যেতে পারে। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের দিকে চোখ পড়লেই ভেতরটা শিরশিরিয়ে উঠছে। শরতের রোদ ঝলমলে আকাশ যেমন হঠাৎ করে মেঘে ঢেকে যায় বৃষ্টির কোন আগমন-বার্তা ছাড়াই, গতকালের পর থেকে এমন অন্ধকার হয়ে রয়েছে মেয়েটার মন। সাহস করে কথাগুলো ভাগ করে নিতে পারছে না কারোর সঙ্গে। অগত্যা যন্ত্রনাগুলো ভেতরে গুমরে মরছে।
মেয়েটার দোষ বলতে ছিল নিজের কিছু মতামত সামাজিক মাধ্যমে ভাগ করে নেওয়া। সতর্ক-বার্তা হিসেবে এটি তার ব্যক্তিগত মতামত সেটা উল্লেখ করা ছিল। কিন্তু শেষ-রক্ষা তাতেও হয়নি। সুরক্ষা দিতে পারেনি সে তার মনকে। তার দিকে ধেয়ে আসা গতকালের আক্রমণ থেকে এখনো বেরোতে পারেনি মেয়েটা।
সামাজিক মাধ্যমে কেউ নির্ভেজাল কোন বার্তা পাঠালেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে মেয়েটা। ভয়ে ভয়ে একবার নিজের অ্যাকাউন্টগুলো খুলে দেখছে এখনো কোনো দীর্ঘ আলোচনা চলছে না তো তাকে নিয়ে? সে আসলে সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে চায়নি! একটা ছোট্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল, সামান্য প্রগলভতার কারণে বেঁচে থাকাটা বড় বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। মেয়েটা একটা আকাশ খুঁজছে এখন। মুক্ত আকাশ। আত্নীয়-পরিজন, আপনজন, পরিচিত-অপরিচিত এসব গণ্ডি পেরিয়ে একটা নিজের আকাশ খুঁজছে।
বারবার চেষ্টা করছে সেই মুক্তির আকাশ পর্যন্ত পৌঁছনোর। কিন্তু কেউ যেন পেছন থেকে এসে বারবার ওকে টেনে ধরছে। সামাজিক মাধ্যম যে এমন ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে একথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মেয়েটা!
বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় যোগাযোগ সহজ হয়েছে। প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ আমাদের সবসময় একটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। সে জগতে অবাধ বিচরণ করতে শুরু করি আমরা। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলো একটু একটু করে বৃহৎ হতে থাকে। আমাদের পরিসর বাড়তে থাকে। নিঃসন্দেহে মনের ব্যাপ্তি ঘটানোর জন্য এই অভ্যেস ইতিবাচক।
কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের কিছু ঘটনা কিছু বিষয় আমাদের ভেতরে ভয়ংকর অবসাদ তৈরি করে। আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে আটকে দেয় একটা গণ্ডির মধ্যে।
যে সময় মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ খুব একটা সহজ ছিল না, তখন ব্যক্তিগত ক্ষেত্রও সীমাবদ্ধ থাকতো নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মধ্যে। তাই ছোটখাটো ভুল-ভ্রান্তির প্রতিক্রিয়াও সীমাবদ্ধ থাকত সেই মানুষগুলোর মধ্যে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার, প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের বিস্তার যত বাড়িয়েছে, ততই বাড়িয়েছে আক্রমণের ঝুঁকি। খুব আশ্চর্য লাগছে না! যে সামাজিক মাধ্যম পুরোটাই মনোরঞ্জন বা কিছু তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হতে পারে, তা হঠাৎ করে আক্রমণের ক্ষেত্র হতে যাবে কেন!
