আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এইডসে মানেই অজস্র মিথের ছড়াছড়ি! বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মিথটা অনেক বেশি। এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ মানেই অস্পৃশ্য, বিষয় কেউ সেই বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। আসলে আমাদের অজ্ঞতাই এইচআইভি আর অবাধ যৌনতাকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দিয়েছে; আমরা মানতেই চাই না যে, এটাও একটা সাধারণ ভাইরাস ঘটিত রোগ। জীব মাত্রই তার রোগ হবে। এইচআইভি বা এইডস শুনেই আমাদের একটা নাক সিঁটকানো ব্যাপার আছে। এইডস আর অবাধ যৌনতা যেন প্রতিশব্দ! কিন্তু সত্যি বলতে কী অসুরক্ষিত যৌনমিলনের ফলে এইচআইভি সংক্রমিত হয় ঠিকই, কিন্তু এছাড়াও এইচআইভির সংক্রমণের আরও অনেক কারণ আছে। তবে ঐ তৃতীয় বিশ্বেরদেশের যা স্বভাব, আমরা অর্ধেক শুনি এবং তারও এক চতুর্থাংশ বুঝি, এই আমাদের ইউ এস পি!
এইচআইভি কিন্তু কখনই ছোঁয়াচে নয় অর্থাৎ সংক্রামক নয়! বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এইডসের ওষুধ আবিষ্কার করা। যে ভাইরাস তার আকার মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন করে তার নিরাময় করা অসম্ভব নয় বটে, কিন্তু খুবই কঠিন। কারণ সদাপরিবর্তনশীল এই আকারের জন্যই এইচআইভির উপর কোনও মেডিক্যালড্রাগই কার্যকরী হয় না। ১৮ই মে ১৯৯৭ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্লিনটন এক সাংবাদিক বৈঠকে বিজ্ঞানের এই চ্যালেঞ্জের কথা বলেন এবং সারা বিশ্বকে উপলব্ধি করান যে, এই রোগের ভ্যাকসিন কতটা প্রয়োজন এবং কত দ্রুত সেটা নিয়ে আসা প্রয়োজন, ঠিক তার পরের বছর থেকেই, ১৮ই মে ১৯৯৮ থেকে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে এইডস ভ্যাকসিন দিবস। এছাড়াও প্রত্যেক বছর ১লা ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব এইডস দিবস, ১৯৮৮ সাল থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যার আয়োজন করে আসছে।
এইডস অর্থাৎ অ্যাকুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম, বহু রোগ লক্ষণকে একত্রে বলা হয় সিনড্রোম, মানব দেহে এইচআইভি অর্থাৎ হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস সংক্রমিত হলে মানুষ এইডস দ্বারা আক্রান্ত হয়। এটি একটি ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি রোগ, যা সরাসরি আমাদের অনাক্রম্যতা তন্ত্রের অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। এইচআইভি সংক্রমণের ফলে, দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অনাক্রম্যতা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সাধারণ রোগও অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ হয়ে যায়। রোগ নিরাময় ব্যবস্থা দুর্বল বা বিলম্বিত হয়ে যায়। আশির দশকে প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট আনুমানিক ৩ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন। এইডসকে বর্তমানে একটি মহামারী ব্যাধি হিসেবে গণ্য করা হয়। যা বিশ্বের বিশাল এক আয়তন জুড়ে বিদ্যমান এবং যা সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
ভাইরাসটি সম্ভবত উনিশ শতকের শেষভাগে বা বিংশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকাতে উৎপত্তিলাভ করে। সর্বাধিক এইডস রোগীও ওই অঞ্চলেই পাওয়া যায়! ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সর্বপ্রথম রোগটি শনাক্ত করে এবং তারপরে ১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকে এই রোগের কারণ হিসেবে এইচআইভি ভাইরাসকে শনাক্ত করা হয়। ভারতে প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হন, এর মধ্যে প্রায় ১০% শিশু থাকে। যেহেতু একবার সংক্রামক ভাইরাসের শরীরে প্রবেশ করলে তাকে পুরোপুরি দমন করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই এইচআইভি সংক্রমণ হলে এইডস প্রায় অনিবার্য। বিনা চিকিৎসায় ভাইরাস সংক্রমণ থেকে এইডস পর্যায়ে পৌঁছতে; ভাইরাসের যদি গড়ে দশ বছর সময় লাগে, তবে নিয়মিত চিকিৎসার দ্বারা তাকে আরও কিছু বছর বিলম্বিত করে দেওয়া যায়। এইডসের চিকিৎসা পদ্ধতি, অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ এবং সাধারণের সাধ্যের অতীত।
