মউলিদের জীবন-কথা

সুন্দরবনের মউলি বা মধু সংযোগকারীরা ঘর বাঁধেন বিপদের সঙ্গে। ওদের জীবন আঁকাবাঁকা, পাথুরে। তবুও স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধমাখা জীবনের সঙ্গেই ওদের প্রেম। কথ্য ভাষায় এই মধুসংগ্রহকারীদের নাম মউলি। বেশিরভাগ মধু সংগ্রহকারীদের গায়ে লেগে থাকে ক্ষত। কামট, সাপ বা হিংস্র জন্তু-জানোয়ার কামড়ানোর দাগ। আর বাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে জীবন নিয়ে ফেরার আশা প্রায় থাকে না বললেই চলে। এমন জীবনের সঙ্গেই আজও রোজ লড়াই করে মধু সংগ্রহকারীরা। সমাজ সঙ্গে সঙ্গে অনেক পরিস্থিতি বদলালেও লড়াইটুকু আজও ওদের সঙ্গী।

বেশিরভাগ মধু সংগ্রহকারীরা খুব ছোট বয়স থেকেই এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে ভয়কে জয় করে ফেলে কম বয়স থেকেই। কিন্তু সঙ্গী হয় অনেক কুসংস্কার। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার কামড়ালে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরিবর্তে কবচ, মাদুলি এইসব ধারণ করার অভ্যেস রয়েছে এখনো অনেকের। ফলে মধু সংযোগকারীরা আহত হলে চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যন্ত পৌঁছনো একটা লম্বা পথ।

বাজারে বিক্রি করার জন্য মধু সংগ্রহ করা আজও সুন্দরবনের মানুষের অন্যতম একটা জীবিকা। তবে নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কুমিরের আক্রমণ, বাঘের ভয় ছাড়াও নানা জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণের ভয় থাকে।

ম্যানগ্রোভ অরণ্যে মধু সংগ্রহকারীরা গেলে প্রায়শই আহত হয় পুরুষরা। আগে সাধারণত বাড়ির পুরুষ সদস্যরা এই কাজ করতে যেত। কিন্তু এখন মেয়েরাও সঙ্গ দিচ্ছে পুরুষদের। তাই মধু সংগ্রহকারীদের জীবন বিপন্ন হওয়ার তালিকায় শুধু পুরুষ নয়, যোগ হয়েছে মেয়েদের নামও।

প্রধানত এপ্রিল থেকে জুন মাসে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত এই সময় সরকার থেকে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় যাতে মাঝে প্রজাতি বংশবৃদ্ধি করতে পারে। বহু মৎস্যজীবী এই সময় মধু সংগ্রহ করার কাজ নিয়ে প্রায় ১৫দিন বা তার বেশি দিনের জন্যেও জঙ্গলে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মধু বাইরে রপ্তানিও করা হয়।

এই মধু সংগ্রহের কাজ শুনতে সহজ হলেও এই কাজ সম্পন্ন করা বেশ কঠিন। প্রয়োজন হয় আগাম প্রস্তুতির। বনদপ্তরকে খবর দিয়ে বি এল সি অর্থাৎ বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট আছে এমন চালক বা নৌকো ভাড়া নিতে হয়। বেশিরভাগ মধু সংগ্রহকারী এর জন্য অর্থ ধার হিসেবে নেয় স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে। নৌকোর ভাড়া হিসেবে শুধু টাকা দিলেই হয় না নৌকোর মালিককে কয়েক কেজি মধু দিতে হয়। জঙ্গলে দুর্ঘটনা হলে সেই বিমা সংক্রান্ত টাকাও দিতে হয় বন দপ্তরকে।

এ তো গেল খরচের পর্ব। এরপরেও রয়ে যায় আশঙ্কা। জঙ্গলের ডাকাতদের হাতে নিজেদের উপার্জিত অর্থ হারানোর সম্ভাবনা থাকে।

সাধারণত আকাশ পরিষ্কার থাকলে নদীতে মরা কোটালের সময়ে নৌকো ভাসানো হয়। মধু সংগ্রহের এই সময়টাতে তারা নৌকোতেই থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেয়।

মৌমাছিদের ওড়ার পথের দিক নির্ণয় করে মউলিরা বুঝতে পারে কোন গাছে মৌচাক আছে। যথাসম্ভব মৌমাছিদের ক্ষতি না করে মধু সংগ্রহের চেষ্টা করে ওরা। এমনকি মৌচাক আবার পুনর্গঠন হওয়া সম্ভব বলে মধু সংগ্রহকারীরা সাধারণত পুরো চাক ভাঙ্গে না। তবে কোনোভাবেই মৌমাছিদের কোন ক্ষতি হলে তারা আঘাত করে হুল ফুটিয়ে। তখন সঙ্গে সঙ্গে কোন ওষুধের ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয় না। আঙুল দিয়েই হুলটাকে উপড়ে ফেলতে হয় ওদের।

এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মধু সংগ্রহকারীদের সঙ্গী থাকে ওদের সাহস আর ওদের বিশ্বাস। সুন্দরবনের রক্ষাকর্ত্রী দেবী বনবিবির প্রতি অগাধ বিশ্বাস। সাধারণত মধু সংগ্রহ করার জন্য বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে প্রথমবার বনবিবির উদ্দেশে মন্ত্রপাঠ করে ওরা। তারপর সেই পথে বিপদ এলেও রয়েছে আলাদা মন্ত্র। বিভিন্ন মরসুমে কেওড়া, গরাণ ইত্যাদি গাছ এবং ফুলের মধু এভাবেই সংগ্রহ করে চলে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহকারীরা।

একটি মধুসংগ্রহকারীদের অভিযানে সাধারণত ছয় থেকে সাত জন যোগ দেয়। প্রত্যেকে গড়ে ১ থেকে ১.৫ কুইন্ট্যাল করে মধু সংগ্রহ করে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে প্রথমে বনদপ্তরকে এই মধু বিক্রি করতে হয়।। তবে খুব সম্প্রতি সরকারের তরফ থেকে বনদপ্তরকে এই মধু বিক্রির একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে উদ্বৃত্ত মধু মউলিরা সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে পারে। তবেই ঘরে আসে প্রয়োজনীয় অর্থটুকু। এভাবেই জীবন চলে ওদের। তবে মধু সংগ্রহকারীরা সাধারণত বছরের অন্যান্য মাসগুলোতে অন্য জীবিকার সঙ্গে যুক্ত থাকে। পরিবারের সান্নিধ্য উপভোগ করার সময় তাদের থাকেনা। অবকাশ তো নয়ই। জল, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আর অগাধ লড়াইকে সঙ্গী করে চলে ওদের জীবন। তবুও জঙ্গল ছেড়ে আসার কথা ভাবে না ওরা। জঙ্গল ওদের কাছে ওদের জীবনের অংশ। ভালোবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে আঁকড়ে রাখা এক টুকরো মাটির মতোই স্নিগ্ধ, সতেজ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...