১৮৭০ সালের কলকাতার 'সুলভ সমাচার' পত্রিকা। সেখানে লেখা হলো এক বিশেষ যান নিয়ে। কি লেখা হলো?
''বছর দুই হইল কলিকাতায় দুই চাকার এবং তিন চাকার একরকম গাড়ি আসিয়াছে, যাহার উপর চড়িয়া পা নড়াইলেই গাড়ির মতো দৌড়ায়''। সেই গাড়ি তখন এখনকার ভাষায় 'হার্টথ্রব'। পথ চলায় সাবালকত্ব আসছে। কি নাম সেই সাবালকত্বের? নাম-সাইকেল।
ট্রিং ট্রিং করে বাজনা বাজছে। এই গাড়ি চালাতে চালাতে বাজানো যায় চাকতির মত একটা বাজনা। সাইকেলের বেল। আর সঙ্গে ফ্রী মুক্ত হাওয়া।
এক সময় কলকাতার রাস্তা দাপিয়ে বেড়িয়েছে সাইকেল। ভালোবাসার টক-ঝাল-মিষ্টি অভিমান থেকে শুরু করে বন্ধুত্বের খুনসুটি সবকিছুরই সাক্ষী হয়েছে সে।
জগদীশচন্দ্র বসু এই যান সম্পর্কে বলেছিলেন 'আমাদের পুষ্পক রথ'।
সাইকেল মানে যেন এক টুকরো নস্ট্যালজিয়া। নিজের চালক নিজেই হওয়া যায়। দামে কম। দূষণমুক্ত এই যান চলতে পারে যে কোন রাস্তায়। পকেট হালকা হওয়ার ভয় নেই। একবার কিনে নিলেই সে টিকে যায় 'নিখাদ ভালবাসা'র মত।
তবে চেহারাটা একেবারে সাদামাটা। রোগা-পাতলা, ছোট একখানা সিট, দুটো চাকা। কোন বাহুল্য নেই।
কলকাতায় প্রথম এসেছিল ট্রাইসাইকেল। তিন চাকা যুক্ত সেটি। তবে তার আগেই ছিল ট্যান্ডেম। বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক সাইকেল। একসঙ্গে অনেকে মিলে চালানো যায়। বেশ হইহই করতে করতে বনভোজনে যাওয়ার মত।
ভারতে প্রথম সাইকেল তৈরি করেছিলেন সাঁতরাগাছির বাসিন্দা প্রসন্নকুমার ঘোষ। তবে সেটা ঠিক বাইসাইকেল নয়। তাতে আগে একজন এবং পিছনে দু'জন বসার ব্যবস্থা ছিল। সময়টা ছিল ১৮৭০ সাল।
কলকাতার বেশ কিছু অবস্থাপন্ন বাড়িতে তবে বিলেত থেকে আমদানি হয়ে আসতো ভেলোসিপেড সাইকেল।
১৮৮৫ সালে প্রথম ব্রিটেনে কেম্প স্টার্লি তৈরি করেন বর্তমানে ব্যবহৃত সাইকেলের মতো 'সেফটি বাইসাইকেল'।
তারপর ধীরে ধীরে সব রকম আর্থিক ভেদাভেদ মুছে মধ্যবিত্ত বাড়ির উঠোন থেকে শুরু করে অবস্থাপন্ন বাড়ির গ্যারেজেও নিজের পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিল সাইকেল।
একসময় কলকাতায় সাইকেল এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ১৮৯৭ সালে গড়ে ওঠে 'সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন'।
তখন সাইকেল চালাতে জানা মানে বিশেষ সম্মানের অধিকারী হওয়া। এমনই ছিল দু'চাকার এই যানের আদর।
তারপর কালের স্রোতে সময় বয়ে গিয়েছে। সাইকেলের চেহারা বদলেছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে তার সেই আটপৌরে চেহারায় পড়েছে গ্ল্যামারের ছাপ। নানা বিশেষত্ব এসেছে এটা চালানোর প্রযুক্তিতে।
দু'চাকার যান রূপান্তরিত হয়েছে চার চাকার আধুনিক গাড়িতে। আধুনিকতার সঙ্গে তারা নিয়ে এসেছে দূষণ। তবুও প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই। সাইকেলে বিশ্ব-ভ্রমণ এখন 'বিশেষ'-এর তালিকায় পড়ে।
কলকাতার রাস্তায় চার চাকার গাড়ির ভিড়ে এখন ব্রাত্য সাইকেল। গ্যারেজগুলোতেও তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে মোটরসাইকেলের আবির্ভাবে।
তবুও আজও পরিবেশের বন্ধু এই সাইকেল। কখনো আবার বাল্যপ্রেমের সঙ্গী সে।
সাইকেলের এই রোমান্টিকতাকে সম্মান জানাতেই প্রতিবছর ৩রা জুন পালিত হয় 'বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস'। ২০১৮ সাল থেকে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে পালিত হয় এই বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস। ক্রমাগত দু'শতক ধরে মানুষের জীবনে দু'চাকার এই যানের ভূমিকাকে সম্মান জানাতেই এই উদ্যোগ। এই বছর 'শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে সাইকেলের যোগাযোগ' বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সমগ্র বিশ্বে পালিত হচ্ছে এই দিন।
বিশিষ্ট চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিশ্বের সাইকেল প্রেমী মানুষরা অংশগ্রহণ করেন এই দিনের নানা কর্মসূচিতে।
আধুনিক নানা যানবাহনের ভিড়ে অতিসাধারণ এই সাইকেল হয়তো আজ আর চোখে পড়ে না সেভাবে। কিন্তু বাঙালির স্মৃতি-পথে এর যাতায়াত অবাধ।