২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লক্ষ লোক এইচআইভিতে আক্রান্ত ছিলেন।ঐ বছর এইডসের কারণে ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। তবে ২০১৬ সালে ২০১৫ সালের তুলনায় নতুন সংক্রমণের সংখ্যা ৩ লক্ষ কম ছিল।
১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি সর্বপ্রথম এই রোগ নিয়ে কাজ শুরু করে এবং অবশেষে ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এই মহামারী রোগের ভাইরাসকে শনাক্ত করতে সফল হন। ফরাসি বৈজ্ঞানিকেরা এর নাম দেন লিম্ফাডেনোপ্যাথি-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস (Lymphadenopathy-associated virus, LAV) অর্থাত "লসিকাগ্রন্থির রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাস"। মার্কিন বিজ্ঞানীরা এর নাম দেয় Human T-cell Lymphotropic virus, strain III, ১৯৮৬ সালে এই ভাইরাসের ফের নামকরণ করা হয় Human ImmunoDeficiency Virus। এইচআইভি ভাইরাস মানুষের শরীরের টি-লিম্ফোসাইটের সহায়ক টি-কোশকে আক্রমণ করে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে অর্থাৎ অনাক্রম্যতা প্রদানকারী কোশই হল এইচআইভির প্রধান শত্রু।
HIV-1 এবং HIV -2 উভয় ধরনের ভাইরাসই, পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকার গরিলা বা শিম্পাঞ্জি জাতীয় স্তন্যপায়ীদের থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। যেগুলি বিংশ শতকের প্রথম দিকে মানুষের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়।
HIV-1 ভাইরাসটি সিআইভি নামক ভাইরাসের বিবর্তনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। সিআইভি অর্থাৎ সিমিয়ান ইমিউনোডফেসিসিস ভাইরাস, যা বন্য শিম্পাঞ্জিকে সংক্রামিত করে।
HIV-2 সোটি ম্যাগাজি –এর একটি ভাইরাস, উপকূলীয় পশ্চিম আফ্রিকায় বসবাসকারী একটি পুরানো বিশ্বের বানরের দেহে এর প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নতুন বিশ্বের বানররা কিন্তু HIV-1 সংক্রমণ প্রতিরোধী, সম্ভবত এর দেহে এইচআইভি ভাইরাস প্রতিরোধী দুটি জিন বিদ্যমান।
বিংশ শতকের একদম প্রথম দিকে প্রথাগত পতিতাবৃত্তিকে সংক্রমণের প্রধান কারণ মনে করা হত। একটি ভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আফ্রিকার নিম্নমানের চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি যেমন জনসাধারণকে টিকাদান, অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া চিকিৎসা অভিযানের সময় একই সিরিঞ্জের পুনর্ব্যবহার করা হয়েছিল, এগুলোই ছিল প্রাথমিক ভেক্টর যা ভাইরাসকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
১৯৫২ সাল কঙ্গোতেই সর্বপ্রথম মানুষের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ ছিল, এইচআইভির সর্বপ্রথম সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নথিভুক্ত ঘটনা।
এইডস প্রধান কারণ অসুরক্ষিত যৌনতা। অবাধ যৌন সম্পর্কের ফলে বাহক থেকে সুস্থ শরীরে সহজেই প্রবেশ করে এই রেট্রোভাইরাস। একাধিক যৌন সংসর্গে, বহুগামিতা ইত্যাদি কারণে এইডস হতে পরে। আক্রান্ত বা বাহকের সঙ্গে যৌন মিলন এইডস বিস্তারের একটি অণ্যতম প্রধান কারণ।
আক্রান্তের ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ব্যবহার করার ফলেও রোগ ছড়িয়ে পড়ে সুস্থ মানুষের দেহে।এইচআইভি আক্রান্ত প্রসূতির মায়ের দেহ থেকে সন্তানের শরীরেও এইডস হতে পারে।
সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ যৌন জীবন রয়েছে এমন পেশায় নিযুক্ত মানুষদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যৌন কর্মীদের থেকে এইচআইভি সংক্রমিত হয়ে থাকে। মুমূর্ষু অস্থায় রক্তের প্রয়োজন হলে অবশ্যই এইডস পরীক্ষা করে শরীরে রক্ত দিতে হবে। কারণ রক্ত সঞ্চারনের মাধ্যমেও সুস্থ মানুষ এইচআইভি আক্রান্ত হয়। এইডসের কারণ গুলিই এর বিস্তারের কারণ যেমন অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, রক্ত সঞ্চারণ, আক্রান্তের মাধ্যমে তার শিশুর দেহে সঞ্চারণ, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ,ব্লেড ইত্যাদি ব্যবহার করলে এইডস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যে সব লক্ষণে বুঝবেন এইচআইভি-
