পরনে দক্ষিণী পোশাক। গলায় অবিন্যস্ত গয়না। সাজের মধ্যে কোথাও পরিপাটির বালাই নেই। তবুও মানুষটার মধ্যে যেন একটা ছায়া বিরাজ করছে। যে ছায়া রোদের প্রখর তাপকে শুষে নিয়ে আলোময় করে দিতে পারে চরাচর। আসলে এই নারী যে গাছকে আগলে রাখেন। সন্তানের মতো স্নেহ করেন গাছেদের। তাই তো ৭২ বছর বয়সেও এই মহিলা সতেজ, গাছেদের মতোই উচ্চশির, প্রাণবন্ত, স্বতন্ত্র। তুলসী গৌড়া। কর্নাটকের তুলসী গৌড়া গাছ-অন্ত-প্রাণ।
প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও ভালোবেসেছেন গাছকে। স্কুল-কলেজের কোন শিক্ষাই তাঁর নেই। তবে ডিগ্রিহীন হলেও তাঁর জ্ঞানের পরিধি অসীম। আসলে ছোট থেকেই নিজের ভালোবাসার জায়গা, আঁকড়ে ধরার মাটির ক্ষেত্রে আপোষ করেননি তুলসী। বেছে নিয়েছেন সযত্নে, সস্নেহে গাছকে লালন করা। বয়স ৭২ হলেও বয়স তাকে ভারাক্রান্ত করেনি। তাই গাছ নিয়ে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। কর্নাটকের এই পরিবেশবিদের কাছে নেই কোন প্রথাগত শিক্ষা বা ডিগ্রী। অথচ এক ঝলক দেখলেও গাছের প্রজাতি, তাঁকে বড় করার উপায় বলে দিতে পারেন নিমেষে। সবটাই এসেছে অভিজ্ঞতা থেকে। আর সঙ্গ দিয়েছে ভালোবাসা। তাই এই বৃদ্ধা পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন সম্প্রতি।
তবে এসব তো নেহাত আজকের কথা। কিন্তু গাছেদের প্রতি তুলসী দেবীর এই ভালোবাসা ছোট থেকেই ছিল। কোন স্বীকৃতি বা পুরস্কারের আশা না করেও সেবা করে গেছেন গাছেদের। সঙ্গে ভালবেসেছেন পরিবেশকে। নিজের আশেপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় তুলসী গৌড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন বরাবর। সারা জীবন ধরে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি গাছের চারা পুঁতেছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উৎসাহিত করেছেন অনেক মানুষকে।
গল্পের মত শুনতে লাগলেও এই কাজ বা এই জীবনের শুরুটা ছিল কাঁটায় ভরা। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে তুলসী। মাত্র ২ বছর বয়সে হারিয়েছিলেন বাবাকে। পরিবারের তখন চরম দুরবস্থা। কোন মতে মা কষ্ট করে সংসার চালানোর চেষ্টা করতেন। নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতেই ফুরিয়ে যেত ইচ্ছেরা। তুলসীর মা তখন একটা নার্সারিতে কাজ শুরু করেন। অত ছোট মেয়েকে বাড়িতে রেখে কাজে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন মেয়েকে। গাছেদের সময় মত যত্ন নেওয়া, পরিচর্যা করা, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রথম নজরে আসে ছোট্ট তুলসীর। এ যেন অবিকল মানব শিশুকে জন্ম থেকে লালন-পালন করে জীবনের নির্দিষ্ট দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া! ভালো লেগেছিল ছোট্ট তুলসীর।
কর্নাটকের হলক্কি জনজাতির মেয়ে তুলসী গৌড়া। মায়ের কাজ দেখে গাছেদের প্রতি টান জন্মালো তুলসীর। পরিবেশ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন তখন। এদিকে ছোট্ট মেয়ে দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে। গায়ে গত্তি লাগতেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিল তুলসীকে। তবে কী গাছ-গাছালির যত্ন করা হারিয়ে যাবে তুলসীর জীবন থেকে? না কোন ক্ষেত্রেই হার মানেননি তুলসী। স্বামীর সঙ্গে একেবারে স্পষ্ট কথা বলে নিলেন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি গাছেদের যত্ন নেওয়া তাদের নিয়ে কাজ করা, এসব তুলসীকে সঙ্গ দেবে সব সময়। পরিবারের তরফেও তেমন কোন আপত্তি ছিল না। তাই সংসার সামলানোর পাশাপাশি মন প্রাণ ঢেলে সামলালেন গাছেদের। নিজের হাতে প্রথমবার বীজ থেকে গাছ জন্মাতে দেখেছিলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। কিশোরী বেলার সেই দিনের কথা আজও মনে আছে তুলসী গৌড়ার। তারপর আর থামেননি। স্কুল-কলেজের চৌকাঠ পার না করলেও পরিবেশ নিয়ে তাঁর আগ্রহ, উৎসাহকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে কর্নাটকের বনদপ্তর।
কর্নাটকের বনদপ্তরে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ জুটে গিয়েছিল তুলসীর। অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করলেও তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ভালোবাসা নজর কেড়েছিল সরকারি আধিকারিকদের। কর্মনিষ্ঠা দেখে তাঁকে স্থায়ী কাজে বহাল করা হয়। আজও গাছেদের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন তুলসী।
কাজের শেষে অবকাশ বা অবসরের সময় আসে নিয়ম মেনেই। এসব নিয়মের অন্যথা হয় না।। ৭০ বছর বয়সে কর্ম জীবন থেকে সরকারি নিয়মে অবসর নিয়েছিলেন কর্নাটকের তুলসী। কিন্তু তাঁর প্রাণের থেকে প্রিয় গাছ! তাঁদের সঙ্গ আজও ছাড়েননি এই নারী। ৭২ বছর বয়সেও বিরামহীন ভাবে গাছেদের সেবা করে চলেছেন তুলসী। তাঁর এই অন্যরকম কাজের জন্যই পদ্মশ্রী পেয়েছেন তিনি। তবে পুরস্কার তাঁর অন্তরকে স্পর্শ করলেও, কাঁপা হাত, জল ভরা চোখ নিয়ে একইভাবে গাছেদের ভালবেসে চলেছেন তুলসী। কোনরকম প্রত্যাশা ছাড়াই।