সমীক্ষা কিন্তু বলছে এমনটাই হচ্ছে। এর পোশাকি নাম সাইবার বুলিং। ভার্চুয়াল ক্ষেত্রে কাউকে আক্রমণ করা, অসম্মানজনক কথা বলা, আহত করা সবচাইতে সাইবার বুলিং-এর অংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে রোজ তিনজনের মধ্যে অন্তত একজন কিশোর বা কিশোরী এই ভার্চুয়াল আক্রমণ অর্থাৎ সাইবার বুলিং এর শিকার। বেশি শিকার হচ্ছে মেয়েরা। মনোবিদরা আক্রমণকারী অর্থাৎ সাইবার বুলিং যারা করছে তাদের অন্তরমহলেও হানা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মূলত অন্যের দুঃখ-কষ্টে নিজের আনন্দ অর্থাৎ স্যাডিস্টিক প্লেজার আমরা যাকে বলি সেটাই কারণ এই সাইবার আক্রমণের। স্ক্রিনের আড়াল থেকে কিছু মানুষকে আক্রমণ করে তাঁর আত্মসম্মান মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া, তাঁর আত্মবিশ্বাসে আঘাত করা কিছু মানুষের কাছে নেশার মত। অন্যকে আহত করার মাধ্যমে সেই অপরাধী আসলে কিছু সময়ের জন্য নিজের অপূর্ণতা, দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন। অন্যকে আঘাত দেওয়ার ভাবনাটাও কিন্তু আসলে অসুখ।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন যিনি আক্রমণ করছেন এবং যিনি আহত হচ্ছেন দুজনেই কোথাও না কোথাও মানসিক সমস্যার শিকার।
মনোবিদরা বলছেন এই ভার্চুয়াল আক্রমণে আহত হয় মন। যার সঙ্গে এমনটা করা হয়, আতঙ্ক বাসা বাঁধে তাঁর মনে। কিছু ক্ষেত্রে যিনি আক্রান্ত করছেন হয়তো আদতে সেই ভাবে তাঁর করার কিছু থাকে না। তবুও এই সাইবার বুলিং এড়ানোর সেই অর্থে কোন ওষুধ নেই।
মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যিনি আক্রমণ করেন মূলত ছয়টি কারণে আক্রমণ করেন। রাগ, হতাশা, আত্মতুষ্টি, প্রতিশোধ, বিনোদন, নিজেকে জাহির করার ইচ্ছে । প্রত্যেকটি আসলে বর্তমান সময়কালে আমাদের অন্তরের রিপু অর্থাৎ শত্রু। মনোবিজ্ঞানীরা যদিও মনে করেন যে, যারা আক্রমণ করছেন তারাও চাইলে নিজেদের ভেতরের এই অন্ধকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন খুব সহজেই। শুভ চিন্তা, ভালো ভাবনার খোরাক এই সামাজিক মাধ্যমে মজুত থাকে। আপন করে নেওয়ার অপেক্ষা শুধু।
এবার আসা যাক যাঁর সঙ্গে সাইবার বুলিং হচ্ছে তাঁর কথায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন সাইবার বুলিং-এ একটি বিশেষ ধরনের মনোবিদ্যা কাজ করে। যাকে বলে মব সাইকোলজি। কেউ হয়তো একটি বিশেষ ধরনের মতামত পোষণ করেন একটি ক্ষেত্রে। সাধারণভাবে হয়তো তিনি সেই নিয়ে কথাও বলেন না। হঠাৎ তিনি দেখলেন যে সামাজিক মাধ্যমে আরো মানুষ তাঁর সেই মতামতকে কোনোভাবেই সমর্থন করছে না। কেউ হয়তো কটুক্তিও করে বসলো। এদিকে প্রথম ব্যক্তির মনে হচ্ছে তাঁর ভাবনা ভুল হতেই পারে না। এমন চিন্তা-ভাবনার বীজ নিজের ভেতরে বপণ করা থাকলে সাইবার বুলিং-এক সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন বয়সন্ধিতে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। কারণ এই সময় সেই কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতী সমাজ ও পারিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্থান নির্ধারণ করছে বা খুঁজে পাচ্ছে। এমন সময় সাইবার বুলিং-এর শিকার হলে তার মনের কাঠামোটা নষ্ট হয়। যারা এই বুলিং-এর শিকার হন তাদের আত্মবিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সবচেয়ে সমস্যা তৈরি হয় যখন তারা ভাবতে শুরু করেন যে তারা একা। বিশেষ করে যদি সাইবার বুলিং-এর ক্ষেত্রে মিলিত আক্রমণ হয়। ফলে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেন, অবসাদ ও উৎকন্ঠায় ভোগেন।
সাইবার বুলিং আসলে সামাজিক অসুখ। মনোবিদরা বলছেন এই অসুখ থেকে মুক্তির উপায় আত্মসচেতনতা, সামাজিক মাধ্যমে বিচরণ করার সময় সীমাবদ্ধ করা, সামাজিক মাধ্যমের গণ্ডিকে ব্যক্তিগত স্তরে প্রভাব না ফেলতে দেওয়া। মন আহত হলে তার শুশ্রুষার প্রয়োজন হয়। তাই কোন ক্ষেত্রে আহত হলে ভেঙে না পড়ে নিজের পছন্দের কাজগুলো করা উচিত বলেই মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
এমনকী ভার্চুয়াল ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব পাতানোর বিষয়েও তারা সচেতন হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। আর আক্রমণকারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অসুখের চিকিৎসার। নিজের ভেতরের অন্ধকারকে ঢেকে না ফেলে উচিত তার সঙ্গে মোকাবিলা করা। সেই অন্ধকারকে মোছার চেষ্টা করা। নিজের অবস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় সকলকেই। বিশেষজ্ঞদের মতে সেই অবস্থানকে মেনে নিয়ে আপন করে ভালোবেসে এগিয়ে চলাই সুস্থ জীবনের পথে পৌঁছে দেয় আমাদের। মানসিক সুস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এটি এগিয়ে চলার মূল মন্ত্র।