নিয়মিত জ্বর হওয়া ও এক-দেড় মাস ধরে একটানা জ্বর স্থায়ী হতে পারে।
জ্বরের সঙ্গে গলায় অস্বাভাবিক ব্যথা হয়। খাবার খেতে ও গিলতে সমস্যা হয়। ঘুমের মধ্যেও তীব্র ঘাম হওয়া। শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে শুরু করে বলে, চট করে রোগ নিরাময় হয় না। দুর্বলতা, বমি, পেটের সমস্যা দেখা যায়।ভাইরাস দেহে প্রবেশ করলেই তার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সে রোগ লক্ষণ প্রকাশ করে যা ইনকিউবেশন পিরিয়ড নামে পরিচিত। প্রতিটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে সেই সময়কাল আলাদা আলাদা হয়। ক্রোয়েশিয়ার সংস্থা 'অ্যাক্ট ডার্মাটোভেনরল'-এর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এইচআইভির ক্ষেত্রে প্রায় ৮৮ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে প্রথম তিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যেই গলায়, মাথায় র্যাস দেখা দেয়। তীব্র প্রদাহ হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ঘাম। এই ভাবেই এইডস জানান দেয় তার আগমন কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রকাশ পেতে আট থেকে দশ বছর সময়ও লেগে যায়। এলাইজা পরীক্ষার মাধ্যমে এইডস নির্ণয় করা যায়।
আমরা কি করতে পারি? আমরা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে পারি, সুরক্ষিত যৌন জীবন, রক্ত সঞ্চারণের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল সাবধানতা অবলম্বন করতে পারি। বিয়ের ক্ষেত্রে ঠিকুজি কুষ্ঠি না মিলিয়ে রক্ত পরীক্ষা করতে পারি। এই কয়েকটা জিনিসই আমাদের হাতে রয়েছে, তাই সেই সাবধানতাগুলো অবলম্বন করা আবশ্যক।
রোগ লক্ষণ না লুকিয়ে, ডাক্তারের কাছে সম্পূর্ণ সবিস্তারে বলতে হবে এবং তার পরার্মশ গ্রহণ করতে হবে। এখানে চিকিৎসা বিষয়ক কিছুই বলব না, কারণ সেটা চিকিৎসকের কাজ এবং আমরা
সেই সংক্রান্ত কোনও আলোচনা করতে পারি না। তবে এইটুকুই বলার যেকোনও রোগ চেপে না রেখে ডাক্তার দেখান।
এইডস রোগীর ক্ষেত্রে মানসিক ভাবে ভালো থাকাটা জরুরি। তাই বৈষম্যমূলক আচরণ না করে, তার সাথে সাধারণ মানুষের মতো ব্যবহার করুন। রোগীর ছোঁয়া থেকে বা তার খাবার খেলে, তার সাথে ঘুরলে, এমন কি তাকে কামড়ানো মশা কামড়ালেও এইডস হয় না, এই এইডস নিয়ে অনেক মিথ, আর মিথ চর্চা করতেও ভাল লাগে না।
তাই এইডস নিয়ে এক রূপকথার গল্প বলি, ক্যাফে পজিটিভ !
জিনিস টা কি?
আমাদের খাস কলকাতাতেই আছে এটি, যা কিনা এশিয়ার মধ্যে প্রথম, জন্ম থেকে যারা এইচআইভি পজিটিভ তাদের দ্বারাই পরিচালিত ক্যাফে। যোধপুরপার্কের একটি গ্যারেজঘর থেকেই এদের পথ চলা শুরু হয়। ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী ছেলে মেয়েদের নিয়ে তৈরি এই ক্যাফে, এখানে পাবেন কেক, কফি, পেস্ট্রি আরও অনেক কিছু যা আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এরা তৈরি করেন। কান্ডারি হিসেবে এদের সাথে আছেন কল্লোল ঘোষ, একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মী। আসলে সাহস করে এগোতে এবং, এইডস রোগী মানেই অস্পৃশ্য নয়, এদের হাতের খাবার খেলে আপনি মরে যাবেন না! তাই সচেতনতার বুলিকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে এক কদম এগিয়ে আসুন এদের সাবলম্বী করতে। এরা সাহায্য নয় বরং শ্রম ও পরিষেবা দিয়ে সাধারণের বাঁচতে চাইছে। আমরা যারা প্রিভিলেজড বাই দ্যি গ্রেস অফ গড, আসুন না এদের সাথে চলি, এক কাপ কফিই তো! খাই না এদের থেকে একদিন। কী খেতে এবং তো নাকি?
আসুন না সবাই মিলে এক সুন্দর মনের মানুষ দিয়ে ভর্তি পৃথিবীর জন্য একটি ছোট্ট পদক্ষেপ ফেলি। সুন্দর পৃথিবীর সংকল্পে বলে উঠি, এমন পৃথিবী হোক "যেথা নাইকো দুঃখ নাইকো জরা"। মিথের ওপারটায় যে ভালোবাসা বাস করে।